বিশেষজ্ঞদের অভিমত-টিপাইমুখ বাঁধে ক্ষতি হবে বাংলাদেশ ও আসামের
বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ হলে তা বাংলাদেশ এবং ভারতের মণিপুর, আসাম, মিজোরামের জনজীবন ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। দু'দেশের পাহাড়-জঙ্গল পানিতে ডুবে যাবে এবং অনেক লুপ্তপ্রায় প্রাণিসম্পদ ধ্বংস হবে। ঘর আর জীবিকা হারাবে বহু মানুষ। তাছাড়া টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পর সেটি ভূমিকম্পে ধসে পড়লে আসাম ও বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার খবরে বাংলাদেশ এবং ভারতের মণিপুর, আসাম ও মিজোরামের জনগণের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। সুশীল সমাজ ও বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে
বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে ভারত সরকারের ব্যাখ্যা দাবি করেছেন। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (বহিঃপ্রচার অনুবিভাগ) শামীম
আহসান সমকালকে বলেছেন, 'ঢাকা নয়াদিলি্লর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করছে। নয়াদিলি্লতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশের ক্ষতি হবে এমন কিছু করবেন না বলে একাধিকবার আশ্বস্ত করেছেন।'
ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতের এনএইচপিসি ও এসজেভিএনের মধ্যে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সই হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর এ বিষয়ে একটি চুক্তি সই হয়।
মণিপুর সরকার এবং প্রকল্পের অন্যতম অংশীদারের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি শুক্রবার এ খবর জানিয়েছে। আর হাইড্রোওয়ার্ল্ডডটকম নামে একটি ওয়েবসাইট বলেছে, গত ২২ অক্টোবর সই হওয়া যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পে জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগমের (এনএইচপিসি) ৬৯, রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ সংস্থার (এসজেভিএন) ২৬ এবং রাজ্য সরকারের পাঁচ ভাগ মালিকানা থাকবে। চুক্তি সই অনুষ্ঠানে ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী ও মণিপুর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে টেলিফোনে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার সমকালকে বলেন, 'এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে ভারতকে বাধা দেওয়ার অধিকার বাংলাদেশের নেই। তবে ভারত যা করতে যাচ্ছে এর ফলে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘি্নত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবেন।'
প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০১০ সালে নয়াদিলি্ল এবং ২০১১ সালে ঢাকায় যখন বৈঠক করেন তখন বরাক নদীতে বাঁধ নির্মাণের ইস্যু স্থান পায়। সেসব বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আস্থার সঙ্গে বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে তার দেশ এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। তবে তিনি এটাও বলেননি যে, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করবে না। এ অবস্থায় দু'দেশের প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে।
মাহবুবুর রহমান তালুকদার বলেন, বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘ সালিশ আদালতে গেছে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনে উপযুক্ত আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ও ভারতে প্রতিক্রিয়া-বিক্ষোভ : টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ায় বাংলাদেশ ও খোদ ভারতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশকে না জানিয়ে ভারত টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিনিয়োগ চুক্তি সই করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং কূটনীতিকরা। তারা দ্রুত বাংলাদেশকে কঠোর অবস্থান গ্রহণের দাবি জানান।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ সমকালকে বলেন, অনেক আগে থেকেই দেশের সচেতন নাগরিকরা ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু সরকার এ বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে ভারতের সঙ্গে তাদের ইতিবাচক আলোচনার কথা জানায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, আমাদের উদ্বেগই সত্যিই হয়েছে। ভারত ওই প্রকল্পের চুক্তি সই করার আগে বাংলাদেশের ক্ষতি নিয়ে কোনো কিছুই ভাবেনি। এখন সরকারের উচিত কঠোর অবস্থানে যাওয়া। এ ব্যাপারে ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ বলেন, একবার বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল হেলিকপ্টার নিয়ে টিপাইমুখ ঘুরে এসে বলল, ভারত বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে না। কিন্তু বাস্তবে তাদের বক্তব্যের বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশের উচিত এ ব্যাপারে ভারতের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া।
বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক কূটনীতিক ফারুক সোবহান বলেন, সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে একটা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করা। সেখানে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের রেখে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাগাল্যান্ডের দ্য মুরাং এক্সপ্রেস জানায়, আসামের দ্য কমিটি অন পিপলস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিওপিই) টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য মণিপুর সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটি বলেছে, বাঁধটি নির্মাণ করা হলে বরাক উপত্যকা ও মণিপুরের জনগণ সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গতকাল শনিবার সংস্থাটি মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি দীর্ঘ স্মারকলিপি দিয়েছে।
সিওপিইর প্রতিনিধি পীযূষ কান্তি দাস, এস হেরাহিত সিংহ ও জিষ্ণু দত্ত বলেছেন, মণিপুর সরকার, আসাম, নিপকো বা এনএইচপিসি ভাটি এলাকার মানুষের মতামত কখনও নেয়নি এবং এই বাঁধ নির্মাণ হলে ভাটি এলাকার ওপর কী প্রভাব পড়বে সেজন্য কোনো জরিপ চালায়নি।
জিনিউজডটকম জানায়, মণিপুরের তামেংলং জেলায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত র্যালিতে শত শত মানুষ অংশ নেয়। ব্রিটিশ এমপি জর্জ গ্যালাওয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার দিকে যাওয়া শুরু করলে সীমান্ত রক্ষীবাহিনী তাদের থামিয়ে দেয়। জর্জ গ্যালাওয়ে বলেন, বরাক নদীর ওপর বাঁধ হলে ব্যাপক এলাকায় বন্যা হতে পারে।
জিনিউজডটকম আরও জানায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে টিপাইমুখ বাঁধ হলে যে প্রভাব পড়বে তা মূল্যায়ন করতে একটি বিশেষজ্ঞ বডি তৈরির পরিকল্পনা করছেন।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, টিপাইমুখে জলাধার ও বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে বিরাট এলাকার পাহাড়-জঙ্গল পানিতে ডুবে যাবে এবং অনেক লুপ্তপ্রায় প্রাণিসম্পদ ধ্বংস হবে। ঘর আর জীবিকা হারাবে বহু মানুষ। তাছাড়া টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পর সেটি ভূমিকম্পে ধসে পড়লে আসাম ও বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বিবিসি ও হাইড্রোওয়ার্ল্ডডটকম জানায়, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য মণিপুরে বরাক নদীর ওপরে টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদু্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য এনএইচপিসি, এসজেভিএন ও মণিপুর সরকার যৌথ উদ্যোগে একটি কোম্পানি গঠন করেছে।
টিপাইমুখ প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা রামানন্দ ওয়াংখেয়ি রাকপাম সাম্প্র্রতিক চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরোধিতার মূল কারণ থেকেছে স্থানীয় মানুষ বা ভাটি অঞ্চলের অর্থাৎ আসাম আর বাংলাদেশের মানুষ। এই তিন গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই প্রকল্প রূপায়ণের চেষ্টা হচ্ছিল। সেগুলো না করেই আবারও নতুন চুক্তি সই করার মধ্যে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিরোধিতার জায়গাগুলোতে সমাধানের কোনো চেষ্টাই করল না সরকার। তবে আসামের কাছাড় অঞ্চলের অনেক মানুষ আবার প্রতিবছরের বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণকে সমর্থনও করে।
জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগম বলেছে, টিপাইমুখ প্রকল্পটির সাহায্যে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে বরাক নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। ওই প্রকল্পে ১৬২ মিটার উঁচু বাঁধ থাকবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ছয়টি ইউনিট থাকবে, যার প্রতিটির ক্ষমতা হবে ২৫০ মেগাওয়াট করে। যে সরকারি সংস্থাটি অনেকদিন ধরে টিপাইমুখ প্রকল্পের দায়িত্বে ছিল সেই নিপকোর হাত থেকে ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়ে নেয় ভারত সরকার। সে সময় ভারত আর বাংলাদেশে টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপক বিরোধিতা শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল টিপাইমুখ সরেজমিনে ঘুরে দেখার জন্য ভারতে গিয়েছিল। তবে খারাপ আবহাওয়ার জন্য দু'দিন চেষ্টা করেও তাদের হেলিকপ্টার টিপাইমুখে নামতে পারেনি।
আহসান সমকালকে বলেছেন, 'ঢাকা নয়াদিলি্লর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করছে। নয়াদিলি্লতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশের ক্ষতি হবে এমন কিছু করবেন না বলে একাধিকবার আশ্বস্ত করেছেন।'
ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতের এনএইচপিসি ও এসজেভিএনের মধ্যে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সই হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর এ বিষয়ে একটি চুক্তি সই হয়।
মণিপুর সরকার এবং প্রকল্পের অন্যতম অংশীদারের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি শুক্রবার এ খবর জানিয়েছে। আর হাইড্রোওয়ার্ল্ডডটকম নামে একটি ওয়েবসাইট বলেছে, গত ২২ অক্টোবর সই হওয়া যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পে জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগমের (এনএইচপিসি) ৬৯, রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ সংস্থার (এসজেভিএন) ২৬ এবং রাজ্য সরকারের পাঁচ ভাগ মালিকানা থাকবে। চুক্তি সই অনুষ্ঠানে ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী ও মণিপুর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে টেলিফোনে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার সমকালকে বলেন, 'এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে ভারতকে বাধা দেওয়ার অধিকার বাংলাদেশের নেই। তবে ভারত যা করতে যাচ্ছে এর ফলে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘি্নত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবেন।'
প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০১০ সালে নয়াদিলি্ল এবং ২০১১ সালে ঢাকায় যখন বৈঠক করেন তখন বরাক নদীতে বাঁধ নির্মাণের ইস্যু স্থান পায়। সেসব বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আস্থার সঙ্গে বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে তার দেশ এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। তবে তিনি এটাও বলেননি যে, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করবে না। এ অবস্থায় দু'দেশের প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে।
মাহবুবুর রহমান তালুকদার বলেন, বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘ সালিশ আদালতে গেছে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনে উপযুক্ত আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ও ভারতে প্রতিক্রিয়া-বিক্ষোভ : টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ায় বাংলাদেশ ও খোদ ভারতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশকে না জানিয়ে ভারত টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিনিয়োগ চুক্তি সই করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং কূটনীতিকরা। তারা দ্রুত বাংলাদেশকে কঠোর অবস্থান গ্রহণের দাবি জানান।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ সমকালকে বলেন, অনেক আগে থেকেই দেশের সচেতন নাগরিকরা ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু সরকার এ বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে ভারতের সঙ্গে তাদের ইতিবাচক আলোচনার কথা জানায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, আমাদের উদ্বেগই সত্যিই হয়েছে। ভারত ওই প্রকল্পের চুক্তি সই করার আগে বাংলাদেশের ক্ষতি নিয়ে কোনো কিছুই ভাবেনি। এখন সরকারের উচিত কঠোর অবস্থানে যাওয়া। এ ব্যাপারে ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ বলেন, একবার বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল হেলিকপ্টার নিয়ে টিপাইমুখ ঘুরে এসে বলল, ভারত বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে না। কিন্তু বাস্তবে তাদের বক্তব্যের বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশের উচিত এ ব্যাপারে ভারতের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া।
বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক কূটনীতিক ফারুক সোবহান বলেন, সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে একটা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করা। সেখানে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের রেখে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাগাল্যান্ডের দ্য মুরাং এক্সপ্রেস জানায়, আসামের দ্য কমিটি অন পিপলস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিওপিই) টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য মণিপুর সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটি বলেছে, বাঁধটি নির্মাণ করা হলে বরাক উপত্যকা ও মণিপুরের জনগণ সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গতকাল শনিবার সংস্থাটি মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি দীর্ঘ স্মারকলিপি দিয়েছে।
সিওপিইর প্রতিনিধি পীযূষ কান্তি দাস, এস হেরাহিত সিংহ ও জিষ্ণু দত্ত বলেছেন, মণিপুর সরকার, আসাম, নিপকো বা এনএইচপিসি ভাটি এলাকার মানুষের মতামত কখনও নেয়নি এবং এই বাঁধ নির্মাণ হলে ভাটি এলাকার ওপর কী প্রভাব পড়বে সেজন্য কোনো জরিপ চালায়নি।
জিনিউজডটকম জানায়, মণিপুরের তামেংলং জেলায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত র্যালিতে শত শত মানুষ অংশ নেয়। ব্রিটিশ এমপি জর্জ গ্যালাওয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার দিকে যাওয়া শুরু করলে সীমান্ত রক্ষীবাহিনী তাদের থামিয়ে দেয়। জর্জ গ্যালাওয়ে বলেন, বরাক নদীর ওপর বাঁধ হলে ব্যাপক এলাকায় বন্যা হতে পারে।
জিনিউজডটকম আরও জানায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে টিপাইমুখ বাঁধ হলে যে প্রভাব পড়বে তা মূল্যায়ন করতে একটি বিশেষজ্ঞ বডি তৈরির পরিকল্পনা করছেন।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, টিপাইমুখে জলাধার ও বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে বিরাট এলাকার পাহাড়-জঙ্গল পানিতে ডুবে যাবে এবং অনেক লুপ্তপ্রায় প্রাণিসম্পদ ধ্বংস হবে। ঘর আর জীবিকা হারাবে বহু মানুষ। তাছাড়া টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পর সেটি ভূমিকম্পে ধসে পড়লে আসাম ও বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বিবিসি ও হাইড্রোওয়ার্ল্ডডটকম জানায়, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য মণিপুরে বরাক নদীর ওপরে টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদু্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য এনএইচপিসি, এসজেভিএন ও মণিপুর সরকার যৌথ উদ্যোগে একটি কোম্পানি গঠন করেছে।
টিপাইমুখ প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা রামানন্দ ওয়াংখেয়ি রাকপাম সাম্প্র্রতিক চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরোধিতার মূল কারণ থেকেছে স্থানীয় মানুষ বা ভাটি অঞ্চলের অর্থাৎ আসাম আর বাংলাদেশের মানুষ। এই তিন গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই প্রকল্প রূপায়ণের চেষ্টা হচ্ছিল। সেগুলো না করেই আবারও নতুন চুক্তি সই করার মধ্যে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিরোধিতার জায়গাগুলোতে সমাধানের কোনো চেষ্টাই করল না সরকার। তবে আসামের কাছাড় অঞ্চলের অনেক মানুষ আবার প্রতিবছরের বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণকে সমর্থনও করে।
জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগম বলেছে, টিপাইমুখ প্রকল্পটির সাহায্যে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে বরাক নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। ওই প্রকল্পে ১৬২ মিটার উঁচু বাঁধ থাকবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ছয়টি ইউনিট থাকবে, যার প্রতিটির ক্ষমতা হবে ২৫০ মেগাওয়াট করে। যে সরকারি সংস্থাটি অনেকদিন ধরে টিপাইমুখ প্রকল্পের দায়িত্বে ছিল সেই নিপকোর হাত থেকে ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়ে নেয় ভারত সরকার। সে সময় ভারত আর বাংলাদেশে টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপক বিরোধিতা শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল টিপাইমুখ সরেজমিনে ঘুরে দেখার জন্য ভারতে গিয়েছিল। তবে খারাপ আবহাওয়ার জন্য দু'দিন চেষ্টা করেও তাদের হেলিকপ্টার টিপাইমুখে নামতে পারেনি।
No comments