স্মৃতিচারণ-একাত্তরে বাঙালিদের মধ্যে দেখেছিলাম অমিত তেজ by বিশ্বজিৎ পাল বাবু

কাত্তরে মিত্র বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়নের সহায়তায় দারুণ এক রণকৌশল আর শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের মুকুন্দপুর। ৪০ বছর পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার দিনটিতে গতকাল শনিবার মুক্তিযোদ্ধারা মুকুন্দপুরে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে ফিরে গিয়েছিলেন লড়াইয়ের দিনগুলোতে। ভারতীয় দুই সেনা কর্মকর্তা অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসে খুঁজে ফিরছিলেন


স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো। তাঁরা বলেছেন, মুকুন্দপুরের যুদ্ধ তাঁদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
ভারতের ১৮ রাজপুত ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে মুকুন্দপুর যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখেন সে সময়ের লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং পরে মেজর জেনারেল পদ থেকে অবসরগ্রহণকারী অশোক কল্যাণ ভর্মা। মুকুন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'কেউ কাউকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করলে তখন তাকে রক্ষা করতে পারাটাই আসল কাজ। তখন বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছিল। আমরা এগিয়ে আসতে পেরে খুবই খুশি হই। আজ এ মঞ্চে দাঁড়াতে পেরেছি, কারণ সবার সহযোগিতায় বাংলাদেশকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। ৪০ বছর পর বাংলাদেশের মানুষ আমাদের যে স্মরণ করেছে তাতে আমরা খুশি।' তিনি বলেন, 'যুদ্ধের সময় বাঙালিদের মাঝে যে অমিত তেজ দেখেছিলাম তা আজও আছে বলে মনে হচ্ছে।'
হিন্দি ভাষায় অশোক ভর্মা আরো বলেন, 'মুকুন্দপুরের কথা শুনলেই আবেগতাড়িত হই। মুকুন্দপুরের যুদ্ধ আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। এরপর থেকে প্রতিটি সম্মুখযুদ্ধেই আমরা জয়ী হই। আমি বলতে চাই, জন্ম ও কর্মভূমিকে ভুলতে নেই। আমিও বাংলাদেশকে ভুলিনি।'
মিত্র বাহিনীর আরেক সদস্য ব্রিগেডিয়ার (অব.) অভিন চন্দ্র চোপড়া (যুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট) সমবেত লোকদের উদ্দেশে বলেন, 'যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে আপনাদের কথা শুনে মনে খুব কষ্ট হতো। উদগ্রীব ছিলাম কখন আপনাদের সাহায্য করতে পারব। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আপনাদের সাহায্য করতে পেরে আমরা দারুণ খুশি হই। এ সুযোগ না পেলে অনেক কষ্ট পেতাম। আপনাদের সবার সহযোগিতায় একসময় বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হয়। আজ ৪০ বছর পর যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে আসতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। আপনারা আমাদের স্মরণ করায় আমরাও দারুণ খুশি।'
মুকুন্দপুরের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কম্পানিকে নেতৃত্ব দেওয়া মেজর জেনারেল (অব.) সায়ীদ যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে বলেন, 'অশোক ভর্মা ও অভিন চোপড়া ছিলেন মুকুন্দপুর যুদ্ধের অগ্রনায়ক। অনেক ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা শত্রু বাহিনীকে মোকাবিলা করেছেন। আমাদের তাঁরা সাহস জুগিয়েছেন।'
দুপুর ১২টার দিকে কোরআন তেলাওয়াত ও গীতা পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর মুকুন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে বাজে জাতীয় সংগীত। স্কুলের শিক্ষার্থীরা অতিথিদের বরণ করে নেয়। মিত্র বাহিনীর দুই সদস্যের স্ত্রীকেও ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে মঞ্চে আহ্বান করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। তিনি বলেন, 'ভারত আমাদের সহযোগিতা না করলে আমরা যুদ্ধে কোনোভাবেই সফল হতাম না। প্রতিবেশীদের ছাড়া কেউ যুদ্ধে জিততে পেরেছে, এমন নজির কোথাও নেই।'
মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ বলেন, 'যুদ্ধে জয় বাংলা ছিল আমাদের প্রধান অস্ত্র। সবাই মিলে জয় বাংলা বললে পাকিস্তানিরা পালানোর পথ খুঁজত। আমরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।'
মেজর জেনারেল (অব.) সায়ীদ মুকুন্দপুর যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া ৩২ জন বীর সেনানীকে মঞ্চে ডেকে আনেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নারী মুক্তিযোদ্ধা সায়েরা। বাবা আবদুল আজিজ রাজাকার হওয়া সত্ত্বেও সায়েরা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। সায়ীদ বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি নিয়ে প্রহসন শুরু হয়েছে। আমি চাই সরকার আমাদের এ লজ্জা থেকে মুক্তি দেবেন।' তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা, মুকুন্দপুর যুদ্ধস্থলে স্মৃতিসৌধ ও বিদ্যালয়ে একটি পাঠাগার নির্মাণের দাবি জানান।
এ ছাড়া অনুষ্ঠানের আয়োজক ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক খান বীরপ্রতীক এবং জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
অতিথিরাসহ মুক্তিযোদ্ধারা পরে যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখেন এবং সেদিনের সাফল্য নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠেন।

No comments

Powered by Blogger.