কিলিং মিশনের ৩ জন গ্রেফতার by পিনাকি দাসগুপ্ত

রসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে হত্যায় সরাসরি জড়িত মাহফুজ ওরফে সবুজ ও শাহিনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শুক্রবার গভীর রাতে নরসিংদীর মাধবদী থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এদিকে বুধবার ঢাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া যুবদলের সাবেক নেতা হাজি ফারুকের গ্রেফতারের বিষয়টি পুলিশ গতকাল শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে।


তিনি যুবদল নেতা আশরাফ হোসেন সরকারের দেওয়া টাকায় সাত কিলারকে ভাড়া করেন। এদিকে হত্যাকাণ্ডে একটি মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস ব্যবহার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার পরিকল্পনা, এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও হত্যায় অর্থায়নকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। তাদের তথ্যমতে, ঘটনার দিন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন
হত্যার পরিকল্পনার কথা জানতেন। ফলে লোকমানের এক বন্ধু ছাড়া আর কেউই হত্যাকারীদের আটকের চেষ্টা করেননি। লোকমান হত্যাকাণ্ডে গতকাল শনিবার পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি যুবলীগ নেতা আশরাফসহ ছয়জন। হাজি ফারুক, মাহফুজ ও শাহিনকে আজ রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে নরসিংদী আদালতে হাজির করবে পুলিশ।
সূত্র জানায়, নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদার ও পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জান্নাতুল ফেরদৌসের নেতৃত্বে একটি দল শুক্রবার ভোররাতে সদর উপজেলার মাধবদীর আলগী এলাকার একটি সুতা কারখানা থেকে মাহফুজ ওরফে সবুজকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেওয়া তথ্যমতে একই এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় শাহিনকে। মাহফুজ ও শাহিন পেশাদার কিলার। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সবুজের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা এলাকায়। শাহিনের বাড়ি মাধবদীতে। অন্যদিকে হাজি সেলিমের বাড়ি পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। তিনি ওয়ারী এলাকার যুবদলের সাবেক নেতা। পুরান ঢাকায় বুলবুল প্রিন্টার্স নামে তার একটি ছাপাখানা আছে। হাজি ফারুকের বাবা একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন সমকালকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
লোকমান হত্যায় মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে আগাম কিছু বলা সম্ভব নয়।
গ্রেফতার প্রসঙ্গ : হাজি ফারুককে চারদিন আগে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশ তার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যায়। তবে নরসিংদী পুলিশের এক কর্মকর্তা গ্রেফতার হওয়ার পর জানান, বড়মাপের একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার নাম জানাজানি হলে অন্য কিলাররা পালিয়ে যাবে। তার দেওয়া তথ্যমতেই শুক্রবার রাতে সবুজ ও শাহিনকে গ্রেফতার করা হয়। গতকাল দিনভর পুলিশ তাদের গ্রেফতারের বিষয়টি গোপন রাখে। বিকেলে আইজিপি তার বাসায় উপস্থিত সাংবাদিকদের এ প্রসঙ্গে বলেন, লোকমান হত্যায় জড়িত একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তখন তিনি নাম বলেননি। এরপর সন্ধ্যায় নরসিংদীর পুলিশ সুপার তিনজনের গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
যেভাবে হত্যার পরিকল্পনা : মামলার তদন্ত সূত্র জানায়, পৌর মেয়র লোকমানকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় এক বছর আগে। এ জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় নরসিংদী শহর যুবলীগ সভাপতি আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুলকে। পুরান ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়ি হওয়ার সুবাদে রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। ওয়ারী এলাকার যুবদলের সাবেক স্থানীয় নেতা হাজি ফারুকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। হাজি ফারুকের কাজ ছিল কিলার ভাড়া করে দেওয়া।
লোকমানকে হত্যার পরিকল্পনার পর আশরাফ তাকে প্রথম দফায় ১৫ লাখ টাকা দেন; কিন্তু এ টাকা পরিশোধ করার পরও হাজি ফারুক গড়িমসি করে অনেকদিন কাটিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত বলেন, এ টাকায় ভালো কিলার গ্রুপ ভাড়া করা সম্ভব নয়। আরও টাকা প্রয়োজন। এ অবস্থায় আশরাফ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মোবারক হোসেন মোবা, নরসিংদী শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শিল্পপতি তারেক আহমদসহ কয়েকজনের কাছ থেকে মোটা টাকা সংগ্রহ করেন। এ টাকা থেকে ২০ লাখ টাকা হত্যাকাণ্ডের ১৫ দিন আগে আশরাফ হোসেন তুলে দেন হাজি ফারুকের হাতে। হাজি ফারুকের পুরান ঢাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই টাকা লেনদেন হয়। ফারুক টাকা পাওয়ার পরই মাহফুজ, শাহিনসহ সাত কিলারকে ভাড়া করেন। তবে মাহফুজের নাম জানার পর আশরাফ কিছুটা আপত্তি করেছিলেন। কারণ মাহফুজকে তিনি আগে থেকে জানতেন। তার ওপর নির্ভর করতে পারছিলেন না। তবে হাজি ফারুক তাকে আশ্বস্ত করেন। এরপরই হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হত্যার দিন একটি মাইক্রোবাস ও একটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করে কিলাররা ঘটনাস্থলে যায়। হত্যাকাণ্ডের পর কিলাররা অস্ত্র তাক করে মাইক্রোবাসে করেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
মোটরসাইকেল ফেলে যাওয়া : হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া পলাতক চার কিলারের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। গ্রেফতারকৃত টিপ্পন, সবুজ ও শাহিনসহ ছয়জন ঘটনাস্থলের আশপাশে অবস্থান নেয়। একই মুখোশ পরে লোকমানকে গুলি করে। বৈঠকে উপস্থিতদের মধ্যে অনেকেই বিষয়টি জানতেন। ফলে কিলাররা নিশ্চিত ছিল গুলি করার পর কেউ প্রতিরোধ করবেন না।
জিজ্ঞাসাবাদে টিপ্পন জানান, মোটরসাইকেলটি আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে মুখ করে রাস্তার পাশে রাখা ছিল; কিন্তু গুলি করে পালানোর সময় মোটরসাইকেল বিপরীত দিকে ঘোরানো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণেই তারা সেটি ফেলে যায়। মোটরসাইকেলে করে মূল শুটার ঘটনাস্থলে যায়। এর বেশ কিছু দূরে ছিল সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস।
সূত্র জানায়, জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে ঢুকে তিন-চার গজ দূর থেকে লোকমানকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ অফিসে উপস্থিত ১৪ জনের মধ্যে লোকমানের বন্ধু শ্যামল কিলারকে লক্ষ্য করে চেয়ার ছুড়ে মারে। কিন্তু চেয়ার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এরপর আবারও কিলার লোকমানকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। তবে শ্যামল ছাড়া কেউ কিলারদের পিছু ধাওয়া করেননি। অন্যরা যে যার মতো ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
বাচ্চু বিষয়টি জানতেন : লোকমান হত্যার পরিকল্পনার কথা জানতেন মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন বাচ্চু। তার কাছ থেকে প্রশাসনিক সহায়তা নেওয়ার জন্য মোবারক হোসেন মোবা মোবাইল ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তবে হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে তারা যোগাযোগ বন্ধ রাখেন। দেড় মাস পর ২৬ অক্টোবর তাদের ফোনে কথোপকথন হয়। এর পরদিনই মোবা মালয়েশিয়ায় চলে যান। মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে পুরো বিষয় জানলেও নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখতে বাচ্চু সবসময় ঘটনাপ্রবাহ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন।
অভিযানে দুই টিম : সবুজকে গ্রেফতার করতে গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম মাধবদীর মনোহরপুর আলগী এলাকায় অভিযানে যায়। একই সময় সেখানে পেঁৗছে নরসিংদী জেলা পুলিশের একটি টিম। এ অবস্থায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ভোররাতে নরসিংদী পুলিশকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফেরে।
রিমান্ডে আসামি : লোকমান হত্যা মামলায় তিনজন পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। তারা হলেন_ আশরাফ হোসেন সরকার, টিপ্পন ও হাজি সেলিম।
বিচারের দাবিতে সভা : নরসিংদী প্রতিনিধি প্রীতিরঞ্জন সাহা জানান, লোকমান হোসেন হত্যা মামলার বিচারের দাবিতে গতকাল নরসিংদী সদর উপজেলা পরিষদ এলাকায় মহল্লাবাসীর আয়োজনে এক সভা হয়। নরসিংদী আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নরসিংদী সদর আসনের সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হীরু বীরপ্রতীক। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার শওকত আলী, জিএম তালেব হোসেন, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান সাজু, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আলহাজ সফিকুল ইসলাম সফিক, লোকমান হত্যা মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল, লোকমানের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি শামীম নেওয়াজ প্রমুখ।
লোকমান হত্যার বিচার দাবি ঢাবি উপাচার্যের : লোকমান হত্যাকা ের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর তোপখানা রোডের বিএমএ ভবন মিলনায়তনে 'নরসিংদী জেলা ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন' আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান। তিনি বলেন, নরসিংদী জেলার একজন সন্তান হিসেবে আমার নিজ জেলা এ ধরনের ঘটনার শিরোনাম হোক, এটা আমি চাই না। আবেগতাড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটবে, এর কারণ কী? শুধু নরসিংদী নয়, দেশের কোথাও যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.