পদ্মা সেতু প্রকল্প-মালয়েশিয়ার প্রস্তাব কঠিন ভরসা দেশীয় অর্থায়ন by পার্থ সারথি দাস

পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক আর ফিরছে না। বিশ্বব্যাংক না ফিরলে এডিবি-জাইকাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। গত সোমবার মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে তাদের চূড়ান্ত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত হারে টোল আদায়সহ বিভিন্ন কঠিন শর্ত-সংবলিত এই প্রস্তাবের গ্রহণযোগ্যতা শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।


এ অবস্থায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকারের এখন দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরু করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মালয়েশিয়ার পথ কঠিন : দক্ষতা, তহবিল সংগ্রহ, মুনাফা, যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক সুবিধা, সেতু নির্মাণের পরিচালনাকাল ও টোলের হার নির্ধারণ- এসব বিষয়ের নিরিখে মালয়েশিয়ার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া কোথা থেকে ও কিভাবে তহবিল জোগাড় করবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। সে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদের হার হবে কমপক্ষে পাঁচ থেকে আট শতাংশ। ঋণের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে মালয়েশিয়া তার চেয়ে বেশি মুনাফা উঠাতে চাইবে। আর বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে মাত্র দশমিক ৭৫ শতাংশ হার সুদে ঋণ দিতে চুক্তি করেছিল। পরিশোধের সময় ছিল ৪০ বছর। এর মধ্যে ১০ বছর ছিল গ্রেস পিরিয়ড। মালয়েশিয়ার অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন, তাই আর্থিক দিক দিয়ে তা লাভজনক হবে না বলে অনেক অর্থনীতিবিদ মত দিয়েছেন।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিল্ট অপারেট অন অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওওটি) পদ্ধতিতে মালয়েশিয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এ পদ্ধতিতে প্রকল্পে বিনিয়োগ ছাড়াও সেতু নির্মাণ ও পরে এটি থেকে টোল আদায়ের মাধ্যমে অর্থ তুলে নেওয়া হবে। সেতু নির্মাণের পর টানা ৩৫ বছর সেতুটি পরিচালনা করার শর্ত দিয়েছে মালয়েশিয়া। আর সেতু নির্মাণে সময় নেবে ৩২ মাস।
সেতু নির্মাণের পর অর্থ তোলা হবে সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী গাড়ি থেকে। কিন্তু মালয়েশিয়ার প্রস্তাবে টোলের হার অস্বাভাবিক বেশি ধরা হয়েছে। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুতে মোটরসাইকেলে টোলের হার ছিল ৩০ টাকা। মালয়েশিয়ার প্রস্তাবে পদ্মা সেতুতে তা ধরা হয়েছে ৯ ডলার বা ৭৪৭ টাকা, হালকা যানবাহনের জন্য টোলের প্রস্তাব ১৮ ডলার বা এক হাজার ৪৯৪ টাকা। এভাবে মালয়েশিয়া বিনিয়োগ তুলতে চাইছে গাড়ি থেকে টোল আদায় করেই। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা কমে গেলে সেটা হবে না। তাই মালয়েশিয়া শর্ত দিয়েছে, এই সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়- এমন কোনো সেতু বা স্থাপনা তৈরি করা যাবে না। অর্থাৎ দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণেও আপত্তি আছে মালয়েশিয়ার। প্রকল্পের নির্মাণ সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় মালামাল আমদানির ওপর করমুক্তির সুবিধাও চায় মালয়েশিয়া।
মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ১০ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দলের একজন অধ্যাপক আলমগীর মুজিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কয়েক দিন আগে এক সভায় প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক আসবে কি না বা যদি না আসে তাহলে প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন হবে, এ নিয়ে আমাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের আসা বা না আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। মালয়েশিয়ার কারিগরি দক্ষতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে চীনের দক্ষতা বেশি, সেটা কাজে লাগানো যায়। বিশ্বব্যাংক না এলে মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়।'
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কে এ এস মুরশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি দুই সপ্তাহ আগে কম্বোডিয়া থেকে এসেছি। সেখানে বিশ্বব্যাংকের করুণ দশা। কোনো রকমে একটি অফিস আছে বিশ্বব্যাংকের। সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে কম্বোডিয়া বিশ্বব্যাংকের কোনো সহায়তা নিচ্ছে না। কিন্তু চীন কম্বোডিয়াকে সহযোগিতা করছে। আমাদের দেশকে সহযোগিতা করার মতো শক্ত কোনো দেশ নেই। এ কারণেই এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে প্রস্তাব এসেছে, এটি একটি আশার কথা। এটি গ্রহণযোগ্য হলে ভালো, না হলে বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে কনসোর্টিয়াম গঠন করে দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্পকাজ আবার শুরু করা যায়।'
গত সোমবার মালয়েশিয়া পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব দেওয়ার পর গতকাল মঙ্গলবার সেতু ভবনে তা নিয়ে সকাল থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যালোচনা হয়। সেতু বিভাগের সচিব আনোয়ারুল ইসলাম বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা বিষয়ে মালয়েশিয়া মূলত গত সোমবারই পূর্ণাঙ্গ কোনো প্রস্তাব দিয়েছে। আমি এটি স্টাডি করছি। তবে দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরুর নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। সেতু ভবনে এ নিয়ে প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।'
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক সফিকুল ইসলাম গতকাল তাঁর কক্ষে সংশ্লিষ্ট তিনজন পদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়ে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের বিভিন্ন অংশ পড়েন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগে দেওয়া খণ্ড খণ্ড প্রস্তাব একত্র করে এই পুরো প্রস্তাব দিয়েছে মালয়েশিয়া। এটি দীর্ঘ ও বিস্তৃত। আমরা এটি পড়ছি। টোলের হার ও বিভিন্ন বিষয় বাস্তবসম্মত কি না, তা আমরা অবশ্যই যাচাই করে দেখব।'
প্রকল্পের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মালয়েশিয়ার প্রস্তাবটি আমি এখনো দেখিনি। দেখব। এখনই মন্তব্য করছি না।'
দেশীয় অর্থায়নের প্রস্তুতি : সেতু বিভাগের প্রকৌশলীরা বলছেন, মালয়েশিয়া যে সব শর্ত দিয়েছে, তাতে এ সেতু নির্মাণ বাস্তবসম্মত নয়। তার চেয়ে বাংলাদেশের নেতৃত্বে একটি কনসোর্টিয়াম করে দেশীয় অর্থায়নের পাশাপাশি বিদেশি অর্থে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা বাস্তবসম্মত। বিশ্বব্যাংককে ফেরানো না গেলে দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরু করতে হবে বিষয়টি মাথায় রেখে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে।
সেতু বিভাগ সূত্রে আরো জানা যায়, দেশীয় অর্থায়নের ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। পরবর্তী দুই বছরে লাগবে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা করে। শেষ বছরে দরকার হবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। গত ৯ জুন মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরুর জন্য এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সেতু বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেটা করতে এখন সেতু বিভাগ পুনঃদরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ব্যাপারে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'চলতি মাসেই পুনঃদরপত্র আহ্বান করার লক্ষ্য ছিল। আমরা অচিরেই সেটা করব। দেশীয় অর্থে কাজ শুরু করতে দরপত্র মূল্যায়নের জন্য নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকমকে চিঠি দিয়েছি। তাদের সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে হবে। আমাদের চিঠি পাওয়ার পর মনসেল চুক্তি করতে যে ব্যয় হবে তা-ও জানিয়েছে।'
জানা গেছে, দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাকযোগ্য বিবেচিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূল দরপত্রে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাবে সেতু বিভাগ। মূল সেতু ও নদী শাসনের দরপত্রের কার্যক্রম শুরু হবে প্রথম ধাপে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা সবগুলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেশীয় অর্থায়নে নির্মাণকাজে আগ্রহী না হলে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হবে।
সেতু বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকারের প্রতিশ্রুত এই প্রকল্প দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিষয়টি মাথায় রেখেই দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।'
শেষ মুহূর্তে নাটকীয়তা?

No comments

Powered by Blogger.