পাশ কাটানোর রাজনীতি গণতান্ত্রিক নয় by গাজীউল হাসান খান
ফরাসি লেখক-দার্শনিক ভলতেয়ার ছিলেন অত্যন্ত গণতন্ত্রমনা ও যুক্তিবাদী। ফরাসি বিপ্লব নিয়ে তাই রুশোর মতো তার চিন্তা-চেতনায় একমুখী ভাবাবেগ ছিল না। তিনি নানা বিষয়ে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। তাই ভলতেয়ার ভিন্ন মতাবলম্বী কোনো মানুষকে নির্দ্বিধায় বলতে পারতেন, ‘তোমার বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই; কিন্তু তোমার বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন হলে আমি জীবন দেব।’
মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি এখন থেকে প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে অর্থাত্ বাস্তিল আক্রমণের অনেক আগেও এই ছিল ভলতেয়ারের দৃষ্টিভঙ্গি। তখন তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন ফরাসি রাজতন্ত্র ও পুরোহিতদের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন, যে জনগণ নিজের অধিকার নিয়ে চিন্তা করতে শিখেছে তাকে থামানো অসম্ভব হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের শাসকগোষ্ঠী এ চরম সত্যটি উপলব্ধি করতে প্রায়ই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। এটি কোনো কায়েমি স্বার্থের কারণে কি না জানি না; নতুবা একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেও আমরা এখনও অন্যের মতপ্রকাশ কিংবা তথ্য পাওয়ার মৌলিক অধিকারের প্রতি অগণতান্ত্রিক মনোভাব ধারণ-পোষণ করি কীভাবে?
একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের একটি জাতীয় সংসদ গঠন করা হয়েছিল জন্মলগ্ন থেকেই। অথচ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অনেক জাতীয় ইস্যু নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে বিরোধীদলকে কোনো নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ না দিয়েই আইন পাস করা হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বিরোধীদলকে পাশ কাটিয়ে একতরফাভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দু’একটি চুক্তিও গৃহীত হয়েছে সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি।’ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনসংহতি সমিতির সঙ্গে এই চুক্তিটি সম্পাদন করে। এ চুক্তি নিয়ে তত্কালীন বিরোধীদল বিএনপিকে সংসদে কোনো আলাপ-আলোচনারই সুযোগ দেয়া হয়নি। একতরফাভাবে গ্রহণ করা হয়েছে এ চুক্তি। অথচ এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের পর একানব্বইতে ক্ষমতায় আসা বিএনপি সরকারই ভারতে আশ্রয় নেয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী এবং এমনকি তত্কালীন পার্বত্য শান্তি বাহিনীর গেরিলা নেতা ও যোদ্ধাদের পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্যভিত্তিক বিভিন্ন গোপন ক্যাম্প থেকে সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে বৃহত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। তখন এক প্রতিনিধিদল নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়েছিলেন বিএনপির তত্কালীন যোগাযোগমন্ত্রী অলি আহমদ। সঙ্গে ছিলেন রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেননসহ আরও কয়েকজন; কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ এবং বিশেষ করে সময়ের অভাবে বিএনপি সরকার পাহাড়িদের সঙ্গে কোনো চুক্তি সম্পাদন করে যেতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে (১৯৯৬ সালে) ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার সঙ্গে বিশেষ সখ্য গড়ে তোলে যা অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতাদের কাছে অনেকটাই ছিল গোপন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল অনেক তথ্যের ফারাক। সংখ্যায় নগণ্য হলেও সব পাহাড়ি উপজাতি বা গ্রুপকে অন্তর্ভুক্ত না করে চাকমা উপজাতিকে সামনে করে কয়েকটি উপজাতির সমষ্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার যে চুক্তি সম্পাদন করেছিল তা পরবর্তী সময়ে গঠিত ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের বাদ পড়া উপজাতির সদস্যরা বিরোধিতা করে এবং অবিলম্বে তা বাতিল করার দাবি জানায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারসহ পাহাড়ি-বাঙালির যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পাদিত অসম ও অযৌক্তিক চুক্তিরই ফল বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। অথচ বিগত কয়েকশ’ বছর ধরে সেখানে বসবাসকারী আদি বাঙালি বাসিন্দা এবং নতুনদের সেখান থেকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ এবং চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন চাকমা নেতা সন্তু লারমা। পার্বত্য উপজাতির মানুষ সারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করার অধিকার পাবে অথচ বাঙালিরা উপজাতি প্রধান অঞ্চলে বসবাস করতে পারবে না এমন দাবি তো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সংবিধানসম্মত হতে পারে না। এ চুক্তি সম্পাদন ও পরবর্তী সময়ে সংসদে গ্রহণ করার সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধীদলকে কোনো আলোচনারই সুযোগ দেয়নি। প্রশ্ন ওঠেছে, এটি কেমন গণতন্ত্র আর কেনইবা এ জাতীয় সংসদ? কার স্বার্থে এ সংসদ? যে জাতীয় সংসদ তার সার্বভৌম ভূখণ্ডের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে না। কি প্রয়োজন তার?
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্প্রতি যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, দেশ ও জনগণের স্বার্থে সেগুলোর বিভিন্ন দিক নিয়ে চুলচেরা আলোচনা কিংবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অর্থ ভারত বিরোধিতা নয়। শুধু বিরোধীদলের নেত্রী নয়, যে কোনো দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিকই স্বাক্ষরিত যে কোনো চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারকের বিভিন্ন অপ্রকাশিত দিক ও অস্পষ্টতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন তোলার অধিকার রাখেন। কারণ, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারকগুলোর ভেতরে আসলে কি লেখা রয়েছে তা জনগণ জানেন না। সুতরাং জনস্বার্থেই সেগুলো প্রকাশ করা উচিত। তাছাড়া আমাদের দেশে তো সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনও গৃহীত হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু কিছু দীর্ঘস্থায়ী, জটিল ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর সমস্যা রয়েছে যার অবসান ঘটানো দু’দেশের মধ্যে সত্-প্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য আবশ্যক। তাতে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের ভুক্তভোগী মানুষের বিদ্বেষ ও বৈরিতা যদি কিছু থেকেও থাকে, তা ক্রমেই দূর হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সমুদ্রসীমা ও সীমান্ত নির্ধারণ থেকে শুরু করে বাণিজ্য ক্ষেত্রে পর্যন্ত অনেক সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা ও সীমান্ত নিয়ে বিরোধ যেমন নতুন নয়, তেমনি অসম বাণিজ্যের বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তদুপরি বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরে ভারতের টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ প্রকল্প, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলি করে হত্যা করার মতোই স্পর্শকাতর বিষয়। ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সুতরাং টিপাইমুখ তাদের শেষ পর্যন্ত কী উপহার দেবে তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় ভারত এমনকিছু করবে না। বাংলাদেশের ভূমিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন প্রকল্প থেকে দূরে থাকা হবে। কিন্তু আসলে কি তাই? ভারতের আসাম, মেঘালয় ও মনিপুর রাজ্যের পরিবেশবাদীরা পাঁচ বছর আগেই এ ব্যাপারে ঢাকায় আয়োজিত সেমিনারে এসে এর সম্ভাব্য কুফল সম্পর্কে বাংলাদেশীদেরকে বার বার হুশিয়ার করে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও আন্তর্জাতিক ফারাক্কা আন্দোলন আয়োজিত কয়েকটি সেমিনারে তারা বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধ কিংবা জলবিদ্যুত্ প্রকল্প তারা চান না। কারণ এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তাদের পরিবেশ ও ভূ-প্রকৃতির সর্বনাশ ঘটবে। ১৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন টিপাইমুখ পানি-বিদ্যুত্ কেন্দ্রটির জন্য প্রয়োজন হবে এক বিশাল বাঁধ এবং জলাধার, কারণ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন হবে বরাকের প্রচুর পানি। অভিন্ন নদী বরাকের ওপর বাঁধ নির্মাণ ও জলাধারে বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য পানি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে তার শাখা নদী সুরমা ও কুশিয়ারার স্বাভাবিক প্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে শুধু সুরমা ও কুশিয়ারা নয় প্রমত্তা মেঘনাও স্রোতহীন এবং নিস্তেজ হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাতে পরিবেশ, ভূ-প্রকৃতি ও জীব-বৈচিত্র্যসহ কৃষির জন্য শীত মৌসুমে সেচের পানি এবং নৌ-পরিবহন বন্ধ হতে পারে। তাছাড়া প্রস্তাবিত জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশে মারাত্মক ভূকম্পনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা বৃদ্ধি করতে পারে। এগুলো ভারতীয় ভূতত্ত্ববিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কথা। অথচ ভারত সরকার বলছে, বাংলাদেশের ভূমিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন প্রকল্প থেকে তারা দূরে থাকবে। আর কোপেনহেগেনের মতো ‘আবহাওয়া পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধ’ সংক্রান্ত সম্মেলন থেকে ফিরে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও সেই একই কথা এখনও বলে চলেছেন। বাংলাদেশের মানুষ শুধু অবাক বিস্ময়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর ভাবেন, তারা একটি কথা কেন ভারতকে স্পষ্ট করে বলতে পারেন না যে, আপনারা এ প্রকল্প বাদ দিন। আমরা ফারাক্কার প্রতিক্রিয়া প্রতিনিয়তই উপলব্ধি করছি। আর নতুন কোনো সর্বনাশ দেখতে চাই না। গঙ্গার পানির হিস্যার মতো অভিন্ন নদী তিস্তার পানি আদায় করতে আরও কত সময় পেরিয়ে যাবে কে জানে? আমাদের প্রধানমন্ত্রী সে ব্যাপারে কতদূর অগ্রসর হতে পেরেছেন তারও আমরা কিছুই স্পষ্ট করে জানতে পারিনি। যে কোনো দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানেই ভারতের দীর্ঘসূত্রতা বাংলাদেশের মানুষকে হতাশ ও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ অভিজ্ঞতা আমাদের দীর্ঘ ৩৮ বছরে সঞ্চিত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর আজও ভারতের সঙ্গে আমাদের মাত্র সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমানার বিরোধ নিষ্পত্তি হলো না। অগ্রিম বেরুবাড়ী হস্তান্তর করেও আঙ্গরপোতা এবং দহগ্রামের মতো ছিটমহলের মানুষকে এখনও পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুদর্শা। সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভারতীয় বিএসএফের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ, বাঙ্কার নির্মাণ, তাদের সহযোগিতায় ভারতীয় নাগরিকদের মাছ ধরে নিয়ে যাওয়া, এসব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন অথবা তার ভারত সরফরকালে কী আলোচনা করে এসেছেন, তার কোনো জবাব দিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী। অথচ সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশীদেরকে ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে পাখির মতো প্রাণ হারাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এগুলো সবই কি ভারত বিদ্বেষের কারণে?
উপরে উল্লিখিত আচরণের ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক কারণেই ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর, স্থলপথ ও রেলপথ ব্যবহার করতে দেয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং অস্ত্রশস্ত্র পারাপারসহ বিভিন্ন সংঘর্ষমূলক কার্যকলাপের নিরিখে ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর, স্থলপথ ও রেলপথসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে দিয়ে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত আবার কী বিপদে পড়ে সেটিই এ দেশের মানুষের আশঙ্কা এবং সে উদ্বেগ বা আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়। কারণ এসব ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতকে কী কী শর্ত দিয়েছেন জনগণ তা জানেন না। তাছাড়া ভারতই বা আমাদেরকে নিরাপত্তার ব্যাপারে কী কী নিশ্চয়তা দিয়েছে তাও আমরা কিছুই জানতে পারিনি। এটি শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, একটি অনৈতিক এবং অন্যায্য বিষয়ও বটে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ নিয়ে লুকোচুরি খেলার সর্বৈব অধিকার কোনো সরকারকে একটি দেশের জনগণ দিতে পারেন না। দলমত ও ধর্মবর্ণনির্বিশেষে এ কথাটি প্রযোজ্য। অর্থ পাওয়া যাবে বলে তো দেশ বিক্রি করে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশকে প্রতিবেশী ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও চীনের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কিংবা সমৃদ্ধির প্রশ্নে কোনো নাগরিকের তাতে কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। তবে জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সার্বিক উন্নয়নের কথাটিও এখানে মাথায় রাখা আবশ্যক। প্রতিবেশী অন্যান্য দেশকে বাদ দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের নামে যেমন শুধু ভারতকে করিডোর দেয়া যাবে না, তেমনি ভারতের মতো বিশাল প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে অন্যান্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করাও ন্যায়সঙ্গত হবে না।
ভারত শুধু আমাদের নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, আমরা তিন দিক থেকে তার দ্বারা বেষ্টিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ছাড়াও তার সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত কারণে সম্পৃক্ততা অনেক। তাই স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ভারতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে আমরা হয়তো কিছুটা আশাহত হয়েছি। তাকে বিদ্বেষ বলা যায় না, হয়তো কেউ কেউ বলবেন এটা বিমুখিতা। অনেকের কাছে তার অনেক রকম কারণ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকতে পারে। বাংলাদেশে বেশকিছু মানুষ রয়েছেন, যারা মনে করেন ভারতের দেহটি বিরাট, সে তুলনায় মনটি তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাছাড়া কেউ কেউ মনে করেন ভারত আধিপত্যবাদী। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করার পরিবর্তে তাদেরকে সব সময় দাবিয়ে রাখতে চায়।
একথা ঠিক যে, ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সমঝোতা সৃষ্টি হয়েছিল। তাই দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হলে ভারতের কাছ থেকে, বিশেষ করে কংগ্রেস দলের (ক্ষমতায় থাকলে) কাছ থেকে, অনেক কঠিন কাজও আদায় করে আনতে পারবেন, যা অন্যদের জন্য এতটা সহজ হয় না। বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতের সঙ্গে সব সমস্যার সমাধান করে একটি সত্ প্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়নি, তা নয়; কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক গঠন এবং এমনকি সাফটা চুক্তি স্বাক্ষর করেও অনেক সমস্যার সমাধান হয়নি। সবকিছুই ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। তাতে বিশাল দেশ ও বড় অর্থনীতির অধিকারী ভারতের কিছুই যায় আসে না; কিন্তু ভাটি অঞ্চলের ছোট্ট উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বাংলাদেশের অনেক সমস্যা ঘনিয়ে আসে এবং তখনই জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভারতের সদিচ্ছা সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তি, আস্থার অভাব ও বিক্ষোভ। ভারত সফর শেষে বাংলাদেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, অন্যরা বলেন, ভারত দ্বিপাক্ষিক বিষয় ছাড়া আর কোনো কিছু নিয়েই আলোচনা করতে চায় না; কিন্তু আমি তো নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে যাতায়াত সুবিধার মতো বহুপাক্ষিক বিষয়েও ভারতকে সম্মত করিয়েছি। এটি দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে উপমহাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক বিরাট অবদান রাখবে বলে তিনি দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। এ বিষয়টি নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারও আন্তরিকভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিল, যা অস্বীকার করা যাবে না। তাছাড়া দু’দেশের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে যেমন বিগত সরকারগুলো দীর্ঘদিন ভারতের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে, তেমনি নৌ ও রেলপথে ভারতের পণ্যসামগ্রী পরিবহনের জন্য ট্রানজিট প্রদানেও সম্মত হয়েছিল। সে অনুসৃত নীতিতেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ঢাকার সঙ্গে বাস সার্ভিস চালু হয়েছিল এবং পরে ঢাকা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছিল। সেগুলো কি বিগত সরকারের ভারতবিদ্বেষ কিংবা বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ?
সম্প্রতি স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক নিয়
একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের একটি জাতীয় সংসদ গঠন করা হয়েছিল জন্মলগ্ন থেকেই। অথচ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অনেক জাতীয় ইস্যু নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে বিরোধীদলকে কোনো নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ না দিয়েই আইন পাস করা হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বিরোধীদলকে পাশ কাটিয়ে একতরফাভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দু’একটি চুক্তিও গৃহীত হয়েছে সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি।’ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনসংহতি সমিতির সঙ্গে এই চুক্তিটি সম্পাদন করে। এ চুক্তি নিয়ে তত্কালীন বিরোধীদল বিএনপিকে সংসদে কোনো আলাপ-আলোচনারই সুযোগ দেয়া হয়নি। একতরফাভাবে গ্রহণ করা হয়েছে এ চুক্তি। অথচ এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের পর একানব্বইতে ক্ষমতায় আসা বিএনপি সরকারই ভারতে আশ্রয় নেয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী এবং এমনকি তত্কালীন পার্বত্য শান্তি বাহিনীর গেরিলা নেতা ও যোদ্ধাদের পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্যভিত্তিক বিভিন্ন গোপন ক্যাম্প থেকে সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে বৃহত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। তখন এক প্রতিনিধিদল নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়েছিলেন বিএনপির তত্কালীন যোগাযোগমন্ত্রী অলি আহমদ। সঙ্গে ছিলেন রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেননসহ আরও কয়েকজন; কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ এবং বিশেষ করে সময়ের অভাবে বিএনপি সরকার পাহাড়িদের সঙ্গে কোনো চুক্তি সম্পাদন করে যেতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে (১৯৯৬ সালে) ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার সঙ্গে বিশেষ সখ্য গড়ে তোলে যা অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতাদের কাছে অনেকটাই ছিল গোপন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল অনেক তথ্যের ফারাক। সংখ্যায় নগণ্য হলেও সব পাহাড়ি উপজাতি বা গ্রুপকে অন্তর্ভুক্ত না করে চাকমা উপজাতিকে সামনে করে কয়েকটি উপজাতির সমষ্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার যে চুক্তি সম্পাদন করেছিল তা পরবর্তী সময়ে গঠিত ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের বাদ পড়া উপজাতির সদস্যরা বিরোধিতা করে এবং অবিলম্বে তা বাতিল করার দাবি জানায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারসহ পাহাড়ি-বাঙালির যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পাদিত অসম ও অযৌক্তিক চুক্তিরই ফল বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। অথচ বিগত কয়েকশ’ বছর ধরে সেখানে বসবাসকারী আদি বাঙালি বাসিন্দা এবং নতুনদের সেখান থেকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ এবং চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন চাকমা নেতা সন্তু লারমা। পার্বত্য উপজাতির মানুষ সারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করার অধিকার পাবে অথচ বাঙালিরা উপজাতি প্রধান অঞ্চলে বসবাস করতে পারবে না এমন দাবি তো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সংবিধানসম্মত হতে পারে না। এ চুক্তি সম্পাদন ও পরবর্তী সময়ে সংসদে গ্রহণ করার সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধীদলকে কোনো আলোচনারই সুযোগ দেয়নি। প্রশ্ন ওঠেছে, এটি কেমন গণতন্ত্র আর কেনইবা এ জাতীয় সংসদ? কার স্বার্থে এ সংসদ? যে জাতীয় সংসদ তার সার্বভৌম ভূখণ্ডের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে না। কি প্রয়োজন তার?
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্প্রতি যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, দেশ ও জনগণের স্বার্থে সেগুলোর বিভিন্ন দিক নিয়ে চুলচেরা আলোচনা কিংবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অর্থ ভারত বিরোধিতা নয়। শুধু বিরোধীদলের নেত্রী নয়, যে কোনো দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিকই স্বাক্ষরিত যে কোনো চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারকের বিভিন্ন অপ্রকাশিত দিক ও অস্পষ্টতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন তোলার অধিকার রাখেন। কারণ, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারকগুলোর ভেতরে আসলে কি লেখা রয়েছে তা জনগণ জানেন না। সুতরাং জনস্বার্থেই সেগুলো প্রকাশ করা উচিত। তাছাড়া আমাদের দেশে তো সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনও গৃহীত হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু কিছু দীর্ঘস্থায়ী, জটিল ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর সমস্যা রয়েছে যার অবসান ঘটানো দু’দেশের মধ্যে সত্-প্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য আবশ্যক। তাতে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের ভুক্তভোগী মানুষের বিদ্বেষ ও বৈরিতা যদি কিছু থেকেও থাকে, তা ক্রমেই দূর হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সমুদ্রসীমা ও সীমান্ত নির্ধারণ থেকে শুরু করে বাণিজ্য ক্ষেত্রে পর্যন্ত অনেক সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা ও সীমান্ত নিয়ে বিরোধ যেমন নতুন নয়, তেমনি অসম বাণিজ্যের বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তদুপরি বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরে ভারতের টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ প্রকল্প, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলি করে হত্যা করার মতোই স্পর্শকাতর বিষয়। ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সুতরাং টিপাইমুখ তাদের শেষ পর্যন্ত কী উপহার দেবে তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় ভারত এমনকিছু করবে না। বাংলাদেশের ভূমিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন প্রকল্প থেকে দূরে থাকা হবে। কিন্তু আসলে কি তাই? ভারতের আসাম, মেঘালয় ও মনিপুর রাজ্যের পরিবেশবাদীরা পাঁচ বছর আগেই এ ব্যাপারে ঢাকায় আয়োজিত সেমিনারে এসে এর সম্ভাব্য কুফল সম্পর্কে বাংলাদেশীদেরকে বার বার হুশিয়ার করে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও আন্তর্জাতিক ফারাক্কা আন্দোলন আয়োজিত কয়েকটি সেমিনারে তারা বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধ কিংবা জলবিদ্যুত্ প্রকল্প তারা চান না। কারণ এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তাদের পরিবেশ ও ভূ-প্রকৃতির সর্বনাশ ঘটবে। ১৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন টিপাইমুখ পানি-বিদ্যুত্ কেন্দ্রটির জন্য প্রয়োজন হবে এক বিশাল বাঁধ এবং জলাধার, কারণ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন হবে বরাকের প্রচুর পানি। অভিন্ন নদী বরাকের ওপর বাঁধ নির্মাণ ও জলাধারে বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য পানি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে তার শাখা নদী সুরমা ও কুশিয়ারার স্বাভাবিক প্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে শুধু সুরমা ও কুশিয়ারা নয় প্রমত্তা মেঘনাও স্রোতহীন এবং নিস্তেজ হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাতে পরিবেশ, ভূ-প্রকৃতি ও জীব-বৈচিত্র্যসহ কৃষির জন্য শীত মৌসুমে সেচের পানি এবং নৌ-পরিবহন বন্ধ হতে পারে। তাছাড়া প্রস্তাবিত জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশে মারাত্মক ভূকম্পনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা বৃদ্ধি করতে পারে। এগুলো ভারতীয় ভূতত্ত্ববিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কথা। অথচ ভারত সরকার বলছে, বাংলাদেশের ভূমিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন প্রকল্প থেকে তারা দূরে থাকবে। আর কোপেনহেগেনের মতো ‘আবহাওয়া পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধ’ সংক্রান্ত সম্মেলন থেকে ফিরে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও সেই একই কথা এখনও বলে চলেছেন। বাংলাদেশের মানুষ শুধু অবাক বিস্ময়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর ভাবেন, তারা একটি কথা কেন ভারতকে স্পষ্ট করে বলতে পারেন না যে, আপনারা এ প্রকল্প বাদ দিন। আমরা ফারাক্কার প্রতিক্রিয়া প্রতিনিয়তই উপলব্ধি করছি। আর নতুন কোনো সর্বনাশ দেখতে চাই না। গঙ্গার পানির হিস্যার মতো অভিন্ন নদী তিস্তার পানি আদায় করতে আরও কত সময় পেরিয়ে যাবে কে জানে? আমাদের প্রধানমন্ত্রী সে ব্যাপারে কতদূর অগ্রসর হতে পেরেছেন তারও আমরা কিছুই স্পষ্ট করে জানতে পারিনি। যে কোনো দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানেই ভারতের দীর্ঘসূত্রতা বাংলাদেশের মানুষকে হতাশ ও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ অভিজ্ঞতা আমাদের দীর্ঘ ৩৮ বছরে সঞ্চিত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর আজও ভারতের সঙ্গে আমাদের মাত্র সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমানার বিরোধ নিষ্পত্তি হলো না। অগ্রিম বেরুবাড়ী হস্তান্তর করেও আঙ্গরপোতা এবং দহগ্রামের মতো ছিটমহলের মানুষকে এখনও পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুদর্শা। সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভারতীয় বিএসএফের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ, বাঙ্কার নির্মাণ, তাদের সহযোগিতায় ভারতীয় নাগরিকদের মাছ ধরে নিয়ে যাওয়া, এসব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন অথবা তার ভারত সরফরকালে কী আলোচনা করে এসেছেন, তার কোনো জবাব দিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী। অথচ সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশীদেরকে ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে পাখির মতো প্রাণ হারাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এগুলো সবই কি ভারত বিদ্বেষের কারণে?
উপরে উল্লিখিত আচরণের ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক কারণেই ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর, স্থলপথ ও রেলপথ ব্যবহার করতে দেয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং অস্ত্রশস্ত্র পারাপারসহ বিভিন্ন সংঘর্ষমূলক কার্যকলাপের নিরিখে ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর, স্থলপথ ও রেলপথসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে দিয়ে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত আবার কী বিপদে পড়ে সেটিই এ দেশের মানুষের আশঙ্কা এবং সে উদ্বেগ বা আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়। কারণ এসব ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতকে কী কী শর্ত দিয়েছেন জনগণ তা জানেন না। তাছাড়া ভারতই বা আমাদেরকে নিরাপত্তার ব্যাপারে কী কী নিশ্চয়তা দিয়েছে তাও আমরা কিছুই জানতে পারিনি। এটি শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, একটি অনৈতিক এবং অন্যায্য বিষয়ও বটে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ নিয়ে লুকোচুরি খেলার সর্বৈব অধিকার কোনো সরকারকে একটি দেশের জনগণ দিতে পারেন না। দলমত ও ধর্মবর্ণনির্বিশেষে এ কথাটি প্রযোজ্য। অর্থ পাওয়া যাবে বলে তো দেশ বিক্রি করে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশকে প্রতিবেশী ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও চীনের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কিংবা সমৃদ্ধির প্রশ্নে কোনো নাগরিকের তাতে কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। তবে জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সার্বিক উন্নয়নের কথাটিও এখানে মাথায় রাখা আবশ্যক। প্রতিবেশী অন্যান্য দেশকে বাদ দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের নামে যেমন শুধু ভারতকে করিডোর দেয়া যাবে না, তেমনি ভারতের মতো বিশাল প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে অন্যান্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করাও ন্যায়সঙ্গত হবে না।
ভারত শুধু আমাদের নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, আমরা তিন দিক থেকে তার দ্বারা বেষ্টিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ছাড়াও তার সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত কারণে সম্পৃক্ততা অনেক। তাই স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ভারতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে আমরা হয়তো কিছুটা আশাহত হয়েছি। তাকে বিদ্বেষ বলা যায় না, হয়তো কেউ কেউ বলবেন এটা বিমুখিতা। অনেকের কাছে তার অনেক রকম কারণ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকতে পারে। বাংলাদেশে বেশকিছু মানুষ রয়েছেন, যারা মনে করেন ভারতের দেহটি বিরাট, সে তুলনায় মনটি তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাছাড়া কেউ কেউ মনে করেন ভারত আধিপত্যবাদী। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করার পরিবর্তে তাদেরকে সব সময় দাবিয়ে রাখতে চায়।
একথা ঠিক যে, ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সমঝোতা সৃষ্টি হয়েছিল। তাই দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হলে ভারতের কাছ থেকে, বিশেষ করে কংগ্রেস দলের (ক্ষমতায় থাকলে) কাছ থেকে, অনেক কঠিন কাজও আদায় করে আনতে পারবেন, যা অন্যদের জন্য এতটা সহজ হয় না। বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতের সঙ্গে সব সমস্যার সমাধান করে একটি সত্ প্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়নি, তা নয়; কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক গঠন এবং এমনকি সাফটা চুক্তি স্বাক্ষর করেও অনেক সমস্যার সমাধান হয়নি। সবকিছুই ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। তাতে বিশাল দেশ ও বড় অর্থনীতির অধিকারী ভারতের কিছুই যায় আসে না; কিন্তু ভাটি অঞ্চলের ছোট্ট উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বাংলাদেশের অনেক সমস্যা ঘনিয়ে আসে এবং তখনই জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভারতের সদিচ্ছা সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তি, আস্থার অভাব ও বিক্ষোভ। ভারত সফর শেষে বাংলাদেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, অন্যরা বলেন, ভারত দ্বিপাক্ষিক বিষয় ছাড়া আর কোনো কিছু নিয়েই আলোচনা করতে চায় না; কিন্তু আমি তো নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে যাতায়াত সুবিধার মতো বহুপাক্ষিক বিষয়েও ভারতকে সম্মত করিয়েছি। এটি দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে উপমহাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক বিরাট অবদান রাখবে বলে তিনি দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। এ বিষয়টি নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারও আন্তরিকভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিল, যা অস্বীকার করা যাবে না। তাছাড়া দু’দেশের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে যেমন বিগত সরকারগুলো দীর্ঘদিন ভারতের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে, তেমনি নৌ ও রেলপথে ভারতের পণ্যসামগ্রী পরিবহনের জন্য ট্রানজিট প্রদানেও সম্মত হয়েছিল। সে অনুসৃত নীতিতেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ঢাকার সঙ্গে বাস সার্ভিস চালু হয়েছিল এবং পরে ঢাকা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছিল। সেগুলো কি বিগত সরকারের ভারতবিদ্বেষ কিংবা বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ?
সম্প্রতি স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক নিয়
No comments