পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে জার্মানি বিপাকে

বছরখানেক আগে জাপানে সুনামি ঘটিত পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর জার্মানি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে দিয়ে ২০২২ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবে। অনেকে তখন প্রমাদ গুনেছিল। ২০১০ সালে জার্মানির বিদ্যুত শক্তির ২৩ শতাংশ এসেছিল ১৭টি পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে।


প্রশ্ন উঠেছিল যে এই ১৭টি কেন্দ্র যে পরিমাণ বিদ্যুত যোগাত কেন্দ্রগুলো বন্ধ করার পর সেই পরিমাণ বিদ্যুত কি নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে পূরণ করা যাবে? তখন বিদ্যুতের দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে না তো? এমন পদক্ষেপের ফলে জার্মানির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কি বিপন্ন হয়ে পড়বে? এসব প্রশ্নের নিশ্চিত জবাব পেতে হলে কয়েক বছর অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। জার্মানরা এখন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ব্যাপক পরিসরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে সরে আসছে। এর মস্ত মাসুল দিতে হচ্ছে দেশের চার বৃহৎ বিদ্যুত কোম্পানিকে। কারণ গত বছর এদের আটটি বিদ্যুতকেন্দ্র চিরতরের জন্য বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
অথচ অর্ধ দশক আগে এই চার বৃহৎ কোম্পানি ইতান, ইএনবিডব্লিউ, আরডব্লিউই এবং ভ্যাটেনফলকে একটা কার্টেল হিসেবে দেখা হতো। এরা দেশের বিদ্যুত সরবরাহের ৮৬ ভাগ জোগাত এবং বিতরণ নেটওয়ার্কেরও সিংহভাগই নিয়ন্ত্রণ করত। এদের মুনাফা ছিল লোভনীয়। শেয়ারের দাম ছিল চড়া। সোজা কথায় বেশ ভালই ব্যবসা করছিল এই বৃহৎ বিদ্যুত কোম্পানিগুলো। কিন্তু তার পরই শুরু হলো তাদের দুর্ভাগ্যের পালা। খুব অল্প ব্যবধানে এদের ওপর দু দুটো মারাত্মক আঘাত নেমে এলো। প্রথমটি হচ্ছে ইউরোপীয় কমিশন এই চার কোম্পানিকে তাদের ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক গুটিয়ে নিতে বাধ্য করল। এর ধাক্কাটা তারা হয়ত সামলে নিতে পারত। কিন্তু দ্বিতীয় আঘাতটা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলল। আর সেটা হলো জীবাশ্ম জ্বালানির জায়গায় ব্যাপকহারে নবায়যোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত। এর ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো আয়ের সবচেয়ে নিশ্চিত উৎস থেকে বঞ্চিত হলো। ওদের সব পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র ২০২২ সালের মধ্যে বন্ধ করে দিতে হবে। তবে বন্ধ করা সত্ত্বেও কোম্পানিগুলোকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বছরে ২৯০ কোটি ডলারের মতো পরমাণু জ্বালানি কর পরিশোধ করে যেতে হবে।
এদিকে সারাদেশে ভর্তুকিপ্রাপ্ত হাজার হাজার সৌর ও বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র গড়ে উঠেছে এবং তারা প্রচলিত বিদ্যুতকেন্দ্রের আয়ের ক্ষমতাকে খর্ব করছে। এদের ব্যবসার সুযোগগুলো ওরাই গ্রাস করে নিচ্ছে। ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে এই কোম্পানিকে নতুন শক্তিসামর্থ্য গড়ে তুলতে হবে। পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র্র ও প্রচলিত ধারার পুরনো বিদ্যুতকেন্দ্রের পরিবর্তে বিকল্প কোন ধরনের জ্বালানিতে বিনিয়োগ করা তাদের জন্য সুবিবেচনাপূর্ণ? উপকূলীয় বায়ু শক্তি কেন্দ্রগুলো ব্যয়বহুল ও তাদের আয় কেমন হবে না হবে আগে থেকে বলার উপায় নেই। গ্যাসের দাম কম থাকায় গ্যাসচালিত বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর আয়ও অনিশ্চিত। কয়লাচালিত নতুন বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো এমন আকর্ষণীয় মনে হতে পারে। কিন্তু কার্বন নির্গমনের জন্য মাসুলের পরিমান যদি বেড়ে যায় এবং বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে তাহলে সেই কেন্দ্রগুলোও হোঁচট খেয়ে চলতে থাকবে। কাজে কাজেই আগামী ২০ কি ৩০ বছরে নতুন বিদ্যুতকেন্দ্রের ভবিষ্যত প্রাপ্তির বিষয়টি হিসাব করতে পারা প্রায় অসম্ভব। এই পরিস্থিতিতে বৃহৎ জ্বালানি প্রতিষ্ঠানের বিরোধীরা বোধগম্য কারণেই বিজয়ের হাসি হাসছে। তবে একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে, পরমাণু বিদ্যুতের জায়গায় নবায়নযোগ্য সূত্রের বিদ্যুত ব্যবহার করা হলে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বিভিন্ন সূত্রের হিসাব থেকে জানা যায় যে নবায়নযোগ্য সূত্রের বিদ্যুত ব্যবহারের কারণে ২০২০ সাল নাগাদ ভোগ্যপণ্যের দাম ২০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। এদিকে প্রচলিত পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্রের বিদ্যুতের পরিবর্তে ব্যাপক পরিসরে নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুত ব্যবহার বেআইনী প্রমাণিত হতে পারে। কারণ বৃহৎ জ্বালানি কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হয়েছে। মামলার রায় কি হয় সেটা এখন দেখার অপেক্ষা। জার্মানিতে পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোকে রেহাই দেয়ার ব্যাপারে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস করে না। তবে ভেতরে ভেতরে লবিং চলে যথেষ্ট। জার্মান এ্যাটমিক ফোরাম নামে একটি লবি গ্রুপ হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, দেশের পরমাণু বিশেষত জ্ঞানের দিক দিয়ে প্রথমে ফ্রান্সের স্থান এবং তার পরই জার্মানির। কিন্তু সেই জ্ঞান এখন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রচলিত পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্রের এখনও প্রয়োজন আছে দেশটির।
সূত্র: দি ইকোনমিস্ট

No comments

Powered by Blogger.