অলিম্পিকের ব্যবসা

অলিম্পিক প্রতিযোগিতার আসরে স্টেডিয়ামের ভেতর পণ্যের বিজ্ঞাপন একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। এ্যাথলেটদের সিঙ্গলেট বলুন আর শটস বলুন, কোথাও স্পন্সরের লোগো জুড়ে দেয়ার সুযোগ ছিল না। এমনকি এ্যাথলেটদের কিটেও নয়। এভাবে আমেচারিজমের একটা আবরণ তৈরি ছিল সর্বত্র।


তবে এই পর্দা বা আবরণের আড়ালে চলেছিল বাণিজ্যিক স্বার্থের হিংস্র প্রতিযোগিতা। এখানে যে অঙ্ক জড়িত তার কাছে রুশ ভারোত্তোলনকারীরা ছিল ম্লান। প্রতিযোগিতার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বাজেট প্রাথমিকভাবে হিসাব করা হয়েছিল ২৪০ কোটি পাউন্ড। সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯৩০ কোটি পাউন্ড। আইওসি ৪৮৭ কোটি ডলারের ব্রডকাস্ট ফি ও স্পন্সরশিপ সংগ্রহ করে ছিল। প্রতিযোগিতা আয়োজনের সত্যিকারের ভারপ্রাপ্ত লোকগ (লন্ডন অর্গানাইজিং কমিটি অব অলিম্পিক এ্যান্ড প্যারা-অলিম্পিক গেমস) আরও ৭০ কোটি পাউন্ড সংগ্রহ করেছিল । টিকেট বিক্রি করেছিল ও স্যুভেনিরের লাইসেন্স দিয়ে আরও অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল ।
অলিম্পিক ব্রান্ড ব্যবহার করার স্বত্ব লাভের জন্য ১১টি আন্তর্জাতিক স্পন্সর আইওসিকে মোটা অঙ্কের অর্থ দেয়া হয়েছিল । এরা টপ অলিম্পিক পার্টনার্স বা টপস নামে পরিচিত। প্রত্যেক বাণিজ্যিক ক্যাটাগরিতে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানকে স্পন্সর করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল । যেমন সফ্ট ড্রিঙ্কের জন্য কোকা-কোলা। টেলিভিশনের জন্য প্যানাসনিক ইত্যাদি। ব্যবসায়ের এই মডেলটি সেই ১৯৮০’র দশক থেকে আছে। তার আগে অলিম্পিকের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রটা ছিল জগাখিচুড়িতে পূর্ণ। তখন ছিল স্পন্সরের ছড়াছড়ি। এরা সামান্য কিছু অর্থ দিয়েই অলিম্পিক ব্রান্ড সংগ্রহ করত এবং তা দিয়ে গুটিকয়েক বাজারে চুটিয়ে ব্যবসা করত। এখন আইওসি অল্প কিছু স্পন্সরকে অনেক বড় আকারের কনট্রাক্ট বিক্রি করে। শীর্ষস্তরে কন্ট্রাক্টগুলো হয় দীর্ঘমেয়াদী। কমপক্ষে ৮ বছরের এবং তা বিশ্বব্যাপী প্রযোজ্য। প্রতিটি চুক্তির অঙ্ক গোপন রাখা হয়। তবে ২০০৯-১২ সালের জন্য ১১টি ক্ষেত্রে মোট স্পন্সরশিপের অর্থের পরিমাণ ৯৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। স্পন্সররা নগদ অর্থে, জিনিসে কিংবা উভয়রূপে স্পন্সরশিপের অর্থ পরিশোধ করতে পারে। যেমন ফরাসী কনসালটেন্সি ফার্ম এটোস। এটি একটি শীর্ষস্থানীয় স্পন্সর। প্রতিযোগিতার তথ্য-প্রযুক্তির দিকটা এরা দেখেছে। লন্ডনে এর কমান্ড রুমে সাড়ে চার শ’ টেকনিশিয়ান ও অন্যান্য স্টাফ টিভি স্ক্রিনের সামনে হুমড়ি খেয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এটোস আড়াই লাখ এ্যাথলেট, ট্রেনার ও অন্যদের এ্যাক্রিডিটেশন সিস্টেম পরিচালনা করেছে। তার মানে বিশ্বের সব জায়গার মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের এক বিশাল ড্যাটাবেস তৈরি করতে হয়েছে। ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে হয়েছে। এ কাজটা অতি নিরাপদে করতে হয়েছে । এটোস যে এই কাজগুলো করতে সক্ষম সেটা প্রমাণ করাই ছিলো প্রতিষ্ঠানটির প্রাপ্তি। এখানে ভুলভ্রান্তির কোন অবকাশ নেই। একবার এক শ’ মিটারের দৌড় প্রতিযোগিতা হয়ে যাবার পর এ্যাথলেটদের একথা বলার উপায় নেই যে, টেকনোলজি ঠিকমতো কাজ করেনি বলে তাদের আবার দৌড়াতে হবে।
এতে সামগ্রিক ব্যয়টা অনেক বেশি হয়ে দাঁড়ায় ঠিকই। তবে এ থেকে ভবিষ্যতের প্রাপ্তিটাও বিশাল। এটোস সম্ভাব্য খদ্দেরদের কাছে গর্ব করে বলতে পারেছে যে সামার ও উইন্টার অলিম্পিক যখন করতে পারলাম তখন খুব সম্ভব আপনার প্রজেক্টটাও করতে পারব। এভাবে অলিম্পিক প্রতিবছর এটোসের জন্য শত শত কোটি ডলারের নতুন ব্যবসা তৈরি করে দেবে।
তবে শীর্ষস্তরের স্পন্সরদের যেমন ম্যাকডোনাল্ডস, ওমেগা, প্যানাসনিক এবং প্রোক্টার এ্যান্ড গেম্বলের মতো সবাই যে নিজেদের ক্ষমতা ও সামর্থ্যরে প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেছে তা নয়। তারা নিজেদের কৌলিন্য ও আভিজাত্য এমনভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে যে খদ্দেররা তাতে আকৃষ্ট হয়েছে । স্পন্সররা স্টেডিয়ামের ভেতর নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারেনি। সেজন্য তাদেরকে অবশ্যই স্টেডিয়ামের বাইরের জগতকে বিজ্ঞাপনের জন্য বেছে নিতে হয়েছে । পোস্টার, প্যাকেজিং এবং আর যা যা উপায় আছে সবই কাজে লাগাতে হয়েছে । স্পন্সরশিপের সুফল আদায় করার জন্য তাদের বিজ্ঞাপনকে অবশ্যই যুক্ত করতে হয়েছে অলিম্পিকের সঙ্গে। তাই প্রতিটি বিলবোর্ড, চকোলেটবার ও টেলিভিশন সেটের গায়ে থাকে অলিম্পিক লোগো। বিশ্বের যেকোন জায়গায় রাস্তা দিয়ে আপনি হেঁটে যাবেন এবং আপনাকে অলিম্পিকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে না; এমনটা ভাবতে পারাই কঠিন। স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার জন্য এটা ভাল। অলিম্পিকের স্পন্সরকারী শীর্ষ দশ কোম্পানি যথাক্রমে কোকা-কোলা, ভিসা, প্যানাসনিক, ম্যাকডোনাল্ডস, স্যামসাং, এটোস, ওমেগা, জিই, এসার, ডাউ এবং পিএ্যান্ডজি। অলিম্পিকের স্পন্সর করার জন্য এদের শেয়ারের দামের ওপর কোন প্রভাব পড়ছে কিনা বলা মুশকিল। তবে ব্যবসা যে ভাল হচ্ছে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ভিসা ২০০৮ সালে অলিম্পিক থিমের ভিত্তিতে প্রমোশন চালিয়েছিল ৪৫টি দেশে। এ বছর চালাচ্ছে ৭১টি দেশে। অলিম্পিক যেহেতু সত্যিকারঅর্থে বৈশ্বিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা তা-ই যেসব আঞ্চলিক ব্রান্ড বিশ্ব জয় করতে চায় তাদের জন্য এটা একটা উত্তম ক্ষেত্র হিসাবে কাজে দিতে পারে। এ ব্যাপারে সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হলো স্যামসাং কোম্পানি। এক সময় শুধু স্বদেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় এর দাপট ছিল। ১৯৯৭ সালে এটি অলিম্পিকের স্পন্সর হওয়ার সুযোগ পায় আর তাতেই কোম্পানির কপাল খুলে যায়। এর জন্য বিক্রি বেড়ে যায়। বিশ্ববাজারে এটি ভাল অবস্থান গড়ে তোলে। টয়োটার পর স্যামসাং হলো এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বাধিক মূল্যবান ব্রান্ড। অলিম্পিকের আন্তর্জাতিক স্পন্সরদের নিচে আছে দেশীয় স্পন্সর। বিপি থেকে ক্যাডবারি পর্যন্ত ৪৪টি কোম্পানি লোগকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তবে চুক্তির ক্ষেত্র শুধু ব্রিটেনেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এসব দেশীয় স্পন্সরের সঙ্গে কাজকারবার করাসহ লোগক ঠিকাদার ভাড়া করে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করে। ভেন্যু নির্মাণের দায়িত্ব অলিম্পিক ডেলিভারি অথরিটি নাম্ েএকটি পৃথক সংস্থার। এই দুই প্রতিষ্ঠান মিলে বিভিন্ন কোম্পানিকে ছোট-বড় দু’হাজারেরও বেশি কন্ট্রাক্ট দিয়েছে। কিছু কিছু কোম্পানি আছে যাদের উপস্থিতি সব অলিম্পিকেই দেখা যায়। যেমন ইতালির মনডো। এদের কাজ রানিং ট্রাক বানানো। আবার কারোর ক্ষেত্রে কন্ট্রাক্টটা হয়ত কেবল একবারই জোটে। এভাবেই ব্যবসার দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে অলিম্পিক আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল ব্যবসা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ কিছু ব্রান্ড কোম্পানি এই ব্যবসায় শত শত কোটি ডলার ঢেলেছে। উদ্দেশ্য একটাইÑ নিজের পণ্যকে অলিম্পিকের পাদপ্রদীপের আলোয় তুলে ধরা। বিনিময়ে প্রাপ্তিটাও কম নয়। পণ্যের বিক্রি বেড়ে যায় দুনিয়াজুড়ে, মুনাফার অঙ্কটাও স্ফীত হয়ে ওঠে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট

No comments

Powered by Blogger.