সবুজায়ন- সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণ by মোকারম হোসেন

সম্প্রতি সংসদ সচিবালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানকার ইউক্যালিপটাস গাছগুলো কেটে লাগানো হবে ২৯ ধরনের দেশি গাছ। সেখানে কী কী গাছ রোপণ করা হবে, তার একটি সম্ভাব্য তালিকাও প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।


৫ জুলাই প্রথম আলোয় ‘সংসদ ভবন এলাকায় পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত’ শিরোনামে প্রকাশিত এই সংবাদে আরও জানানো হয়, দক্ষিণ প্লাজার সম্মুখ অংশের পুরোনো পামগাছগুলো (বনসুপারি) উৎপাটন করে সেখানে নিমগাছ লাগানো হবে। পাশাপাশি সেখানে পাখির জন্য একটি অভয়ারণ্য এবং একটি বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষের বাগান গড়ে তোলার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এ ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাই একসময় আমাদের সঠিক লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় ভূমিকা রাখবে। নিকট ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের চারপাশে ইউক্যালিপটাস বা অ্যাকাশিয়ার পরিবর্তে আবার ফিরে আসবে দেশি বৃক্ষগুলো।
কিন্তু আমরা যেদিন পত্রিকার পাতায় এমন একটি চমকপ্রদ খবর পড়েছি তার এক দিন পরই দিনাজপুরের বিরল উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকে হাটবারের দিন অসংখ্য ইউক্যালিপটাসের চারা কিনে বাড়ি ফিরতে দেখেছি। গ্রামের সাধারণ মানুষ এখনো ইউক্যালিপটাসের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ভাবছে না, তাদের চিন্তায় লাভের প্ররোচনা। দেশের উত্তর জনপদের অন্যান্য জেলার পাশাপাশি দিনাজপুরে এ গাছের উপস্থিতি মাত্রাতিরিক্ত। কবে আমরা এই আগ্রাসী বৃক্ষের ছোবল থেকে রক্ষা পাব জানি না। তবে আশার কথা এই যে কেউ কেউ নতুন করে এই বিষয়গুলো ভাবতে শুরু করেছেন। আমরা যদি জাতীয় সংসদ ভবনের এই উদ্যোগকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নিই তা হলে ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে আরও অনেক কাজ করার একটি পথ তৈরি হলো।
কিন্তু সংসদ ভবনের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর একটিতে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করছি। ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সম্মুখের পথপাশে নিমগাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত সঠিক নয় বলেই মনে হয়। কারণ, নিমগাছ মাঝারি আকৃতির এলায়িত শাখা-প্রশাখার গাছ। সংসদ ভবনের স্থাপত্য নকশার সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়। এখানে এমন কোনো বৃক্ষ রোপণ করা যাবে না যা সংসদ ভবনকে আড়াল করে। বরং নিমগাছের পরিবর্তে সেখানে রোপণ করা যায় দেবদারু (ঝুল দেবদারু নয়), গর্জন, তেলশুর বা তাল। এ ধরনের গাছে তুলনামূলকভাবে ডালপালার সংখ্যা কম, একহারা গড়ন, পরিণত বয়স পর্যন্ত অনেক উঁচু হতে পারে। তা ছাড়া এই বৃক্ষগুলো দীর্ঘায়ুর জন্যও বিবেচিত হতে পারে। ঝড়ে উপড়ে পড়ারও আশঙ্কা নেই।
নতুন করে যে ২৯ জাতের দেশি বৃক্ষ রোপণের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে জ্যাকারান্ডা দেশি গাছ নয়, মাত্র কয়েক দশক আগে আমাদের দেশে এসেছে। এ গাছটি দেশি গাছের মোড়কে রোপণ করার সুযোগ নেই। তবে আলংকারিক বৃক্ষ হিসেবে সীমিত সংখ্যক রোপণ করা যেতে পারে। ফুল ও পাতার সৌন্দর্যেও গাছটি নান্দনিক। সংসদ ভবনের নান্দনিক স্থাপত্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়, এমন কিছু করা মোটেই উচিত হবে না। বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রেও তা ভাবতে হবে। সম্ভবত নিরাপত্তার প্রয়োজনেও সেখানে অধিক ঘনত্বের বাগান বা জঙ্গল সৃজন করা যাবে না।
সংসদ ভবন এলাকায় বিলুপ্তপ্রায় দেশি বৃক্ষের একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার ভাবনাও একেবারে সময়োপযোগী। কাজটি শুরুর আগে সঠিক পরামর্শ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এখানে পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে বাস্তব জ্ঞান বেশি করে কাজে লাগাতে হবে। প্রথমেই কাঙ্ক্ষিত স্থানটির আয়তন জানা দরকার। সে অনুযায়ী সম্ভাব্য বৃক্ষের একটি তালিকা প্রস্তুত করে যথাযথভাবে বিন্যাস করা জরুরি। কারণ, কোন গাছটির বৈশিষ্ট্য কী ধরনের, কোন গাছটি কত উচ্চতার, কোন গাছটি ছায়া পছন্দ করে, কোন গাছটির বেশি সেচ দরকার—এসব না জানা থাকলে মূল পরিকল্পনাই ভেস্তে যেতে পারে। যাঁরা বৃক্ষ নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, এমনকি যাঁদের ভাবনায় দেশপ্রেম আর বৃক্ষপ্রেম একই সূত্রে গাঁথা, এমন কয়েকজন মানুষকে খুঁজে নিতে পারলে এই স্বপ্নটি সুচারুরূপে সম্পন্ন হবে। কারণ, তাঁরাই একমাত্র বলতে পারবেন দেশের কোন বৃক্ষটির বর্তমান পরিস্থিতি কী। এখানে বৃক্ষ ব্যবসার দৃষ্টিকোণ বা পুঁথিগত বিদ্যা মুখ্য নয়। কারণ, স্বল্প পরিসরে অধিক সংখ্যক গাছ সংরক্ষণ করতে হবে। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের এমন একটি জায়গাও নেই যেখানে দুর্লভ জাতের গাছগুলো থিতু করা যায়। বোটানিক্যাল গার্ডেনে সেই পরিবেশ নেই। রমনা পার্ক তো বৃক্ষের ঠাসবুননিতে নিশ্ছিদ্র। যখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ধরনের দুর্লভ চারা সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়, তখন স্থানসংকটের কারণে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় আমাদের। বর্তমান সরকার দেশে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। যদি দেশের দুর্লভ উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য একখণ্ড জায়গা বরাদ্দ দিয়ে আনুষঙ্গিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয় তা হলে আমরা হয়তো বেশ কিছু উদ্ভিদকে নিশ্চিত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারব। কাজটি যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের চারপাশ থেকে অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি হারিয়ে যাবে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।
tarupallab@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.