আ লো র ঝ ল কা নি

সেরা মিসি ফ্রাঙ্কলিন ॥ গত ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকের সেরা নারী ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্টেফানি রাইস। তিনটি স্বর্ণপদক করায়ত্ত করেছিলেন তিনি। এবার রাইস ছিলেন নিষ্প্রভ, অনুজ্জ্বল। এবার তাঁকে ছাপিয়ে গেছেন আরেক সাঁতারু। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিসি ফ্রাঙ্কলিন। পুরো নাম মেলিসা জেনেট্টি মিসি ফ্রাঙ্কলিন।


তিনি জিতেছেন চারটি স্বর্ণ এবং একটি ব্রোঞ্জপদক। আর মিডিয়া তাঁকে বিশেষিত করেছে ‘মহিলাদের মাইকেল ফেলপস’ নামে। মাত্র ১৭ বছর বয়সী মিসি ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক ইভেন্টে ২ মিনিট ৪.০৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে লাভ করেন স্বর্ণপদক। সেই সঙ্গে গড়েন বিশ্বরেকর্ড। ‘আগামী অলিম্পিকেও আশা করি এমন সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে পারব।’ বুঝতেই পারছেন মিসি ফ্রাঙ্কলিনের উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া এটি। তিনি আরও বলেন, ‘আশা করি আমার এ সাফল্যে আমেরিকার কিশোরী মেয়েরা সাঁতারে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী হবে এবং ভবিষ্যতে তাঁরা দেশের জন্য অনেক আন্তর্জাতিক সাফল্য বয়ে আনতে সক্ষম হবে।’
গতিমানবী শেলির নৈপুণ্য ॥ আবারও বিশ্বের দ্রুততম মানবীর খেতাব জিতেছেন জ্যামাইকার শেলি-এ্যান ফ্রেজার-প্রাইস। লন্ডন অলিম্পিকে মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের স্বর্ণপদক জিতে তিনি এ কৃতিত্ব দেখান। দ্রুততম মানবী হওয়ার পথে শেলি সময় নেন ১০.৭৫ সেকেন্ড। উসাইন বোল্টের মতো অতটা আমুদে নন শেলি। তবে তাঁর হাসিতে ঝরে মুক্তা। অতি আবেগে ভেসে না গিয়ে মুকুটরক্ষা নিশ্চিত হওয়ার পর নিজ দেশের জাতীয় পতাকা শরীরে জড়িয়ে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দেন তিনি।
চার বছর আগে বেজিং অলিম্পিকেও দ্রুততম মানবী হয়েছিলেন ২৫ বছর বয়সী শেলি। ফলে অলিম্পিক ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় স্প্রিন্টার হিসেবে প্রমীলা বিভাগে মুকুট ধরে রাখার কৃতিত্ব দেখান তিনি। এর আগে ১৯৯২ ও ১৯৯৬ অলিম্পিক গেমসে প্রমীলাদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গেইল ডিভার্স। অসাধারণ কীর্তিগাথা রচনার পর স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বাসে ভাসছেন জ্যামাইকান তরুণী। ২১ বছর বয়সে বেজিংয়ে চমক দেখিয়েই সবার সেরা হয়েছিলেন এ কৃষ্ণসুন্দরী। সেবার তাঁর দ্রুততম মানবী হওয়াটা ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত! কিন্তু গত চার বছরে পরিণত হন কিংস্টনের ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের রানী।
জেনিফারের চমক ॥ ইতিহাস গড়া হলো না ইয়েলেনা ইসিনবায়েভার। রাশিয়ান তারকা লন্ডনে এসেছিলেন টানা তিন অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের লক্ষ্য নিয়ে। লন্ডন মিশনে আসার আগে আত্মবিশ্বাসেরও কমতি ছিল না। কিন্তু স্বপ্নসাধটা শেষ পর্যন্ত অপূর্ণই রয়ে গেল রুশ তন্বী তনুলতার। লন্ডন অলিম্পিকে প্রমীলা পোলভল্ট ইভেন্টে স্বর্ণ হাতছাড়া হয়েছে দু’বারের অলিম্পিক ও পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইসিনবায়েভার। ৩০ বছর বয়সী রুশ আকাশকন্যাকে হতাশায় ডুবিয়ে স্বর্ণ জেতেন যুক্তরাষ্ট্রের জেনিফার সুহার। ৪.৭৫ মিটার উচ্চতা পাড়ি দিয়ে প্রথমবারের মতো অলিম্পিক স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব দেখান ৩০ বছর বয়সী মার্কিন কন্যা। এটি তাঁর ক্যারিয়ার সেরা পারফরমেন্স। এ সাফল্যের মধ্য দিয়ে দারুণ প্রতিশোধও নিতে সক্ষম হন জেনিফার। ২০০৮ বেজিং আসরে ইসিনবায়েভার পেছনে থেকে রৌপ্যপদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
সফল ‘পোস্টার গার্ল’ জেসিকা ॥ এবারের লন্ডন অলিম্পিকে ‘পোস্টার গার্ল’ কে? জেসিকা এ্যান্নিস। ব্রিটিশ এ্যাথলেটদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। প্রতিনিয়ত সাক্ষাতকার দেয়া আর ফটোশূট করায় তাঁর খেতাবই হয়ে গেছে ‘পোস্টার গার্ল।’ তা পোস্টার গার্ল যতই ইন্টারভিউ আর ফটোশূট করে বেড়ান না কেন, নিজের আসল কাজটি সম্পর্কে বেশ ভালভাবেই সচেতন ছিলেন ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি ও ৫৭ কেজির অধিকারী, ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে ১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারিতে জন্ম নেয়া জেসিকা এ্যান্নিস। হেপ্টাথলন ইভেন্টে স্বর্ণ জিতে দেশবাসীর প্রত্যাশা কড়ায়গ-ায় মিটিয়ে দিয়েছেন তিনি। যদিও অলিম্পিক আসরের কয়েক মাস আগে দু’-দু’টি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ আসরে স্বর্ণপদক জিততে ব্যর্থ হন তিনি। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এর আগে গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ার দায়েগুতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে একই ধরনের রেজাল্ট করেন এ অনিন্দ্যসুন্দরী।
বিতর্কিত, প্রশংসিত সিয়েন ॥ একেই বলে অভাবনীয় নৈপুণ্য। মেয়েদের সাঁতারে ৪০০ মিটার মিডলে ইভেন্টে ই সিয়েনের নৈপুণ্যের ধারেকাছে ছিলেন না আর কেউ। এত জোরে সাঁতার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন যে (শেষ ৫০ মিটারে), এ ইভেন্টে ছেলেদের বিভাগে স্বর্ণজয়ী মার্কিন তারকা সাঁতারু রায়ান লোচেটকেও টাইমিংয়ের দিক থেকে ছাড়িয়ে যান তিনি। কিন্তু মাত্র ১৬ বছর বয়সী সিয়েন লন্ডন অলিম্পিকে স্বর্ণজয় করে যে শোরগোল সৃষ্টি করেন, সেটা রূপ নেয় বিতর্কে। এ ইভেন্টে বিশ্বরেকর্ড গড়ে স্বর্ণজয়ের পর সিয়েনের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ মাদক গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। বলা হয় প্রতিযোগিতার দিন তিনি নৈপুণ্যবর্ধক নিষিদ্ধ ড্রাগ নিয়েছিলেন। মূলত অভিযোগটা করেন শীর্ষস্থানীয় এক আমেরিকান সাঁতার কোচ। তবে সিয়েন তাঁর বিরুদ্ধে আনা এ অভিযোগ অস্বীকার করেন দৃঢ়ভাবে। তাছাড়া সিয়েন সবচেয়ে বেশি সান্ত¡না বা স্বস্তি পান এই ভেবেÑ তাঁর দেশ চীন তাঁর পক্ষেই ছিল। ৪০০ মিটার মিডলে সাঁতার ইভেন্টে মাত্র ৫ সেকেন্ডে বিশ্বরেকর্ড গড়েন সিয়েন। এরপর সব বিতর্ককে চাপা দিতে ২০০ মিটার মিডলেতেও স্বর্ণ জেতেন সিয়েন।
নূতনের কেতনধারী মেলুটাইট ॥ ‘তোরা সব জয়ধ্বনি ক... ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখির ঝড়... আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্যপাগল ... সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল!... মৃত্যুগহন অন্ধকূপে মহাকালের চ-রূপে— ধূম্র-ধুপে... বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ঙ্কর ...’ আজ থেকে ৯০ বছর আগে ‘প্রলয়োল্লাস’ নামের এ অমর কবিতাটি লিখেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ)। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যাঁরা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, বিশেষ করে দুঃসাহসী নবীন-যুবারা তাঁদের উজ্জীবিত করতেই লিখেছিলেন কবিতাটি। এমন প্রেক্ষাপটে কবিতাটি লেখা হলেও পরবর্তীতে নজরুলের এ কবিতাটি শুধু আন্দোলনরত তরুণ প্রজন্মের জন্যই ব্যবহার করা হয় নাÑ ব্যবহার করা হয় যে কোন ক্ষেত্রে তরুণদের ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জনের নিমিত্তে। এমনকি খেলাধুলাতেও। এই যেমন সদ্যসমাপ্ত লন্ডন অলিম্পিক গেমসে অনেক কম বয়সে স্বীয় নৈপুণ্যে প্রজ্বলিত হয়ে তারকাখ্যাতি অর্জন করেছেন এমন একজন, যার বেলায় অনায়াসেই ব্যবহার করা যেতে পারে নজরুলের এ কবিতার লাইনগুলো। হ্যাঁ, নূতনের কেতন উড়িয়েছেন যিনি, তিনি হচ্ছেন মহিলা সাঁতারু লিথুনিয়ার ১৫ বছর বয়সী রুটা মেলুটাইট। রুটা ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে স্বর্ণপদক করায়ত্ত করেন।
জগতের এটাই নিয়ম, সাফল্য পেলে সবাই খুশি হয়, মনে রাখে। বরণ করে নেয় সাদরে। রুটা মেলুটাইটের বেলাতেও তাই হয়েছে। বয়স মাত্র ১৫, এখনও পার হননি স্কুলের গ-ি। এরই মধ্যে ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন তিনি। লিথুনিয়ার অলিম্পিক ইতিহাসে সাঁতারে প্রথম স্বর্ণ জেতেন এ কিশোরী। গত ৩০ জুলাই লন্ডন এ্যাকুয়াটিক্স সেন্টারে স্বর্ণপদক লাভ করেন ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে। দুর্দান্ত ইতিহাস গড়ার পথে পরাজিত করেন আমেরিকার তারকা মহিলা সাঁতারু রেবেকা সনিকে। যিনি এ ইভেন্টে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং বেজিং অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী।
সায়মা শারমীন

No comments

Powered by Blogger.