১১৩ জনের সাত বছর করে সাজা, আটজন খালাস

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের আলোচিত আসামি সেপাই সেলিম রেজাসহ ১১৩ জনের সর্বোচ্চ সাত বছর করে সাজা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৬৭৩ আসামির মধ্যে আটজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।


রাজধানীর পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দপ্তরের দরবার হলে স্থাপিত বিশেষ আদালত-৯-এর বিচারক কর্নেল মো. এহিয়া আযম খাঁন গতকাল মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন।
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় এ নিয়ে ১১টি ইউনিটের মধ্যে ১০টির রায় হলো। বাকি শুধু সদর রাইফেল ব্যাটালিয়ন ইউনিট। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে ৪৬টি বিদ্রোহ মামলার সব কটির রায় হয়েছে। আর হত্যা-লুণ্ঠনের ঘটনায় ফৌজদারি আদালতে করা মামলা চলছে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে।
প্রসিকিউটর যা বলেন: রায় শেষে সংবাদ সম্মেলনে মামলার প্রসিকিউটর লে. কর্নেল মো. জাকির হোসেন জানান, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দরবার হল, মহাপরিচালকের ভবন, ৫ নম্বর ফটক, কেন্দ্রীয় ম্যাগজিনসহ (গোলাবারুদ রাখার গুদাম) সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়ন। ওই দিন সেপাই মঈনের সঙ্গে ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সেপাই কাজল দরবার হলে আক্রমণ করলে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। ওই সময় পিলখানায় বিদ্রোহের নামে যা কিছু ঘটেছিল, তার সবকিছুর পেছনেই ছিল ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের বেশ কিছু সদস্যের একচ্ছত্র পরিকল্পনা, আধিপত্য এবং নেতৃত্ব।
গতকাল আদালত এলাকায় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল। পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বিচারের সময় দরবার হল ঘিরে রাখেন সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সদস্যরা। কড়া পাহারায় আসামিদের দরবার হলে আনা হয়। রায় শেষে একজন একজন করে বের করে নেওয়া হয়। কেউ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাননি।
সাজা: সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে ১১৩ জনের। সাড়ে ছয় বছর সাজা হয়েছে একজনের, ছয় বছর সাজা হয়েছে ৩২ জনের। ২৬ জনকে সাড়ে পাঁচ বছর, ১৩১ জনকে পাঁচ বছর, ১২৪ জনকে সাড়ে চার বছর, ৭৩ জনকে চার বছর, ১৬ জনকে সাড়ে তিন বছর ও ১৬ জনকে তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। আড়াই বছরের সাজা হয়েছে দুজনের, ৩৮ জনের হয়েছে দুই বছরের সাজা। আটজনকে দেড় বছর, ৪২ জনকে এক বছর, ১৫ জনকে ছয় মাস এবং ১৮ জনকে চার মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রত্যেক আসামিকে ১০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
খালাস পেলেন যাঁরা: খালাস পাওয়া আটজনের মধ্যে সাগর হোসেন, খাদেবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম, সাদিক হাসান ও সাইফুল ইসলাম দোষ স্বীকার করেন। অন্য তিনজন আবদুস সাত্তার, গোলাম কিবরিয়া ও ইকবাল হোসেন নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।
যেভাবে মামলা হয়: ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা মামলার বিচার শুরু হয় ২০১০ সালের ২৬ এপ্রিল। এ ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। বিদ্রোহে মূল ভূমিকা পালন করেন সেলিম রেজাসহ ৪৪ ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা। সুবেদার ইসমাইল হোসেন ছিলেন এ মামলার বাদী। মোট ৪৮ কার্যদিবসে এ মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। সাক্ষী ছিলেন ১২৫ জন। সাফাই সাক্ষী ছিলেন ৪৩ জন। ১৯ জন দোষ স্বীকার করেন। মোট ৬৭৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হলেও বিচার চলাকালে দুজনের মৃত্যু হয়।
যেসব অপরাধ আমলে আনা হয়েছে: মহাপরিচালকের আদেশ অমান্য করা, অধীন ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ না করা, বিদ্রোহের তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানানো, অনুমতি ছাড়াই অস্ত্র সংগ্রহ করে নিজ দখলে রাখা, অস্ত্রাগার লুট, মহাপরিচালকের বাসভবনে অবৈধ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ, পিলখানার ফটকে অবৈধ অবস্থান করা এবং নিজেকে আড়াল করতে ছুটিতে থাকার মিথ্যা তথ্য দেওয়া ইত্যাদি অপরাধ আমলে নেওয়া হয়েছে।
যা বিবেচনায় এসেছে: আসামির আগের আচরণ, তাঁদের পদবি-নিয়োগ, আসামি এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনের স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান, চাকরিক্ষেত্রে পদক পেয়েছেন কি না, গ্রেপ্তারের আগে কত দিন কারাগারে ছিলেন, আসামিদের পারিবারিক অবস্থা, দোষ স্বীকার করেছেন কি না, সাফাই সাক্ষীদের সামাজিক অবস্থা এবং প্রচলিত আইনের যথাযথ ব্যবহারসহ বিভিন্ন দিক রায়ের শাস্তির মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য ছিল।
এ আদালতের সভাপতি ছিলেন ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এহিয়া আযম খাঁন। তাঁকে সহায়তা করেন লে. কর্নেল মো. শাহাদত হোসেন ও মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান। অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল গৌতম কুমার রায়। প্রসিকিউটরের দায়িত্বে ছিলেন লে. কর্নেল জাকির হোসেন। তাঁকে সহায়তা করেন বিশেষ প্রসিকিউটর মনজুর আলম ও বিলায়েত হোসেন।

No comments

Powered by Blogger.