পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়নে জেন্ডার সংক্রান্ত ঘোষণা by অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম সরকার
বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনের পর পরিবেশ সম্পর্কে ভাবনার সূত্রপাত হয় বেশ তাড়াতাড়ি। মূলত, ১৯৭২ সালে স্টকহোম কনভেনশনে বিশ্ব পরিবেশের অবক্ষয় ও মানুষসহ প্রাণীকুলের ওপর এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগের বাস্তবতায় পরিবেশ দূষণ রোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহণের পর থেকে শুরু হয় পরিবেশ বিষয়ে ভাবনা ও গবেষণা।
আমাদের দেশের সরকার দেশের পরিবেশ রক্ষায় ১৯৭২ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের অধীনে মাত্র ২৭ জনবলের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। ১৯৮৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদফতর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭২ সালের ঘোষণার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ২১ শতকের পরিবেশ ও উন্নয়ন। নারীর সঙ্গে পরিবেশ, পরিবেশের সঙ্গে উন্নয়ন, উন্নয়নের ভিত্তি জেন্ডারবান্ধব পরিবেশ—এ সবই একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্কযুক্ত অর্থাত্ একটি অন্যটির পরিপূরক। একটি কথা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, নারী শুধু পুরুষের মতো ভোক্তা হিসেবে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করেনি বরং প্রকৃতিকে রক্ষা ও প্রাকৃতিক সম্পদের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। নারীর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কনভেনশন সম্পর্কে আলোচনা করা একান্ত অপরিহার্য। ব্রাজিলের রিও সম্মেলনে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘ পরিবেশ পরিবর্তন রূপরেখা কনভেনশন (UNFCC: United Nations Framework Convention on Climate Change) আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে দরকারি। জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন হয় যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘সুদূরপ্রসারী টেকসই সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য নারীর অংশগ্রহণ।’ ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে ১৯৯২ সালে যে ঘোষণা প্রদান করা হয় (Declaration of the UN Conference on Environmant and Development) তার ২০ নম্বর নীতি (Principle) প্রণিধানযোগ্য। ২০ নং নীতিতে উল্লেখ রয়েছে পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় এবং উন্নয়নে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি ভূমিকা বিদ্যমান। সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের জন্য নারী সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ অপরিহার্য। সুতরাং একথা পরিপূর্ণভাবে সত্য যে, টেকসই উন্নয়নে নারীদের পূর্ণ অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন। এ সম্মেলনে ‘নারী ও পরিবেশ’ হলো ১২টি প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশনের মধ্যে একটি। এখানে পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয় প্রত্যেককে প্রভাবান্বিত করলেও নারীদের জীবনকে অধিক হারে স্পর্শ করে যা তাদের জীবনব্যাপী বহন করতে হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় টেকসই ও পরিবেশগত উপযুক্ত ভোগ ও উত্পাদনের ধরন বিকাশের ক্ষেত্রে নারীদের রয়েছে মৌলিক ভূমিকা।
পরিবেশ ও উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত জাতিসংঘ সম্মেলন এবং জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ বিষয়টি স্বীকৃতি পেয়েছে। পাশাপাশি বলে রাখা ভালো ২১ সংখ্যক এজেন্ডায় এর সরাসরি প্রতিফলন রয়েছে। মানুষের ধারাবাহিক পরিবেশ বিপর্যয় ও দূষণের আগ্রাসনে এ ধরণীর সার্বিক প্রতিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখোমুখি ও বিপর্যয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। এ জাতীয় বিপর্যয়ের ফলে নারী উত্পাদনশীল জগত্ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভয়াবহ অবক্ষয়, মরুকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার দায়ভার, নারীর খাদ্য, জ্বালানি ও বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহে নারী মজুরিবিহীন কাজে অধিক সময় ধরে জড়িত, যা নারীদের আয়মূলক কাজ থেকে ছিটকে পড়তে সহায়তা করে। আমাদের দেশের জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সব মানুষ বিশেষ করে নারীরা বিশেষভাবে অরক্ষিত ও বঞ্চনার শিকার। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক নারী কৃষি কাজের সঙ্গে বিশেষ করে সবজি বাগান ও ফল-ফুল উত্পাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বাসা-বাড়িতে ও কৃষি জমির কর্মক্ষেত্রে পরিবেশ ঝুঁকি নারীর স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। খারাপ প্রভাবের কথা বলছি, কারণ আমরা সবাই জানি ভিন্ন ভিন্ন বেশকিছু রাসায়নিক দ্রব্যের বিষক্রিয়ার প্রতি নারীর নাজুকতা খানিকটা বেশি। আগেই বলেছি, আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের দ্বারা নারী ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জীবনের মান ও টিকে থাকার সামর্থ্যের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে গতিশীল ও চলমান করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে যা জেন্ডার সমতা ও ন্যায্য বিচারকে তরান্বিত করে। তবে উদ্বেগের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন পেশাদার ব্যবস্থাপক হিসেবে যথা পানি বিশেষজ্ঞ, কৃষিবিদ, পরিবেশবিদ, আইনজীবী ও বন বিশেষজ্ঞ হিসেবে নারীদের খুব সামান্যই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
এটা প্রমাণিত যে, নারী একটি নির্দিষ্ট অবদান রাখতে পারে অন্তত টেকসই ভোগের বিষয়ে সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে। একটি সুস্থ পরিবেশের জন্য দরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যে, দৃষ্টিভঙ্গির প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। পরিবেশগত সিদ্ধান্তের সব স্তরে নারীদেরকে সরাসরি জড়িত করার জন্য ১৯৯৫ সালের বেইজিং চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে বেশকিছু কৌশলগত লক্ষ্য উল্লেখ করা হয়েছে যাদের মধ্যে অন্যতম হলো ১. পরিবেশগত সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের জন্য নারীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য সুযোগের সমতা সৃষ্টি করা একান্ত অপরিহার্য; ২. পরিবেশ উন্নয়ন সংক্রান্ত রিও ঘোষণায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় এনে পরিবারের অভ্যন্তরে ও বাড়ির বাইরে কর্মক্ষেত্রে সব ধরনের পরিবেশগত ঝুঁকি এড়িয়ে নারীর জীবনকে সহজ করতে উদ্যোগী হতে হবে; ৩. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিবেশগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রত্যেক স্থানে নারীর পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ৪. জাতিসংঘের সব সংগঠনের কাজে এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কমিশনের প্রায় সব কার্যক্রমে জেন্ডার প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে অন্যথায় নারী হুমকির মুখে পতিত হতে বাধ্য; ৫. টেকসই নারী উন্নয়নের নীতি ও কর্মসূচিতে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে হলে সর্বাগ্রে দরকার পরিবেশ বিপর্যয় ও তার ফলে নারীর ওপর সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া রোধে প্রত্যেককে উত্সাহিত করা; ৬. গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি ও দেশের অভ্যন্তরের কিংবা বাইরে বেসরকারি সংগঠনগুলো ব্যাপক ভিত্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ৭. প্রচুর গবেষণার মাধ্যমে বের করতে হবে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে নারীরা কত বেশি নাজুক কিংবা অরক্ষিত। পাশাপাশি জেন্ডার সচেতন গবেষণার ফলাফলগুলো মৌলিক নীতিমালার সঙ্গে একীভূত করা, যাতে করে একটি উন্নত পৃথিবী তৈরি করা সম্ভব হয় যা নারীর জন্যও উপযোগী; ৮. সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তিত এ বাস্তবতায় টেকসই উন্নয়নে নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণের পথে সব ধরনের সমস্যা দূর করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদেরকে আসতে দিতে হবে। পাশাপাশি সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে এবং সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিমালা উন্নয়ন ঘটাতে হবে; ৯. বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নারীর জন্য দরকার কারিগরি সহযোগিতার পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ১০. নারীর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণের ব্যাপারে কাজে লাগানো যেতে পারে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, বেইজিং ৪র্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের পিএফএ তে নারী সংক্রান্ত যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো—প্রথমত, উন্নয়নের সামগ্রিক নীতিমালা এবং সব ধরনের কার্যক্রমে নারীর প্রতি বৈষম্যকে দূরে ফেলে দিয়ে নারীবান্ধব পরিবেশের জন্য জেন্ডার সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি টেকসই মানব বসতি গড়ার জন্য জেন্ডার সচেতন গবেষণার ফলাফলগুলো মৌলিক নীতিমালার সঙ্গে সমন্বিত করা। দ্বিতীয়ত, অবহেলিত ও অনগ্রসর নারীদের সামনের দিকে আসার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের প্রবেশ অধিকার নিশ্চিত করা। ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্ত করে দেয়া এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কর্মসূচির উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ নারীর টেকসই সম্পদ ব্যবহার ও জ্ঞান চর্চায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে দেয়া।
উল্লিখিত সম্মেলনের পর ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত হয় বেইজিং +৫ সম্মেলন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ১৯৯৫ সালের বেইজিং ৪র্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের মূল্যায়ন করা। ২০০০ সালে এ সম্মেলনের মাধ্যমে দেখা গেল পূর্ববর্তী সম্মেলনের ফলে যে সচেতনতা বৃদ্ধি হয়েছে তার বেশকিছু ইতিবাচক দিক নারী জীবনকে আলোকিত করেছে। পাশাপাশি যেসব টার্গেট ঠিক করা হয়েছিল সে টার্গেটগুলো পূর্ণতার দিকে ধাবিত হয়েছিল যা শুধু ইতিবাচকই নয়, বরং আশাব্যঞ্জকও বটে। যেসব বিষয় নারী জীবনকে পরিবর্তনের দিকে উন্মোচিত করে দেয়, তা মূলত দেশের অভ্যন্তরে নীতিমালাগুলোকে শক্তিশালী ও জেন্ডারবান্ধব করার মাধ্যমে। সদস্য রাষ্ট্রগুলো নারীর স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নীতিমালাগুলোকে জেন্ডার সংবেদনশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে জেন্ডার সচেতন গবেষণার ফলাফলগুলো মৌলিক নীতিমালার সঙ্গে একীভূত করে একটি টেকসই ও উন্নত জেন্ডারবান্ধব পৃথিবী গড়ার জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা নারী জীবনের জন্য ইতিবাচক ও উন্নত পরিবেশের নিশ্চয়তা প্রদান করে। পাশাপাশি বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ ও নারীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার কারণে ও বেসরকারি সরকারি পর্যায়ে নারীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পর দেখা গেছে যে, পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে নারীর দক্ষতা ও ক্ষমতা আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। এছাড়াও নারী, জেন্ডার ও পরিবেশকে প্রধান এজেন্ডা করে বহু এনজিও দেশের গ্রামপর্যায়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
ই-মেইল : advsagar29@gmail.com
No comments