অরণ্যে রোদন- অভিভাবকেরা আর সন্তানেরা by আনিসুল হক
নতুন প্রজন্ম সব সময়ই আগের প্রজন্মের চেয়ে চৌকস হয়, মেধাবী হয়। আমরা যখন স্কুলে পড়েছি, তখন ১৯৭০ সালের জ্ঞান, ১৯৮০ সালের জ্ঞান আহরণ করেছি। এখনকার প্রজন্ম ২০১২ সালের জ্ঞান পেয়ে বড় হচ্ছে। আর দুনিয়া এত গতিময় হয়ে গেছে যে দুই বছর আগের তথ্য আর জ্ঞানই এখন পুরোনো হয়ে যাচ্ছে।
কাজেই আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের চেয়ে স্মার্ট হবেই। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন আমার ধারণা ছিল, আব্বা কিছু বোঝেন না। আর আমার মেয়ে ভাবত, তার বাবা কিছুই বোঝে না। তারপর যখন আমার বয়স বেড়েছে, তখন আমি বুঝেছি, আব্বার পক্ষেও একটা জিনিস আছে, তার নাম অভিজ্ঞতা। আমার মেয়ে এখন বলে, বাবাকে যতখানি না-বুঝ সে মনে করত, বাবা ততটা নয়। কারণ ওই একটাই, অভিজ্ঞতা।
এই বিষয়ের পুরোনো কৌতুকটা আগে বলে নিই। আমার সবচেয়ে প্রিয় কৌতুকগুলোর একটা।
একটা টুপিওয়ালা একটা গাছের নিচে টুপি সাজিয়ে বসে টুপি বিক্রি করছে। গাছে ছিল কতগুলো বাঁদর। টুপিওয়ালার মাথাতেও একটা টুপি ছিল। বাঁদরগুলো ঝাঁপিয়ে নামতে লাগল গাছের ডালপালা থেকে। টুপিওয়ালার সব টুপি ছিনতাই করে প্রতিটি বাঁদর একটা করে টুপি চাপাল নিজ নিজ মাথায়।
টুপিওয়ালা হায় হায় করতে লাগল। এখন কী হবে! তার তো আজ পুরোটাই লোকসান। সে অনেক কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, বাঁদর সাহেবগণ, আমার টুপিগুলো ফেরত দিন। তারা দিল না। টুপিওয়ালা বাঁদরগুলোর দিকে ঢিল ছুড়তে লাগল। বাঁদরগুলোও গাছের ফুল-ফল যা হাতের কাছে পেল, তাই ছিঁড়ে নিয়ে টুপিওয়ালার দিকে ঢিল ছুড়তে লাগল। শেষে টুপিওয়ালার একটা কথা মনে পড়ল। বাঁদর অত্যন্ত অনুকরণপ্রিয় প্রাণী। টুপিওয়ালা তখন তার মাথার টুপি খুলে ছুড়ে মারল মাটিতে। বাঁদরগুলোও তার অনুকরণে নিজেদের মাথার টুপি খুলে ছুড়ে মারল নিচের দিকে। টুপিওয়ালা সব টুপি কুড়িয়ে নিয়ে ওই স্থান ত্যাগ করে বাঁচল।
বহুদিন পরের কথা। এবার টুপিওয়ালার নাতি এসেছে টুপি নিয়ে। ওই একই গাছের নিচে। একটা মাদুরে টুপি বিছিয়ে সেও টুপি বিক্রি করতে লাগল। অমনি গাছ থেকে একদল বাঁদর লাফিয়ে নেমে সবগুলো টুপি তুলে নিয়ে উঠে পড়ল গাছে। প্রত্যেক বাঁদরের মাথায় একটা করে টুপি।
টুপিওয়ালার নাতি কাকুতি-মিনতি করল, ঢিল ছুড়ল, কোনো লাভ হলো না। তখন মনে পড়ল তার দাদার গল্প। তার দাদা গল্প করেছিলেন, একবার তাঁর সব টুপি বাঁদররা নিয়ে গিয়েছিল। তিনি তখন তাঁর মাথার টুপি খুলে ছুড়ে মেরেছিলেন মাটিতে, আর তাঁর দেখাদেখি সব বাঁদর মাথার টুপি খুলে নিচে ছুড়ে মেরেছিল।
নাতি-টুপিওয়ালা দাদার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইল। সে তার মাথার টুপি খুলল। আর মাটিতে ছুড়ে মারল।
কিন্তু কোনো বাঁদরই তাদের মাথার টুপি খুলে মাটিতে ছুড়ে মারল না।
নাতি-টুপিওয়ালা বলল, কী ব্যাপার, তোমরা আমাকে অনুকরণ করছ না কেন? এই রকমই না হওয়ার কথা!
তখন একটা বাঁদর বলল, খালি তোমারই দাদা আছে, আমাদের দাদা নাই? খালি তোমার দাদাই তোমাকে গল্প করেছেন, আমাদের দাদা আমাদের গল্প করেন নাই? দাদারা গল্প করেন, জ্ঞান অর্জন করেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, ঠেকে শেখেন, তাই দেখে নাতিরা শেখে। এটাই জগতের নিয়ম।
আমার আব্বা ছিলেন পিটিআই বা প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক। তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল, আমার ছেলেমেয়েদের কেউ মারতে পারবে না। তিনি মনীষীদের উদ্ধৃত করে বলতেন, শিশুকে প্রকৃতির বুকে ছেড়ে দাও, প্রকৃতিই শিশুকে শিক্ষা দেবে।
আমরা, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ে নিজের নিজের ইচ্ছামতো বড় হয়েছি। আমার দুই ভাই-বোন ডাক্তার, দুই ভাই ইঞ্জিনিয়ার (এর মধ্যে একজন আমি। ব্যর্থ ইঞ্জিনিয়ার। ছোটবেলায় আমরা ধাঁধা জিজ্ঞেস করতাম। ডাব না কাটলে কী হয়? সঠিক উত্তর ছিল: নারকেল হয়। বড় হয়ে আমি ধাঁধা বানিয়েছি, ইঞ্জিনিয়ার সফল হলে কী হয়? এফ আর খান বা জামিলুর রেজা চৌধুরী বা আইনুন নিশাত হয়। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার ব্যর্থ হলে কী হয়? আমার মতো লেখক-সাংবাদিক হয়)। ছোট ভাই একটা আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থায় ভালো কাজ করে। আমি তাকে বিজ্ঞান পড়তে নিরুৎসাহিত করেছিলাম। ভাগ্যিস করেছিলাম। যাই হোক, আমরা যে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি বা পড়িনি, কোনোটাই আব্বা-আম্মার ইচ্ছায় হয়নি, আমরা নিজেদের ইচ্ছায় হয়েছি (বা হইনি)। আম্মা অবশ্য খুব চেয়েছেন, আমরা পরীক্ষায় ভালো করি।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার আমার সঙ্গে আলাপকালে একটা মূল্যবান কথা বলেছিলেন। আমাদের অভিভাবকেরা মনে করেন, তাঁর ছেলেমেয়েদের মতো দুর্বল, নাজুক মানবসন্তান আর এই পৃথিবীতে আসেনি, কাজেই তাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া এবং নিজেদের অবর্তমানে তাদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া পিতামাতার কর্তব্য। সব সময়ই মা-বাবারা বলেন, আমার জন্য তো করছি না, আমাদের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এত কিছু করতে হচ্ছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রশ্ন করছেন, কেন আমরা ভাবছি আমার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ আমাকে গড়ে দিতে হবে, তারা নিজেদেরটা নিজেরা সামলাতে পারবে না!
কোনো সন্তানই তার বাবা-মায়ের মতো হয় না। নতুন প্রজন্ম নতুনের মতোই হয়। আমার আব্বা আমার দাদার মতো হননি, আমিও আমার আব্বার মতো হইনি। কিন্তু একটা জিনিস আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই আছে, সেটা হলো শ্রেয়বোধ, মঙ্গলবোধ, আদর্শবোধ।
সদ্য বিজনেস অ্যাওয়ার্ড ফর পিস অর্জনকারী লতিফুর রহমান সাহেব একটা ছোট্ট কিন্তু অমূল্য কথা বলেছেন। যেকোনো বাবা-মা তাঁর সন্তানদের যে উপদেশ দেন, সেটা মেনে চললেই জীবন ও পৃথিবী সুন্দর হবে। অন্য কোনো উপদেশ দরকার নেই। সব বাবা-মাই ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দেন—সত্য কথা বলবে, সৎ পথে চলবে, মানুষের উপকার করবে। এমনকি সবচেয়ে অসৎ মানুষটিও নিজের ছোট্ট বাচ্চাটিকে অসৎ হওয়ার উপদেশ দেবেন না! কাজেই শৈশবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলে নিই। বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজগুলোয় মোট শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতা নির্দিষ্ট। যে পদ্ধতিতেই নেওয়া হোক না কেন, ভর্তি হতে ইচ্ছুক সব শিক্ষার্থী সুযোগ পাবেন না। যদি এক লাখ ছেলেমেয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চান, হয়তো দুই-তিন হাজার জন হতে পারবেন, বাকি ৯৭ হাজারই ভর্তি হতে পারবেন না। সেটা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমেই হোক, আর প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতেই হোক। বাকি ৯৭ হাজারের জীবন কি তাই বলে বৃথা যাবে?
আবার ভর্তি পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থী সবচেয়ে ভালো করবেন, তিনিই কি মেডিকেলের পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করবেন? মেডিকেলের ফাইনালে যিনি সবচেয়ে ভালো করবেন, তিনিই কি সবচেয়ে ভালো ডাক্তার হবেন? জীবন এ রকমেরই এক আশ্চর্য জাদুমঞ্চ, এখানে কে কী করবে, আগে থেকে বলা যায় না। আর কারও জীবনই শেষতক বৃথা যায় না।
অভিভাবকদের উদ্দেশে বলি (আসলে নিজের উদ্দেশে, কারণ আমি নিজেও একজন অভিভাবক), অভিভাবকদের উচ্চাভিলাষ, অতিরিক্ত প্রত্যাশা ছেলেমেয়েদের জন্য বড় বোঝা, বড় চাপ হয়ে উঠতে পারে। আপনার ছেলে বা মেয়ে যা করছে, যেমন করছে, তা-ই তারিফ করতে শিখুন। রবীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন ‘প্রবলেম চাইল্ড’, তাকে ডজন খানেক স্কুল বদল করিয়েও পড়াশোনা করানো যায়নি। তাতে কী হয়েছে? আসুন, কাহলিল জিবরানের কবিতাটা পড়ি: অনুবাদ করি:
সন্তানদের নিয়ে
তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।
তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা,
কিন্তু দিতে পারো না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।
তুমি তাদের শরীরকে বাসগৃহ জোগাতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়।
কারণ তাদের আত্মা বাস করে ভবিষ্যতের ঘরে। যেখানে তুমি যেতে পারো না,
এমনকি তোমার স্বপ্নের মধ্যেও নয়।
তুমি তাদের মতো হওয়ার সাধনা করতে পারো, কিন্তু
তাদের তোমার মতো বানানোর চেষ্টা কোরো না।
কারণ জীবন পেছনের দিকে যায় না, গতকালের জন্যে বসেও থাকে না।
তোমরা হচ্ছ ধনুক, আর তোমাদের সন্তানেরা হচ্ছে ছুটে যাওয়া তির।
ধনুর্বিদ অনন্তের পথে চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন তার তির ছোটে
দ্রুত আর দূরে।
তুমি ধনুক, তুমি বাঁকো, ধনুর্বিদের হাতে তোমার বেঁকে যাওয়া যেন আনন্দের জন্য হয়।
তিনি কেবল চলে যাওয়া তিরটিকে ভালোবাসেন তা-ই নয়,
তিনি তো দৃঢ় ধনুকটিকেও ভালোবাসেন।
রবীন্দ্রনাথের একই বিষয় নিয়ে একটা কবিতা আছে, ‘উপহার’ শিরোনামে।
আমাদের সন্তানেরা নদীর মতো, তারা গান গাইতে গাইতে সব বাধা অতিক্রম করে সামনে চলতে থাকবে। পেছন দিকে তাকানোর তাদের সময় কোথায়? আমরা, বুড়োরা, পর্বতমালার মতো স্থানু হয়ে থেকে যাব, আর নদীটির কথা মনে করব, তাকে অনুসরণ করব আমাদের ভালোবাসা দিয়ে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমরা পাহাড়, আমাদের সন্তানেরা নদী, আমরা তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলতে পারব না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
এই বিষয়ের পুরোনো কৌতুকটা আগে বলে নিই। আমার সবচেয়ে প্রিয় কৌতুকগুলোর একটা।
একটা টুপিওয়ালা একটা গাছের নিচে টুপি সাজিয়ে বসে টুপি বিক্রি করছে। গাছে ছিল কতগুলো বাঁদর। টুপিওয়ালার মাথাতেও একটা টুপি ছিল। বাঁদরগুলো ঝাঁপিয়ে নামতে লাগল গাছের ডালপালা থেকে। টুপিওয়ালার সব টুপি ছিনতাই করে প্রতিটি বাঁদর একটা করে টুপি চাপাল নিজ নিজ মাথায়।
টুপিওয়ালা হায় হায় করতে লাগল। এখন কী হবে! তার তো আজ পুরোটাই লোকসান। সে অনেক কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, বাঁদর সাহেবগণ, আমার টুপিগুলো ফেরত দিন। তারা দিল না। টুপিওয়ালা বাঁদরগুলোর দিকে ঢিল ছুড়তে লাগল। বাঁদরগুলোও গাছের ফুল-ফল যা হাতের কাছে পেল, তাই ছিঁড়ে নিয়ে টুপিওয়ালার দিকে ঢিল ছুড়তে লাগল। শেষে টুপিওয়ালার একটা কথা মনে পড়ল। বাঁদর অত্যন্ত অনুকরণপ্রিয় প্রাণী। টুপিওয়ালা তখন তার মাথার টুপি খুলে ছুড়ে মারল মাটিতে। বাঁদরগুলোও তার অনুকরণে নিজেদের মাথার টুপি খুলে ছুড়ে মারল নিচের দিকে। টুপিওয়ালা সব টুপি কুড়িয়ে নিয়ে ওই স্থান ত্যাগ করে বাঁচল।
বহুদিন পরের কথা। এবার টুপিওয়ালার নাতি এসেছে টুপি নিয়ে। ওই একই গাছের নিচে। একটা মাদুরে টুপি বিছিয়ে সেও টুপি বিক্রি করতে লাগল। অমনি গাছ থেকে একদল বাঁদর লাফিয়ে নেমে সবগুলো টুপি তুলে নিয়ে উঠে পড়ল গাছে। প্রত্যেক বাঁদরের মাথায় একটা করে টুপি।
টুপিওয়ালার নাতি কাকুতি-মিনতি করল, ঢিল ছুড়ল, কোনো লাভ হলো না। তখন মনে পড়ল তার দাদার গল্প। তার দাদা গল্প করেছিলেন, একবার তাঁর সব টুপি বাঁদররা নিয়ে গিয়েছিল। তিনি তখন তাঁর মাথার টুপি খুলে ছুড়ে মেরেছিলেন মাটিতে, আর তাঁর দেখাদেখি সব বাঁদর মাথার টুপি খুলে নিচে ছুড়ে মেরেছিল।
নাতি-টুপিওয়ালা দাদার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইল। সে তার মাথার টুপি খুলল। আর মাটিতে ছুড়ে মারল।
কিন্তু কোনো বাঁদরই তাদের মাথার টুপি খুলে মাটিতে ছুড়ে মারল না।
নাতি-টুপিওয়ালা বলল, কী ব্যাপার, তোমরা আমাকে অনুকরণ করছ না কেন? এই রকমই না হওয়ার কথা!
তখন একটা বাঁদর বলল, খালি তোমারই দাদা আছে, আমাদের দাদা নাই? খালি তোমার দাদাই তোমাকে গল্প করেছেন, আমাদের দাদা আমাদের গল্প করেন নাই? দাদারা গল্প করেন, জ্ঞান অর্জন করেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, ঠেকে শেখেন, তাই দেখে নাতিরা শেখে। এটাই জগতের নিয়ম।
আমার আব্বা ছিলেন পিটিআই বা প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক। তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল, আমার ছেলেমেয়েদের কেউ মারতে পারবে না। তিনি মনীষীদের উদ্ধৃত করে বলতেন, শিশুকে প্রকৃতির বুকে ছেড়ে দাও, প্রকৃতিই শিশুকে শিক্ষা দেবে।
আমরা, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ে নিজের নিজের ইচ্ছামতো বড় হয়েছি। আমার দুই ভাই-বোন ডাক্তার, দুই ভাই ইঞ্জিনিয়ার (এর মধ্যে একজন আমি। ব্যর্থ ইঞ্জিনিয়ার। ছোটবেলায় আমরা ধাঁধা জিজ্ঞেস করতাম। ডাব না কাটলে কী হয়? সঠিক উত্তর ছিল: নারকেল হয়। বড় হয়ে আমি ধাঁধা বানিয়েছি, ইঞ্জিনিয়ার সফল হলে কী হয়? এফ আর খান বা জামিলুর রেজা চৌধুরী বা আইনুন নিশাত হয়। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার ব্যর্থ হলে কী হয়? আমার মতো লেখক-সাংবাদিক হয়)। ছোট ভাই একটা আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থায় ভালো কাজ করে। আমি তাকে বিজ্ঞান পড়তে নিরুৎসাহিত করেছিলাম। ভাগ্যিস করেছিলাম। যাই হোক, আমরা যে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি বা পড়িনি, কোনোটাই আব্বা-আম্মার ইচ্ছায় হয়নি, আমরা নিজেদের ইচ্ছায় হয়েছি (বা হইনি)। আম্মা অবশ্য খুব চেয়েছেন, আমরা পরীক্ষায় ভালো করি।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার আমার সঙ্গে আলাপকালে একটা মূল্যবান কথা বলেছিলেন। আমাদের অভিভাবকেরা মনে করেন, তাঁর ছেলেমেয়েদের মতো দুর্বল, নাজুক মানবসন্তান আর এই পৃথিবীতে আসেনি, কাজেই তাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া এবং নিজেদের অবর্তমানে তাদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া পিতামাতার কর্তব্য। সব সময়ই মা-বাবারা বলেন, আমার জন্য তো করছি না, আমাদের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এত কিছু করতে হচ্ছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রশ্ন করছেন, কেন আমরা ভাবছি আমার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ আমাকে গড়ে দিতে হবে, তারা নিজেদেরটা নিজেরা সামলাতে পারবে না!
কোনো সন্তানই তার বাবা-মায়ের মতো হয় না। নতুন প্রজন্ম নতুনের মতোই হয়। আমার আব্বা আমার দাদার মতো হননি, আমিও আমার আব্বার মতো হইনি। কিন্তু একটা জিনিস আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই আছে, সেটা হলো শ্রেয়বোধ, মঙ্গলবোধ, আদর্শবোধ।
সদ্য বিজনেস অ্যাওয়ার্ড ফর পিস অর্জনকারী লতিফুর রহমান সাহেব একটা ছোট্ট কিন্তু অমূল্য কথা বলেছেন। যেকোনো বাবা-মা তাঁর সন্তানদের যে উপদেশ দেন, সেটা মেনে চললেই জীবন ও পৃথিবী সুন্দর হবে। অন্য কোনো উপদেশ দরকার নেই। সব বাবা-মাই ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দেন—সত্য কথা বলবে, সৎ পথে চলবে, মানুষের উপকার করবে। এমনকি সবচেয়ে অসৎ মানুষটিও নিজের ছোট্ট বাচ্চাটিকে অসৎ হওয়ার উপদেশ দেবেন না! কাজেই শৈশবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলে নিই। বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজগুলোয় মোট শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতা নির্দিষ্ট। যে পদ্ধতিতেই নেওয়া হোক না কেন, ভর্তি হতে ইচ্ছুক সব শিক্ষার্থী সুযোগ পাবেন না। যদি এক লাখ ছেলেমেয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চান, হয়তো দুই-তিন হাজার জন হতে পারবেন, বাকি ৯৭ হাজারই ভর্তি হতে পারবেন না। সেটা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমেই হোক, আর প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতেই হোক। বাকি ৯৭ হাজারের জীবন কি তাই বলে বৃথা যাবে?
আবার ভর্তি পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থী সবচেয়ে ভালো করবেন, তিনিই কি মেডিকেলের পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করবেন? মেডিকেলের ফাইনালে যিনি সবচেয়ে ভালো করবেন, তিনিই কি সবচেয়ে ভালো ডাক্তার হবেন? জীবন এ রকমেরই এক আশ্চর্য জাদুমঞ্চ, এখানে কে কী করবে, আগে থেকে বলা যায় না। আর কারও জীবনই শেষতক বৃথা যায় না।
অভিভাবকদের উদ্দেশে বলি (আসলে নিজের উদ্দেশে, কারণ আমি নিজেও একজন অভিভাবক), অভিভাবকদের উচ্চাভিলাষ, অতিরিক্ত প্রত্যাশা ছেলেমেয়েদের জন্য বড় বোঝা, বড় চাপ হয়ে উঠতে পারে। আপনার ছেলে বা মেয়ে যা করছে, যেমন করছে, তা-ই তারিফ করতে শিখুন। রবীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন ‘প্রবলেম চাইল্ড’, তাকে ডজন খানেক স্কুল বদল করিয়েও পড়াশোনা করানো যায়নি। তাতে কী হয়েছে? আসুন, কাহলিল জিবরানের কবিতাটা পড়ি: অনুবাদ করি:
সন্তানদের নিয়ে
তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।
তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা,
কিন্তু দিতে পারো না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।
তুমি তাদের শরীরকে বাসগৃহ জোগাতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়।
কারণ তাদের আত্মা বাস করে ভবিষ্যতের ঘরে। যেখানে তুমি যেতে পারো না,
এমনকি তোমার স্বপ্নের মধ্যেও নয়।
তুমি তাদের মতো হওয়ার সাধনা করতে পারো, কিন্তু
তাদের তোমার মতো বানানোর চেষ্টা কোরো না।
কারণ জীবন পেছনের দিকে যায় না, গতকালের জন্যে বসেও থাকে না।
তোমরা হচ্ছ ধনুক, আর তোমাদের সন্তানেরা হচ্ছে ছুটে যাওয়া তির।
ধনুর্বিদ অনন্তের পথে চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন তার তির ছোটে
দ্রুত আর দূরে।
তুমি ধনুক, তুমি বাঁকো, ধনুর্বিদের হাতে তোমার বেঁকে যাওয়া যেন আনন্দের জন্য হয়।
তিনি কেবল চলে যাওয়া তিরটিকে ভালোবাসেন তা-ই নয়,
তিনি তো দৃঢ় ধনুকটিকেও ভালোবাসেন।
রবীন্দ্রনাথের একই বিষয় নিয়ে একটা কবিতা আছে, ‘উপহার’ শিরোনামে।
আমাদের সন্তানেরা নদীর মতো, তারা গান গাইতে গাইতে সব বাধা অতিক্রম করে সামনে চলতে থাকবে। পেছন দিকে তাকানোর তাদের সময় কোথায়? আমরা, বুড়োরা, পর্বতমালার মতো স্থানু হয়ে থেকে যাব, আর নদীটির কথা মনে করব, তাকে অনুসরণ করব আমাদের ভালোবাসা দিয়ে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমরা পাহাড়, আমাদের সন্তানেরা নদী, আমরা তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলতে পারব না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments