চায়ের দাওয়াত, রিমান্ড ও মিডিয়া ট্রায়ালের গণতন্ত্র by শাহ আহমদ রেজা
ঠিক কতজন ভোটার সত্যি সত্যি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন, বহুল আলোচিত সে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এখন আর কথা বাড়ানোর কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু সত্য হলো, যারা ভোট দিয়েছিলেন তাদের ‘শখ’ এরই মধ্যে মিটে গেছে, বিশেষ করে ১৯৭৫-উত্তর প্রজন্মের তো বটেই। ইতিহাস নামের গালগল্প আর সুপরিকল্পিত প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়েছিল তারা। আওয়ামী লীগকে নিয়ে আকাশছোঁয়া আশা ও কল্পনা ছিল তাদের মধ্যে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারই তাদের সব আশা ও কল্পনাকে তছনছ করে দিয়েছে। বিশ্বাস না হলে আগ্রহী পাঠকরা নিজেদের পরিচিত মহলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৫ মার্চ কথা হচ্ছিল কয়েকজনের সঙ্গে। সেদিনের সব দৈনিকের খবরেই পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন আকর্ষণীয় বিষয়।কিন্তু আমি যাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম তাদের কেউই প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদারকে চিনতে পারলেন না। এমনকি মাত্র মাস কয়েক আগে অবসর নেয়া একজন যুগ্ম সচিবও। প্রতিমন্ত্রী তালুকদারকে চিনতে না পারার কথাটা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ রয়েছে। এই না চেনার অপরাধেই ১৩ মার্চ প্রতিমন্ত্রী আল-আরাফাহ ব্যাংকের এমডিকে ধরে আনার জন্য তার গানম্যানসহ কয়েকজন সন্ত্রাসীকে পাঠিয়েছিলেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর প্রতিমন্ত্রী অবশ্য অন্য কথা শুনিয়েছেন। তিনি যে সত্যিই একজন প্রতিমন্ত্রী সেটাই নাকি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। এজন্যই নিজের ভিজিটিং কার্ডসহ ওই এমডির কাছে গানম্যানদের পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য নাকি ছিল এমডিকে ‘চায়ের দাওয়াত’ দেয়া!বলা বাহুল্য, প্রতিমন্ত্রীর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। আসলে তাকে না চেনার কারণে শুধু নয়, তার কথামত একজনকে চাকরিতে পুনর্বহাল করতে রাজি হননি বলেই এমডিকে ‘চায়ের দাওয়াত’ পাঠিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, মিস্টার তালুকদার কী এমন গড় উল্টে ফেলেছেন, যার জন্য তাকে চিনতেই হবে? কই, সাবেক যুগ্ম সচিবসহ আমার পরিচিতজনেরাও তো তাকে চিনতে পারলেন না! তাহলে আমাদের প্রত্যেককেও কি গানম্যানদের দিয়ে পাঠানো ভিজিটিং কার্ড ও ‘চায়ের দাওয়াত’ পেয়ে কৃতার্থ হতে হবে? এখানে মূল কথাটা লক্ষ্য করা দরকার। দেশ ও জাতির স্বার্থে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখেননি বলেই প্রতিমন্ত্রী তালুকদার একডাকে চেনার মতো রাজনীতিক হয়ে উঠতে পারেননি। পাঠকরাও চিন্তা করে দেখতে পারেন। এমন একটি খবরের কথাও কারও মনে পড়বে না, যেখানে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় বা পানি আগ্রাসন বন্ধ করার মতো কোনো বিষয়ে এই প্রতিমন্ত্রীকে কখনও তত্পর দেখা গেছে। মিস্টার তালুকদাররা কিন্তু তাই বলে বসে বসে কেবল আঙুলও চুষছেন না। আওয়ামী চরিত্রের প্রকাশ তারা ঠিকই ঘটিয়ে চলেছেন। এ সংক্রান্ত উদাহরণও আবার এত বেশি যে, অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করতে গেলেও যে কাউকে ঘেমে নেয়ে উঠতে হবে।
প্রশাসনের কথাই ধরা যাক। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে আসলে সরকারই উত্সাহ জুগিয়েছে। এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনকে নিজেদের মতো করে ঢেলে সাজানোর মহাকম্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে আছে। দলীয় বিবেচনায় সরকার ঢালাওভাবে পদোন্নতি ও নিযুক্তি দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে। বিপরীতভাবে অনেককে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে ও হচ্ছে। এজন্য সরকার আগে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে নিয়েছে। প্রথম পক্ষে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিত অফিসাররা। মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকুক না থাকুক; সরকার সমর্থক অফিসাররা পদোন্নতি ও আকর্ষণীয় বিভিন্ন পদে নিযুক্তি পেয়েছেন, এখনও পাচ্ছেন। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে আওয়ামী শিবিরের ৫০৩ জন অফিসারকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অন্তত ১০টি মন্ত্রণালয়ের কাজ চালানো হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত সচিবদের দিয়ে—যাদের প্রত্যেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক। দলবাজির একই দৃষ্টিকোণ থেকে ১৫০-এরও বেশি জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তাদের বিভিন্ন দফতর, অধিদফতরের শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের পাশাপাশি ইউএনও এবং এসি ও ওসিসহ পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও বেছে বেছে সরকার সমর্থক অফিসারদেরই বসিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে ‘আওয়ামী বিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত অফিসারদের অবস্থা কিন্তু শোচনীয়। মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকা সত্ত্বেও ১১০০ অফিসারকে পদোন্নতি দেয়া হয়নি। এই পক্ষের অফিসারদের প্রথমদিকে জামায়াত-বিএনপির তথা চারদলীয় জোট সরকারের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকে জোট সরকারের ‘প্রিয়পাত্র’ ছিলেন বলেই নাকি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্তি বা পোস্টিং পেয়েছিলেন! অথচ সরকার যেভাবে যখন যেখানে ইচ্ছা যে কোনো অফিসারকে পোস্টিং বা পদোন্নতি দিতে পারে। সে অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করাটাই অফিসারদের চাকরির পূর্বশর্ত। কিন্তু সব জানা সত্ত্বেও সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারীদের প্রত্যেককে বিএনপি ও জামায়াতের ‘খাস লোক’ হিসেবে চিহ্নিত করে বসেছে। এই প্রক্রিয়ায় সম্প্রতি আবার তথাকথিত ‘স্বাধীনতাবিরোধী’দের খোঁজা শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর জন্ম নিয়েছেন এমন অনেক অফিসারও ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এভাবে প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের ৪৮০ জন অফিসারকে ওএসডি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জন সচিব রয়েছেন। অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন ৫২ জন। ১১৬ জন যুগ্ম সচিব, ১১৬ জন উপসচিব এবং ১৮৬ জন সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব ওএসডি অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। তালিকায় নাকি আরও অনেকেরই নাম রয়েছে। এসব অফিসারকে নানাভাবে ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে।
দলীয়করণ করতে গিয়ে এভাবেই প্রশাসনকে তছনছ করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। অচল হয়ে পড়েছে প্রশাসন। শুধু রাষ্ট্র্রীয় বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তথা সচিবালয়ে নয়, সরকার জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও প্রতিটি ক্ষেত্রে নগ্নভাবেই দলবাজি চালাচ্ছে। কোনো পর্যায়ের কোনো অফিসারের পক্ষেই নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন এক অবস্থাকেই সরকার উল্টো অফিসারদের ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। বলছে, জোট সরকারের সমর্থক ও স্বাধীনতাবিরোধীরা নাকি প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন!
শুধু প্রশাসনের কথাই বা বলি কেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ সরকার তছনছ করে ফেলার ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এখানে বিশেষ করে র্যাবের কথা উল্লেখ করা দরকার। ক’দিন আগে টিভিতে দেখা গেল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হল শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি একরাম হোসেনকে দিয়ে র্যাব সংবাদ সম্মেলন করাচ্ছে। র্যাবের হাতে বন্দি একরাম র্যাবের তত্ত্বাবধানেই সাংবাদিকদের জানাচ্ছিলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ছাত্রশিবিরের ‘পূর্বপরিকল্পিত’ হামলায় কীভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনের মৃত্যু ঘটেছে, শিবির নেতারা কোন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন এবং কাদের নির্দেশে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে।
বন্দুকধারী র্যাবের তত্ত্বাবধানে একরাম হোসেনের বক্তব্যসহ টিভিতে প্রচারিত দৃশ্যটি কিন্তু ‘উদ্দিন সাহেবদের’ অবৈধ সরকারের দিনগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক ‘বাঘা’ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল থেকে প্রধানমন্ত্রীর ফুফাত ভাই শেখ সেলিম পর্যন্ত অনেকের চেহারাই মানুষের মনে ভেসে উঠেছে। ছেলের বয়সীদের হাতে মার খাওয়া অনেকের ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ জবানবন্দি ও বিবৃতির কথাও মানুষের মনে পড়ে গেছে। একই কারণে সবচেয়ে অশিক্ষিত মানুষও শিবির নেতা একরামের কোনো কথা বিশ্বাস করেনি। শুনে ও দেখে মানুষ বরং ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কারণ, এতদিন সরকারের পক্ষে এ ধরনের সব কাজ শুধু পুলিশই করত। করতেন আবদুল কাহ্হার আকন্দের মতো সিআইডির কিছু অফিসারও। এবার দেখা গেল, র্যাবকে দিয়েও সরকার তার হুকুম তামিল করিয়ে ছেড়েছে।
র্যাবের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কারণ সম্ভবত উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। চারদলীয় জোট সরকারের উদ্যোগে গড়ে ওঠা র্যাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে সেদিন পর্যন্তও যথেষ্ট সমীহ ছিল। সময়ে সময়ে ক্রসফায়ারের জন্য বিতর্কিত হলেও র্যাব সাধারণভাবে প্রশংসিত হয়ে এসেছে। এর কারণ, র্যাবের অভিযানে দেশে একদিকে হত্যা-সন্ত্রাস-অপরাধ অনেক কমে গিয়েছিল, অন্যদিকে র্যাবের পদক্ষেপগুলো ছিল দলনিরপেক্ষ। জোট সরকার কখনও কোনো পর্যায়েই র্যাবকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করেনি। এমনকি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ‘উদ্দিন সাহেব’রাও র্যাবকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানাননি। সেজন্যই জনগণের মধ্যে র্যাবের ভাবমর্যাদা ছিল অনেক উঁচুতে। র্যাবকে মানুষ নিজেদের ভরসার স্থল হিসেবে দেখত। র্যাবের তত্পরতায় মানুষ বিপদে সাহস পেত।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের মঞ্চায়িত একটিমাত্র নাটকেই র্যাবের এতদিনকার ভাবমর্যাদা একেবারে মাটিতে মিশে গেছে। সরকার কেন র্যাবকে দিয়ে এরকম ন্যক্কারজনক একটি কাজ করিয়েছে তার কারণ জানানোর আগে আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বলা দরকার। এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট নয়জন আইনজীবীর বিবৃতির মূলকথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, সাবেক দুই মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী এবং ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকসহ নয় আইনজীবী ১০ মার্চ এক বিবৃতিতে বলেছেন, র্যাব ও পুলিশের হেফাজতে রিমান্ডের আসামিকে মিডিয়ার সামনে উপস্থিত করে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দেয়ানো বেআইনি এবং এক ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল। এর আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। রাজনৈতিক স্বার্থে নির্যাতনের মুখে জোর করে এ ধরনের স্বীকারোক্তি আদায় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, সংবিধান পরিপন্থী এবং বেআইনি। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে কাউকে দোষ স্বীকারে বাধ্য করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রেও কোনো ব্যক্তির ওপর অমানবিক আচরণ, নিষ্ঠুরতা ও জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় নিষিদ্ধ রয়েছে। ১১ মার্চ এক যুক্ত বিবৃতিতে সুপ্রিমকোর্টের ১০১ জন আইনজীবীও একই কথা বলেছেন।
অর্থাত্ র্যাবের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির নেতা একরামকে দিয়ে সরকার যা করিয়েছে তা সম্পূর্ণরূপেই বেআইনি এবং আইনের চোখে অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের মিডিয়া ট্রায়ালকে না মানুষ বিশ্বাস করে, না আদালতের কাছে এর কানাকড়ি মূল্য রয়েছে। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও আওয়ামী লীগ সরকার দুটি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে অপকর্মটুকু করেছে। প্রথম উদ্দেশ্য ফারুক হত্যাকাণ্ডে ফাঁসিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গ্রেফতার করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। সরকারের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য র্যাবের মতো সফল, বিশ্বস্ত ও জনপ্রিয় একটি সংস্থাকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা। আগেই বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসন ও পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ করতে গিয়ে সবকিছু একেবারে তছনছ করে ফেলেছে। বাকি ছিল র্যাব। এবার সে র্যাবের গায়েও সরকার কালোহাতের আঁচড় লাগিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সৌজন্যে’ দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও হত্যা-সন্ত্রাস আর হামলা-মামলার রাজত্ব শেকড় গেড়ে বসেছে। সংবাদপত্র ও মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে জানা গেছে, এ পর্যন্ত বিএনপির ১১০ জনসহ বিরোধী দলের দুইশ’র বেশি নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। আহতদের সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিরোধী দলের অফিস এবং নেতাকর্মীদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে দেড় হাজারের বেশি। এমন কোনো এলাকার কথা বলা যাবে না যেখানে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা হত্যা-সন্ত্রাসের শিকার না হয়েছেন এবং এখনও না হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের কথা বলতেই হবে। তার বিরুদ্ধে দু’ ডজনের বেশি মামলা চাপানোকেই যথেষ্ট মনে করেননি ক্ষমতাসীনরা। ঢাকায় হাতুড়ি দিয়ে অভিযান চালানোর পর সুদূর লন্ডনেও তার ওপর হামলা চালিয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। সবশেষে নামানো হয়েছে দুদককে। ওদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী এমকে আনোয়ার এমপির গ্রামের বাড়িতে সব আসবাবপত্র ভাংচুর করেছে ক্ষমতাসীন দলের গুণ্ডা-সন্ত্রাসীরা।
ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা চলছে রিমান্ড নিয়ে। সব মিলিয়ে রিমান্ড পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরা পর্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ না করে পারছেন না। উদাহরণ হিসেবে একটি বহুল আলোচিত মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলকে মাননীয় আদালত বলেছেন, ‘আপনাদের ক্ষমতা আছে। আমাদেরও পেটান। এভাবে চালাতে চাইলে হাইকোর্ট
উঠিয়ে দিন।’ এমন অসহায় মন্তব্যের কারণ সম্ভবত
উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তথ্য জানার নামে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াতেই সর্বোচ্চ আদালতকে এতটা কঠোর কথা শোনাতে হয়েছিল। অথচ সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো যায় না। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বীকারোক্তি আদায়ের কৌশল হিসেবে রিমান্ডে নেয়া ও নির্যাতন চালানো মানবাধিকার ও ফৌজদারি আইনের চরম লঙ্ঘন। নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর ও মর্যাদাহানিকর আচরণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশও অনুস্বাক্ষর করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এবং পুলিশ কিছুই মানছে না। ইদানীং র্যাবকে দিয়েও একই বেআইনি কাজ করানো হচ্ছে।
সব মিলিয়েই দেশকে ভয়ঙ্কর এক পরিণতির দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এভাবে চলতে থাকলে গণতন্ত্র ও বিরোধী দল তো বটেই, দেশে এক সময় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনীও অবশিষ্ট থাকবে না। তেমন অবস্থায় সর্বনাশ ঘটবে সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। সেটাই সম্ভবত আওয়ামী লীগ সরকারের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
প্রশাসনের কথাই ধরা যাক। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে আসলে সরকারই উত্সাহ জুগিয়েছে। এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনকে নিজেদের মতো করে ঢেলে সাজানোর মহাকম্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে আছে। দলীয় বিবেচনায় সরকার ঢালাওভাবে পদোন্নতি ও নিযুক্তি দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে। বিপরীতভাবে অনেককে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে ও হচ্ছে। এজন্য সরকার আগে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে নিয়েছে। প্রথম পক্ষে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিত অফিসাররা। মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকুক না থাকুক; সরকার সমর্থক অফিসাররা পদোন্নতি ও আকর্ষণীয় বিভিন্ন পদে নিযুক্তি পেয়েছেন, এখনও পাচ্ছেন। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে আওয়ামী শিবিরের ৫০৩ জন অফিসারকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অন্তত ১০টি মন্ত্রণালয়ের কাজ চালানো হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত সচিবদের দিয়ে—যাদের প্রত্যেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক। দলবাজির একই দৃষ্টিকোণ থেকে ১৫০-এরও বেশি জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তাদের বিভিন্ন দফতর, অধিদফতরের শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের পাশাপাশি ইউএনও এবং এসি ও ওসিসহ পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও বেছে বেছে সরকার সমর্থক অফিসারদেরই বসিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে ‘আওয়ামী বিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত অফিসারদের অবস্থা কিন্তু শোচনীয়। মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকা সত্ত্বেও ১১০০ অফিসারকে পদোন্নতি দেয়া হয়নি। এই পক্ষের অফিসারদের প্রথমদিকে জামায়াত-বিএনপির তথা চারদলীয় জোট সরকারের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকে জোট সরকারের ‘প্রিয়পাত্র’ ছিলেন বলেই নাকি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্তি বা পোস্টিং পেয়েছিলেন! অথচ সরকার যেভাবে যখন যেখানে ইচ্ছা যে কোনো অফিসারকে পোস্টিং বা পদোন্নতি দিতে পারে। সে অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করাটাই অফিসারদের চাকরির পূর্বশর্ত। কিন্তু সব জানা সত্ত্বেও সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারীদের প্রত্যেককে বিএনপি ও জামায়াতের ‘খাস লোক’ হিসেবে চিহ্নিত করে বসেছে। এই প্রক্রিয়ায় সম্প্রতি আবার তথাকথিত ‘স্বাধীনতাবিরোধী’দের খোঁজা শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর জন্ম নিয়েছেন এমন অনেক অফিসারও ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এভাবে প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের ৪৮০ জন অফিসারকে ওএসডি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জন সচিব রয়েছেন। অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন ৫২ জন। ১১৬ জন যুগ্ম সচিব, ১১৬ জন উপসচিব এবং ১৮৬ জন সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব ওএসডি অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। তালিকায় নাকি আরও অনেকেরই নাম রয়েছে। এসব অফিসারকে নানাভাবে ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে।
দলীয়করণ করতে গিয়ে এভাবেই প্রশাসনকে তছনছ করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। অচল হয়ে পড়েছে প্রশাসন। শুধু রাষ্ট্র্রীয় বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তথা সচিবালয়ে নয়, সরকার জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও প্রতিটি ক্ষেত্রে নগ্নভাবেই দলবাজি চালাচ্ছে। কোনো পর্যায়ের কোনো অফিসারের পক্ষেই নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন এক অবস্থাকেই সরকার উল্টো অফিসারদের ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। বলছে, জোট সরকারের সমর্থক ও স্বাধীনতাবিরোধীরা নাকি প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন!
শুধু প্রশাসনের কথাই বা বলি কেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ সরকার তছনছ করে ফেলার ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এখানে বিশেষ করে র্যাবের কথা উল্লেখ করা দরকার। ক’দিন আগে টিভিতে দেখা গেল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হল শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি একরাম হোসেনকে দিয়ে র্যাব সংবাদ সম্মেলন করাচ্ছে। র্যাবের হাতে বন্দি একরাম র্যাবের তত্ত্বাবধানেই সাংবাদিকদের জানাচ্ছিলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ছাত্রশিবিরের ‘পূর্বপরিকল্পিত’ হামলায় কীভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনের মৃত্যু ঘটেছে, শিবির নেতারা কোন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন এবং কাদের নির্দেশে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে।
বন্দুকধারী র্যাবের তত্ত্বাবধানে একরাম হোসেনের বক্তব্যসহ টিভিতে প্রচারিত দৃশ্যটি কিন্তু ‘উদ্দিন সাহেবদের’ অবৈধ সরকারের দিনগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক ‘বাঘা’ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল থেকে প্রধানমন্ত্রীর ফুফাত ভাই শেখ সেলিম পর্যন্ত অনেকের চেহারাই মানুষের মনে ভেসে উঠেছে। ছেলের বয়সীদের হাতে মার খাওয়া অনেকের ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ জবানবন্দি ও বিবৃতির কথাও মানুষের মনে পড়ে গেছে। একই কারণে সবচেয়ে অশিক্ষিত মানুষও শিবির নেতা একরামের কোনো কথা বিশ্বাস করেনি। শুনে ও দেখে মানুষ বরং ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কারণ, এতদিন সরকারের পক্ষে এ ধরনের সব কাজ শুধু পুলিশই করত। করতেন আবদুল কাহ্হার আকন্দের মতো সিআইডির কিছু অফিসারও। এবার দেখা গেল, র্যাবকে দিয়েও সরকার তার হুকুম তামিল করিয়ে ছেড়েছে।
র্যাবের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কারণ সম্ভবত উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। চারদলীয় জোট সরকারের উদ্যোগে গড়ে ওঠা র্যাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে সেদিন পর্যন্তও যথেষ্ট সমীহ ছিল। সময়ে সময়ে ক্রসফায়ারের জন্য বিতর্কিত হলেও র্যাব সাধারণভাবে প্রশংসিত হয়ে এসেছে। এর কারণ, র্যাবের অভিযানে দেশে একদিকে হত্যা-সন্ত্রাস-অপরাধ অনেক কমে গিয়েছিল, অন্যদিকে র্যাবের পদক্ষেপগুলো ছিল দলনিরপেক্ষ। জোট সরকার কখনও কোনো পর্যায়েই র্যাবকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করেনি। এমনকি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ‘উদ্দিন সাহেব’রাও র্যাবকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানাননি। সেজন্যই জনগণের মধ্যে র্যাবের ভাবমর্যাদা ছিল অনেক উঁচুতে। র্যাবকে মানুষ নিজেদের ভরসার স্থল হিসেবে দেখত। র্যাবের তত্পরতায় মানুষ বিপদে সাহস পেত।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের মঞ্চায়িত একটিমাত্র নাটকেই র্যাবের এতদিনকার ভাবমর্যাদা একেবারে মাটিতে মিশে গেছে। সরকার কেন র্যাবকে দিয়ে এরকম ন্যক্কারজনক একটি কাজ করিয়েছে তার কারণ জানানোর আগে আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বলা দরকার। এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট নয়জন আইনজীবীর বিবৃতির মূলকথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, সাবেক দুই মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী এবং ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকসহ নয় আইনজীবী ১০ মার্চ এক বিবৃতিতে বলেছেন, র্যাব ও পুলিশের হেফাজতে রিমান্ডের আসামিকে মিডিয়ার সামনে উপস্থিত করে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দেয়ানো বেআইনি এবং এক ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল। এর আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। রাজনৈতিক স্বার্থে নির্যাতনের মুখে জোর করে এ ধরনের স্বীকারোক্তি আদায় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, সংবিধান পরিপন্থী এবং বেআইনি। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে কাউকে দোষ স্বীকারে বাধ্য করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রেও কোনো ব্যক্তির ওপর অমানবিক আচরণ, নিষ্ঠুরতা ও জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় নিষিদ্ধ রয়েছে। ১১ মার্চ এক যুক্ত বিবৃতিতে সুপ্রিমকোর্টের ১০১ জন আইনজীবীও একই কথা বলেছেন।
অর্থাত্ র্যাবের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির নেতা একরামকে দিয়ে সরকার যা করিয়েছে তা সম্পূর্ণরূপেই বেআইনি এবং আইনের চোখে অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের মিডিয়া ট্রায়ালকে না মানুষ বিশ্বাস করে, না আদালতের কাছে এর কানাকড়ি মূল্য রয়েছে। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও আওয়ামী লীগ সরকার দুটি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে অপকর্মটুকু করেছে। প্রথম উদ্দেশ্য ফারুক হত্যাকাণ্ডে ফাঁসিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গ্রেফতার করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। সরকারের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য র্যাবের মতো সফল, বিশ্বস্ত ও জনপ্রিয় একটি সংস্থাকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা। আগেই বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসন ও পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ করতে গিয়ে সবকিছু একেবারে তছনছ করে ফেলেছে। বাকি ছিল র্যাব। এবার সে র্যাবের গায়েও সরকার কালোহাতের আঁচড় লাগিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সৌজন্যে’ দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও হত্যা-সন্ত্রাস আর হামলা-মামলার রাজত্ব শেকড় গেড়ে বসেছে। সংবাদপত্র ও মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে জানা গেছে, এ পর্যন্ত বিএনপির ১১০ জনসহ বিরোধী দলের দুইশ’র বেশি নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। আহতদের সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিরোধী দলের অফিস এবং নেতাকর্মীদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে দেড় হাজারের বেশি। এমন কোনো এলাকার কথা বলা যাবে না যেখানে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা হত্যা-সন্ত্রাসের শিকার না হয়েছেন এবং এখনও না হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের কথা বলতেই হবে। তার বিরুদ্ধে দু’ ডজনের বেশি মামলা চাপানোকেই যথেষ্ট মনে করেননি ক্ষমতাসীনরা। ঢাকায় হাতুড়ি দিয়ে অভিযান চালানোর পর সুদূর লন্ডনেও তার ওপর হামলা চালিয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। সবশেষে নামানো হয়েছে দুদককে। ওদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী এমকে আনোয়ার এমপির গ্রামের বাড়িতে সব আসবাবপত্র ভাংচুর করেছে ক্ষমতাসীন দলের গুণ্ডা-সন্ত্রাসীরা।
ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা চলছে রিমান্ড নিয়ে। সব মিলিয়ে রিমান্ড পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরা পর্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ না করে পারছেন না। উদাহরণ হিসেবে একটি বহুল আলোচিত মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলকে মাননীয় আদালত বলেছেন, ‘আপনাদের ক্ষমতা আছে। আমাদেরও পেটান। এভাবে চালাতে চাইলে হাইকোর্ট
উঠিয়ে দিন।’ এমন অসহায় মন্তব্যের কারণ সম্ভবত
উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তথ্য জানার নামে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াতেই সর্বোচ্চ আদালতকে এতটা কঠোর কথা শোনাতে হয়েছিল। অথচ সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো যায় না। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বীকারোক্তি আদায়ের কৌশল হিসেবে রিমান্ডে নেয়া ও নির্যাতন চালানো মানবাধিকার ও ফৌজদারি আইনের চরম লঙ্ঘন। নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর ও মর্যাদাহানিকর আচরণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশও অনুস্বাক্ষর করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এবং পুলিশ কিছুই মানছে না। ইদানীং র্যাবকে দিয়েও একই বেআইনি কাজ করানো হচ্ছে।
সব মিলিয়েই দেশকে ভয়ঙ্কর এক পরিণতির দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এভাবে চলতে থাকলে গণতন্ত্র ও বিরোধী দল তো বটেই, দেশে এক সময় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনীও অবশিষ্ট থাকবে না। তেমন অবস্থায় সর্বনাশ ঘটবে সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। সেটাই সম্ভবত আওয়ামী লীগ সরকারের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
No comments