সফলদের স্বপ্নগাথা- নিজের ওপর আস্থা রেখে এগিয়ে যাও by নিল আর্মস্ট্রং
১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই প্রথম মানুষ হিসেবে চন্দ্রপৃষ্টে পদার্পণ করে মার্কিন নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং। তাঁর জন্ম ১৯৩০ সালের ৫ আগস্ট। সম্প্রতি (২৫ আগস্ট ২০১২) তিনি ৮২ বছরে মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৫ সালের ১৩ মে সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি এই ভাষণটি দেন।
সবাইকে স্বাগতম। অভিনন্দন নতুন গ্র্যাজুয়েটদের।
জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হাইনরিশ শ্লাইমান মনে করতেন হোমারের মহাকাব্য ইলিয়ড-এর সূত্র ধরে প্রাচীন ট্রয় নগরের সন্ধান পাওয়া যাবে। প্রচলিত ধারণার বাইরে ছিল তাঁর এই বিশ্বাস। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় তিনি ট্রয় নগরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করেন। ধ্বংসাবশেষে শুধু ট্রয় নগরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি, আরও নয়টি নগর সভ্যতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। একটি সভ্যতা যখন ধ্বংস হয়, তখন তার ওপর নির্মাণ করা হয় আরেকটি সমাজ-সভ্যতা। পূর্বতন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতো নতুন সভ্যতা। ট্রয় নগরের দশম সভ্যতার মানুষের কয়েকজন নতুন আরেকটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বেছে নেয় দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই উপকূলকে। নতুন প্রতিষ্ঠিত সেই সমাজের মূল লক্ষ্য ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছানো। অনুসন্ধানের নতুন এক সুযোগ সৃষ্টি করা।
আজকে আমরা একত্র হয়ে সেই মহাসাগরের উপকূলে দাঁড়িয়ে ট্রয়বাসীকে সম্মান জানাচ্ছি। তাদের সৃষ্টি করা অনুসন্ধানকেই আঁকড়ে ধরে তোমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে যাচ্ছ। তোমরা হতে যাচ্ছ গ্র্যাজুয়েট।
যারা গ্র্যাজুয়েট হতে যাচ্ছ, তাদের জন্য আজ বিশেষ একটি দিন। শুধু তাদের জন্যই না—তাদের পিতামাতা, শিক্ষকদের জন্যও আজ স্মরণীয় দিন। কয়েক বছর আগে আমি একজন বক্তার কাছে শুনেছিলাম, ‘আমরা যা বলি এই পৃথিবীর কাছে তার কোনো গুরুত্ব নেই; কেউ মনে রাখবে না সে কথা।’ সত্যি বলতে কি সেই বক্তা ভুল বলেছিলেন। আমরা যা বলি তার গুরুত্ব অবশ্যই আছে এবং তা পৃথিবীতে অনেক দিন টিকে থাকে। আমাদের চলে যাওয়ার পরও। তারপরও আমি সেই বক্তার ভুল কথাটি আজ তোমাদের বলতে চাই। আজকে আমি যা বলব, তা তোমাদের অনেক দিন ধরে মনে রাখার কোনো দরকার নেই। তোমরা আজকের দিনটা শুধু তোমাদের আনন্দের দিন হিসেবে মনে রেখো। শুধুই আনন্দের দিন, প্রত্যাশার একটি দিন।
নতুন গ্র্যাজুয়েটদের কিছু বলতে চাই। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আজকের দিন বিশেষ একটি দিন। আজকের দিনটির জন্য তোমরা অনেক পরিশ্রম করেছ, অনেক সময় দিয়েছ। তোমরা এখন একটি শিক্ষা সনদের গর্বিত বাহক। এই সনদ সুনিশ্চিত করবে তোমার শিক্ষার মাপকাঠি। তোমরা এখানে শিখেছ জীবনের বাস্তবতা ও নানা মুনির নানা মতের গুরুত্ব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তোমরা এখন বাস্তবতা ও ভিন্ন মতের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখেছ। এ জন্যই হয়তো তোমাদের সংবাদপত্রগুলোর বিশেষজ্ঞ আলোচনায় দেখা যাবে।
তোমাদের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে, সবাই তোমরা যেকোনো ক্ষেত্রে সরলতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে। বলতে অনেকটা সহজ হলেও বাস্তবে কোনো বিষয়ের ভেতরে সরলতাকে খুঁজে বের করা কিন্তু অনেক কষ্টকর। আমি প্রত্যাশা করব, তোমরা যৌক্তিকভাবে যেকোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। অন্য কোনো কিছু যেন তোমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে না পারে। সুনির্দিষ্ট করে বলা চলে, তোমার নিজের চিন্তাশক্তিকে আলিঙ্গন করে নাও। রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত একটি উক্তি আছে চিন্তাশক্তি নিয়ে। তিনি বলতেন, ‘কোনো কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা সে বিষয়ে একমত বা দ্বিমত পোষণ করা বোঝায় না, চিন্তাভাবনা হচ্ছে ওই ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তি-ইচ্ছার অভিব্যক্তি।’ চিন্তাভাবনা এবং শেখার ইচ্ছার কারণেই আজকে তোমাদের জীবনে এই দিনকে তোমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছে।
তোমাদের অনেকে অন্য কোনো ভিন্ন জায়গা থেকে এই জায়গায় পড়াশোনা করতে এসেছ। তোমরা আমাদের গর্বিত করেছ। আমাদের দেশের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তোমরা আমাদের সম্মানিত করেছ। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, তোমাদের সময় ও শ্রমের যে বিনিয়োগ করেছ, এখানে তা অবশ্যই কাজে লাগবে এবং এই বন্ধুত্ব অনেক দিন ধরে টিকে থাকবে।
১৯৪০-এর দশকে আমাদের শিক্ষার্থীদের ছিল না কোনো ক্যালকুলেটর, মুঠোফোন, ক্রেডিট কার্ড, কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট। তারপরও আমাদের প্রজন্মকে অনেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করত। আমার কলেজ গ্র্যাজুয়েশেনের সময় দূরপাল্লার বিমানগুলোতে প্রোপেলার ব্যবহার করা হতো। সামরিক বাহিনীতে কিছুসংখ্যক জেট ইঞ্জিনের বিমান ছিল, রকেটের ইঞ্জিন ছিল সেকেলে প্রাথমিক যুগের। সেই সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক যদি নভোযান পরিচালনাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের পরামর্শ দিতেন, সবাই তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত। সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ নভোযানের যাত্রা দেখা যেত প্রতি সন্ধ্যায় ‘দি ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অব ডিজনি’ টেলিভিশন অনুষ্ঠানে। কিন্তু হঠাৎ করে মানুষ বদলে ফেলে তার সমাজকে। নির্মাণ করে নতুন ইতিহাস, নতুন যুগের। তিন বছরের মধ্যে সোভিয়েত প্রকৌশলীরা পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করেন। শুরু হয় নতুন নভোযুগের। এক দশকের মধ্যেই কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন ধরনের নভোযান প্রেরণ করা হয় পৃথিবীর কাছাকাছি গ্রহগুলোতে। শুরু হয় মানুষের মহাশূন্যে যাতায়াতের নতুন যুগ। চাঁদে ও পৃথিবীর কাছের গ্রহ মঙ্গলে মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার অলীক স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তবে দেখা মিলতে শুরু করে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অগ্রগতিই তোমাদের মধ্যে এনে দিয়েছে নতুন সুযোগ, কাজ করার নতুন ক্ষেত্র। তৈরি করেছে নতুন সম্ভাবনার। আশা করা যায়, তোমরা যা শিখেছ তা কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবে।
ভবিষ্যতে তোমরা কখনোই নিজেকে জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্চিত করবে না। জ্ঞান অর্জন করা যায় সমগ্র জীবন ধরে। তোমাদের সেই শুরুটা আমাদের থেকেও অনেক ভালো। ট্রয়বাসীর মতোই তোমরা নিজেদের উন্নত করতে থাকবে। একেকজন হয়ে উঠবে একজন ট্রয়-যোদ্ধা।
প্রচলিত রীতি অনুসারে আমাকে বক্তা হিসেবে তোমাদের কিছু উপদেশ দিতে হচ্ছে। উপদেশ দিতে হলে অনেক আত্মবিশ্বাস থাকতে হয়। অস্বস্তির পরেও আমাকে কথা বলতে হচ্ছে। আমি মনে করি, উপদেশ থেকেও আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসই তোমাদের মনোযোগ আর্কষণ করবে। আমি শুধু তোমাদের একটি বিশ্বাসের কথা বলতে চাই। মাঝেমধ্যে অনেক কিছু তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার জন্য তোমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে পারে। তোমার অর্থ-সম্পত্তি কোনো না কোনোভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে। তোমার কাছ থেকে শুধু একটা জিনিসই তোমার অনিচ্ছায় হারিয়ে যেতে পারবে না, সেটা হলো তোমার নীতিবোধ, তোমার আদর্শ। এটাই তোমার দখলে যেসব জিনিস আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি যদি তোমার ভেতরের নীতিবোধগুলোকে পরিচর্যা করতে থাকো, সতর্কতার সঙ্গে নির্মাণ করতে পারো তোমার ব্যক্তি-আদর্শ, তা হলেই তুমি ট্রয়বাসীর মতোই সফল। এই নীতিবোধ, আদর্শই তোমাকে পরিচালনা করবে, তোমার সমাজকে পরিচালিত করবে। সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে মানব চরিত্রের নীতিবোধ, আদর্শের ওপর। ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কী নিয়ে আসবে? সেটা আমি জানি না, কিন্তু যা আনবে তা নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর ও দুঃসাহসিক।
ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য নিজের জ্ঞান-মেধাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাও, তাকে নিয়ে কোনো ধরনের পূর্বধারণার দরকার নেই। ট্রয়বাসীকে ছাপিয়ে তোমার পরিশ্রমের ওপরই নির্মাণ করা হবে আগামীর সমাজ, দেশ, নতুন সভ্যতা।
সবাইকে ধন্যবাদ, সবার জন্য শুভ কামনা।
সূত্র: ওয়েবসাইট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর: জাহিদ হোসাইন
জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হাইনরিশ শ্লাইমান মনে করতেন হোমারের মহাকাব্য ইলিয়ড-এর সূত্র ধরে প্রাচীন ট্রয় নগরের সন্ধান পাওয়া যাবে। প্রচলিত ধারণার বাইরে ছিল তাঁর এই বিশ্বাস। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় তিনি ট্রয় নগরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করেন। ধ্বংসাবশেষে শুধু ট্রয় নগরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি, আরও নয়টি নগর সভ্যতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। একটি সভ্যতা যখন ধ্বংস হয়, তখন তার ওপর নির্মাণ করা হয় আরেকটি সমাজ-সভ্যতা। পূর্বতন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতো নতুন সভ্যতা। ট্রয় নগরের দশম সভ্যতার মানুষের কয়েকজন নতুন আরেকটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বেছে নেয় দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই উপকূলকে। নতুন প্রতিষ্ঠিত সেই সমাজের মূল লক্ষ্য ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছানো। অনুসন্ধানের নতুন এক সুযোগ সৃষ্টি করা।
আজকে আমরা একত্র হয়ে সেই মহাসাগরের উপকূলে দাঁড়িয়ে ট্রয়বাসীকে সম্মান জানাচ্ছি। তাদের সৃষ্টি করা অনুসন্ধানকেই আঁকড়ে ধরে তোমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে যাচ্ছ। তোমরা হতে যাচ্ছ গ্র্যাজুয়েট।
যারা গ্র্যাজুয়েট হতে যাচ্ছ, তাদের জন্য আজ বিশেষ একটি দিন। শুধু তাদের জন্যই না—তাদের পিতামাতা, শিক্ষকদের জন্যও আজ স্মরণীয় দিন। কয়েক বছর আগে আমি একজন বক্তার কাছে শুনেছিলাম, ‘আমরা যা বলি এই পৃথিবীর কাছে তার কোনো গুরুত্ব নেই; কেউ মনে রাখবে না সে কথা।’ সত্যি বলতে কি সেই বক্তা ভুল বলেছিলেন। আমরা যা বলি তার গুরুত্ব অবশ্যই আছে এবং তা পৃথিবীতে অনেক দিন টিকে থাকে। আমাদের চলে যাওয়ার পরও। তারপরও আমি সেই বক্তার ভুল কথাটি আজ তোমাদের বলতে চাই। আজকে আমি যা বলব, তা তোমাদের অনেক দিন ধরে মনে রাখার কোনো দরকার নেই। তোমরা আজকের দিনটা শুধু তোমাদের আনন্দের দিন হিসেবে মনে রেখো। শুধুই আনন্দের দিন, প্রত্যাশার একটি দিন।
নতুন গ্র্যাজুয়েটদের কিছু বলতে চাই। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আজকের দিন বিশেষ একটি দিন। আজকের দিনটির জন্য তোমরা অনেক পরিশ্রম করেছ, অনেক সময় দিয়েছ। তোমরা এখন একটি শিক্ষা সনদের গর্বিত বাহক। এই সনদ সুনিশ্চিত করবে তোমার শিক্ষার মাপকাঠি। তোমরা এখানে শিখেছ জীবনের বাস্তবতা ও নানা মুনির নানা মতের গুরুত্ব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তোমরা এখন বাস্তবতা ও ভিন্ন মতের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখেছ। এ জন্যই হয়তো তোমাদের সংবাদপত্রগুলোর বিশেষজ্ঞ আলোচনায় দেখা যাবে।
তোমাদের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে, সবাই তোমরা যেকোনো ক্ষেত্রে সরলতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে। বলতে অনেকটা সহজ হলেও বাস্তবে কোনো বিষয়ের ভেতরে সরলতাকে খুঁজে বের করা কিন্তু অনেক কষ্টকর। আমি প্রত্যাশা করব, তোমরা যৌক্তিকভাবে যেকোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। অন্য কোনো কিছু যেন তোমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে না পারে। সুনির্দিষ্ট করে বলা চলে, তোমার নিজের চিন্তাশক্তিকে আলিঙ্গন করে নাও। রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত একটি উক্তি আছে চিন্তাশক্তি নিয়ে। তিনি বলতেন, ‘কোনো কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা সে বিষয়ে একমত বা দ্বিমত পোষণ করা বোঝায় না, চিন্তাভাবনা হচ্ছে ওই ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তি-ইচ্ছার অভিব্যক্তি।’ চিন্তাভাবনা এবং শেখার ইচ্ছার কারণেই আজকে তোমাদের জীবনে এই দিনকে তোমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছে।
তোমাদের অনেকে অন্য কোনো ভিন্ন জায়গা থেকে এই জায়গায় পড়াশোনা করতে এসেছ। তোমরা আমাদের গর্বিত করেছ। আমাদের দেশের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তোমরা আমাদের সম্মানিত করেছ। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, তোমাদের সময় ও শ্রমের যে বিনিয়োগ করেছ, এখানে তা অবশ্যই কাজে লাগবে এবং এই বন্ধুত্ব অনেক দিন ধরে টিকে থাকবে।
১৯৪০-এর দশকে আমাদের শিক্ষার্থীদের ছিল না কোনো ক্যালকুলেটর, মুঠোফোন, ক্রেডিট কার্ড, কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট। তারপরও আমাদের প্রজন্মকে অনেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করত। আমার কলেজ গ্র্যাজুয়েশেনের সময় দূরপাল্লার বিমানগুলোতে প্রোপেলার ব্যবহার করা হতো। সামরিক বাহিনীতে কিছুসংখ্যক জেট ইঞ্জিনের বিমান ছিল, রকেটের ইঞ্জিন ছিল সেকেলে প্রাথমিক যুগের। সেই সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক যদি নভোযান পরিচালনাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের পরামর্শ দিতেন, সবাই তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত। সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ নভোযানের যাত্রা দেখা যেত প্রতি সন্ধ্যায় ‘দি ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অব ডিজনি’ টেলিভিশন অনুষ্ঠানে। কিন্তু হঠাৎ করে মানুষ বদলে ফেলে তার সমাজকে। নির্মাণ করে নতুন ইতিহাস, নতুন যুগের। তিন বছরের মধ্যে সোভিয়েত প্রকৌশলীরা পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করেন। শুরু হয় নতুন নভোযুগের। এক দশকের মধ্যেই কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন ধরনের নভোযান প্রেরণ করা হয় পৃথিবীর কাছাকাছি গ্রহগুলোতে। শুরু হয় মানুষের মহাশূন্যে যাতায়াতের নতুন যুগ। চাঁদে ও পৃথিবীর কাছের গ্রহ মঙ্গলে মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার অলীক স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তবে দেখা মিলতে শুরু করে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অগ্রগতিই তোমাদের মধ্যে এনে দিয়েছে নতুন সুযোগ, কাজ করার নতুন ক্ষেত্র। তৈরি করেছে নতুন সম্ভাবনার। আশা করা যায়, তোমরা যা শিখেছ তা কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবে।
ভবিষ্যতে তোমরা কখনোই নিজেকে জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্চিত করবে না। জ্ঞান অর্জন করা যায় সমগ্র জীবন ধরে। তোমাদের সেই শুরুটা আমাদের থেকেও অনেক ভালো। ট্রয়বাসীর মতোই তোমরা নিজেদের উন্নত করতে থাকবে। একেকজন হয়ে উঠবে একজন ট্রয়-যোদ্ধা।
প্রচলিত রীতি অনুসারে আমাকে বক্তা হিসেবে তোমাদের কিছু উপদেশ দিতে হচ্ছে। উপদেশ দিতে হলে অনেক আত্মবিশ্বাস থাকতে হয়। অস্বস্তির পরেও আমাকে কথা বলতে হচ্ছে। আমি মনে করি, উপদেশ থেকেও আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসই তোমাদের মনোযোগ আর্কষণ করবে। আমি শুধু তোমাদের একটি বিশ্বাসের কথা বলতে চাই। মাঝেমধ্যে অনেক কিছু তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার জন্য তোমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে পারে। তোমার অর্থ-সম্পত্তি কোনো না কোনোভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে। তোমার কাছ থেকে শুধু একটা জিনিসই তোমার অনিচ্ছায় হারিয়ে যেতে পারবে না, সেটা হলো তোমার নীতিবোধ, তোমার আদর্শ। এটাই তোমার দখলে যেসব জিনিস আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি যদি তোমার ভেতরের নীতিবোধগুলোকে পরিচর্যা করতে থাকো, সতর্কতার সঙ্গে নির্মাণ করতে পারো তোমার ব্যক্তি-আদর্শ, তা হলেই তুমি ট্রয়বাসীর মতোই সফল। এই নীতিবোধ, আদর্শই তোমাকে পরিচালনা করবে, তোমার সমাজকে পরিচালিত করবে। সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে মানব চরিত্রের নীতিবোধ, আদর্শের ওপর। ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কী নিয়ে আসবে? সেটা আমি জানি না, কিন্তু যা আনবে তা নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর ও দুঃসাহসিক।
ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য নিজের জ্ঞান-মেধাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাও, তাকে নিয়ে কোনো ধরনের পূর্বধারণার দরকার নেই। ট্রয়বাসীকে ছাপিয়ে তোমার পরিশ্রমের ওপরই নির্মাণ করা হবে আগামীর সমাজ, দেশ, নতুন সভ্যতা।
সবাইকে ধন্যবাদ, সবার জন্য শুভ কামনা।
সূত্র: ওয়েবসাইট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর: জাহিদ হোসাইন
No comments