মহাশূন্যে মানুষের নতুন ঠিকানা by ইকবাল আজিজ
গত শতকের ষাটের দশক নানা কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ষাটের দশকের শুরুতে রুশ নভোচারী গ্যাগারিন প্রথম নভোযানে করে মহাশূন্যে যান। এর ফলে মহাকাশ বিজ্ঞানচর্চায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। লাখ লাখ বছর ধরে যে বিশাল আকাশ, গ্রহ, নক্ষত্র, তারা, ছায়াপথ এক অন্তহীন রহস্যের জগত তৈরি করেছিল- তা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে মানুষের সামনে, যা নিয়ে অনেক রূপকথা, কল্পকাহিনী রচিত হয়েছে।
আজ যেন তা যেন মানুষের কাছে এসে ডাক দেয়। তবে এ সময় ছিল সারা পৃথিবীতে ঠা-া লড়াইয়ের যুগÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সারাবিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সেইসঙ্গে অবশ্য ছিল আরও একটি বিশ্বÑ আমাদের মতো দুর্বল ও অসহায় দেশগুলোকে নিয়ে তৃতীয় বিশ্ব। বস্তুত সে সময় মহাশূন্যে অভিযান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এক অঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে মানুষের মহাকাশ অভিযাত্রায় এক অবিস্মরণীয় সাফল্য অর্জিত হয়। তখন সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। সেদিনের কথা আমার আজও মনে আছে; ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই এ্যাপোলো-১১ মহাশূন্যযানের কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রং ও কো-পাইলট অলড্রিন তাঁদের লুনার মডিউল ঈগল যোগে চাঁদের বুকে অবতরণ করেন। তখন আমি কুষ্টিয়া শহরে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে; সকালবেলায় বাইরের বসার ঘরে বাবা ও প্রতিবেশী আরও দু-একজনের সঙ্গে ট্রানজিসটরের মাধ্যমে মানবজাতির এ অবিস্মরণীয় বিজয়ের খবরটি শুনেছিলাম। তখন নিয়মিত বিদেশী বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনতাম। সেদিন রাতে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠানে কাফি খান ঘোষণা করেছিলেন, বাংলা অনুষ্ঠানের শ্রোতারা ইচ্ছা করলে চন্দ্র বিজয়ী তিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, বুজ অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্সের এক সাথে তোলা ছবি পেতে পারেন; তবে তাদের ঢাকার মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে চিঠি লিখতে হবে। চিঠি লেখার তিন চারদিনের মধ্যে আমার ঠিকানায় তিন চন্দ্রবিজয়ীর ছবি এসে হাজির। সে দিনটি ছিল বড়ই আনন্দের। আমাদের সমকালীন ছোট বড় অনেকেরই হয়ত এই আনন্দের স্মৃতি মনে আছে। আসলে মানুষের সেই চন্দ্র বিজয়ের ঘটনা অনেককেই মুগ্ধ করেছিল।
এরপরও গত প্রায় ৪২ বছর ধরে মানুষের মহাশূন্য অভিযান অব্যাহত আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়ার মহাশূন্য অভিযান কর্মসূচী এখন আর আগের মতো জোরদার নেই। তবে মহাশূন্য অভিযানে আরও অনেক দেশের অংশগ্রহণ বেড়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা গঠিত হয়েছে। চীন, ভারতসহ আরও কিছু দেশ মহাকাশ অভিযান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ; চীন ইতোমধ্যে তার নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে মহাশূন্যে মনুষ্যবাহী নভোযান পাঠিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমার কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো মহাশূন্যে ‘আন্তর্জাতিক মহাশূন্য স্টেশন’ প্রতিষ্ঠা। এ নিয়ে তেমন সার্বক্ষণিক প্রচার নেই; মহাকাশ গবেষণায় একে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে চিহ্নিত করা যায়। এই স্টেশনে মাসের পর মাস তিন চারজন মহাকাশ বিজ্ঞানী কিংবা নভোচারী অবস্থান করেন; সুনির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পালাক্রমে নতুন নভোচারীদের পাঠানো হয় এবং পুরনোদের ফিরিয়ে আনা হয়। একই সঙ্গে নভোযানের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে মহাশূন্য স্টেশনে নিয়মিত খাদ্য ও অন্যান্য রসদ পাঠানো হয়। সেখানে জার্মান, ব্রিটিশ, ফরাসী, চীনা, জাপানী, ভারতীয় প্রায় সব দেশের নভোচারী গেছেন। অপেক্ষায় আছি, কবে একজন বাঙালী নভোচারী ‘মহাশূন্য স্পেস স্টেশনে’ যাওয়ার সুযোগ পাবেন। মানবজাতির স্বার্থেই মহাশূন্য অভিযান আরও বেশি জোরদার হওয়া উচিত।
দীর্ঘকাল প্রতীক্ষার পরে মঙ্গলগ্রহে নেমেছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসার রোবটযান রোভার কিউরিসিটি। গত ৬ আগস্ট মঙ্গলগ্রহে সাফলজনকভাবে অবতরণ করে এ যানটি। ঘটনাটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সারা পৃথিবীতে ফলাও করে খবরটি প্রচার হয়েছে। কেমন যেন অবসাদে ঝিমিয়ে পড়েছিল মানবজাতির মহাশূন্য অভিযান। তাই রোবটযান কিউরিসিটির মঙ্গলে নামার ঘটনায় আরও অনেকের মতো আমিও উল্লসিত হয়েছি। জানা গেছে, কিউরিসিটির মঙ্গলে অবতরণ নিয়ে রীতিমতো উৎকণ্ঠা ছিল নাসার বিজ্ঞানীদের মধ্যে। কিউরিসিটি অবতরণের ঘোষণার পর নাসার বিজ্ঞানীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। মঙ্গল গবেষণার ইতিহাসে এটিই এখন পর্যন্ত নাসার বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। রোবট যানটির ওজন প্রায় এক টন। এই প্রথম নাসা এত বেশি ওজনের যান কোন গ্রহে সফলভাবে নামাতে সক্ষম হলো।
মঙ্গলের আবহাওয়াম-লে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে মহাকাশযানটির গতি ছিল ঘণ্টায় ১৩ হাজার ২০০ মাইল। সুপারসনিক প্যারাসুটের সাহায্যে গতি কমানো হয়। এরপর ক্রেনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ছয় চাকায় ভর করে ভূমিতে নামে রোভার। অবতরণের জায়গাটি নাসার বিজ্ঞানীরা আগেই বেছে নিয়েছিলেন। এখানে অতীতে পানি থাকার অনেক চিহ্ন পাওয়া গেছে। আগামী দু’বছর রোবটযান কিউরিসিটি মঙ্গলের গিরিখাদের তলা থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠবে। এটি মঙ্গল গ্রহের পাথুরে ভূমি খুঁড়ে দেখবে, সেখানে প্রাণের বিকাশের কোন পরিবেশ আছে কি না। মঙ্গলে অবস্থানকালে পারমাণবিক শক্তিতে চলবে কিউরিসিটি। এই রোবটযানে আছে নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। আছে ক্যামেরা, আবহাওয়া নিরীক্ষণ কেন্দ্র, শক্তিশালী ড্রিলসহ রোবটিক হাত, দূর থেকে পাথর চূর্ণ বিচূর্ণ করতে সক্ষম লেজার, রাসায়নিক গবেষণাগার ও বিকিরণ মাপার যন্ত্র।
কিউরিসিটি মঙ্গলে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাবেÑ বিজ্ঞানীরা এমনটা প্রত্যাশ করছেন না। তবে তাঁরা আশা করছেন, কিউরিসিটির মাধ্যমে মঙ্গলের মাটি ও পাথর গবেষণা করে তাঁরা জানতে পারবেন, সেখানে অতীতে প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল কিনা। ২০১১ সালের নবেম্বর মাসে ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভারেল থেকে যাত্রা শুরু করে কিউরিসিটি। গত সাড়ে ৮ মাসের যাত্রাপথে যানটি ইতোমধ্যে বিকিরণের ওপর নানা তথ্য সংগ্রহ করেছে। পৃথিবী থেকে মঙ্গলের পথে কিউরিসিটি প্রায় ৩৫ কোটি ২০ লাখ মাইল পাড়ি দিয়েছে। ১২ বছরের প্রস্তুতি শেষে কিউরিসিটি, প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে ২৫০ কোটি ডলার।
বহুকাল পরে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে সেই ষাট দশকীয় উচ্ছ্বাস ও কৌতূহল আবার সঞ্চারিত হয়েছে অনেকের মধ্যে। মঙ্গলগ্রহে প্রেরিত মার্কিন রোবটযান ‘কিউরিসিটি’ বাস্তবিকই এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে জড়িত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, জাপান, কিংবা ভারতকে একটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে হবে, বিশ্ববাসীর আগামীদিনের ভয়ঙ্কর জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্যই দরকার মহাকাশ গবেষণাকে জোরদার করা। কারণ গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে বিশ্বে জনসংখ্যা বিপুলভাবে বেড়েছে; কিন্তু সেই অনুযায়ী থাকার জায়গা ও সম্পদ বাড়েনি। অপরদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে এবং পরিবেশ বিপর্যয় মারাত্মক রূপ নিয়েছে। বিদ্যুত ও জ্বালানি সঙ্কট আগের তুলনায় তীব্রতর হয়েছে। বিপন্ন পৃথিবীকে রক্ষা করতে এবং নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মানুষকে এখন মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়তে হবে। মানুষের চন্দ্র বিজয়ের পর এ রকম একটি ধারণা অনেকেই পোষণ করতেন। কিন্তু ১৯৭২ সালে এ্যাপোলো-১৭ অভিযানের পর চাঁদে মানুষের অভিযান পরিত্যক্ত হয়। হঠাৎ করে অভিযান পরিত্যক্তের সিদ্ধান্তটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারণ ১৯৬৯ সালে চন্দ্র বিজয়ের পর চাঁদে নানা পর্যায়ে মানুষের বসতি ও অবকাঠামো গড়ে উঠবে-এমনটাই ছিল সবার প্রত্যাশা। একটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে পড়েছিলাম, চাঁদে কিছু সুনির্দিষ্ট এলাকায় মানুষের বসবাসের উপযোগী পরিবেশও গড়ে তোলা হবে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে চন্দ্র অভিযান পরিত্যক্ত হয়। আমাদের অনেকেরই প্রত্যাশা মানুষের কল্যাণে আবার নতুনভাবে শুরু হোক চন্দ্র অভিযান।
কিউরিসিটি মঙ্গলগ্রহে তার কার্যক্রম শুরু করেছে। অনেকেই চায়, এই লালগ্রহ ঘিরে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান অব্যাহত থাকুক। সবকিছুই পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির দৃষ্টিতে দেখা বাস্তবিকই আত্মঘাতী, এ ধরনের মনোভাব আমাদের ক্ষতিই করবে। তাই পৃথিবীতে মানবজাতির একাংশের দারিদ্র্য ও দুর্দশা দূর করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানচর্চা জোরদার করা দরকার। মানবকল্যাণ হওয়া উচিত মহাকাশ বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম মূল লক্ষ্য। মহাকাশ অফুরন্ত শক্তির উৎস। এই শক্তিকে মানুষের কাজে লাগাতে হবে। মানুষ এই পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি; পৃথিবীর অন্য প্রাণীর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি সৃজনশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতাই তাকে আর সবকিছু থেকে আলাদা করেছে। মহাকাশ বিজ্ঞানচর্চায় কোন হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাম্য নয়; বরং প্রয়োজন কল্যাণবোধ ও সহযোগিতা। হয়ত মানুষের মতো কোন সৃজনশীল প্রাণী ভালোবাসা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বসে আছে লক্ষ্য বর্ষ দূরের কোন গ্রহে। তাদের সঙ্গে যে কোন মুহূর্তে যোগাযোগ হতে পারে। অন্তহীন রহস্যে ঘেরা এই মহাবিশ্বে কোন ইতিবাচক সম্ভাবনাকেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে অবশ্যই মানুষের নতুন ঠিকানা গড়ে উঠবে।
iqbalaziz.post@gmail.com
এরপরও গত প্রায় ৪২ বছর ধরে মানুষের মহাশূন্য অভিযান অব্যাহত আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়ার মহাশূন্য অভিযান কর্মসূচী এখন আর আগের মতো জোরদার নেই। তবে মহাশূন্য অভিযানে আরও অনেক দেশের অংশগ্রহণ বেড়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা গঠিত হয়েছে। চীন, ভারতসহ আরও কিছু দেশ মহাকাশ অভিযান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ; চীন ইতোমধ্যে তার নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে মহাশূন্যে মনুষ্যবাহী নভোযান পাঠিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমার কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো মহাশূন্যে ‘আন্তর্জাতিক মহাশূন্য স্টেশন’ প্রতিষ্ঠা। এ নিয়ে তেমন সার্বক্ষণিক প্রচার নেই; মহাকাশ গবেষণায় একে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে চিহ্নিত করা যায়। এই স্টেশনে মাসের পর মাস তিন চারজন মহাকাশ বিজ্ঞানী কিংবা নভোচারী অবস্থান করেন; সুনির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পালাক্রমে নতুন নভোচারীদের পাঠানো হয় এবং পুরনোদের ফিরিয়ে আনা হয়। একই সঙ্গে নভোযানের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে মহাশূন্য স্টেশনে নিয়মিত খাদ্য ও অন্যান্য রসদ পাঠানো হয়। সেখানে জার্মান, ব্রিটিশ, ফরাসী, চীনা, জাপানী, ভারতীয় প্রায় সব দেশের নভোচারী গেছেন। অপেক্ষায় আছি, কবে একজন বাঙালী নভোচারী ‘মহাশূন্য স্পেস স্টেশনে’ যাওয়ার সুযোগ পাবেন। মানবজাতির স্বার্থেই মহাশূন্য অভিযান আরও বেশি জোরদার হওয়া উচিত।
দীর্ঘকাল প্রতীক্ষার পরে মঙ্গলগ্রহে নেমেছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসার রোবটযান রোভার কিউরিসিটি। গত ৬ আগস্ট মঙ্গলগ্রহে সাফলজনকভাবে অবতরণ করে এ যানটি। ঘটনাটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সারা পৃথিবীতে ফলাও করে খবরটি প্রচার হয়েছে। কেমন যেন অবসাদে ঝিমিয়ে পড়েছিল মানবজাতির মহাশূন্য অভিযান। তাই রোবটযান কিউরিসিটির মঙ্গলে নামার ঘটনায় আরও অনেকের মতো আমিও উল্লসিত হয়েছি। জানা গেছে, কিউরিসিটির মঙ্গলে অবতরণ নিয়ে রীতিমতো উৎকণ্ঠা ছিল নাসার বিজ্ঞানীদের মধ্যে। কিউরিসিটি অবতরণের ঘোষণার পর নাসার বিজ্ঞানীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। মঙ্গল গবেষণার ইতিহাসে এটিই এখন পর্যন্ত নাসার বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। রোবট যানটির ওজন প্রায় এক টন। এই প্রথম নাসা এত বেশি ওজনের যান কোন গ্রহে সফলভাবে নামাতে সক্ষম হলো।
মঙ্গলের আবহাওয়াম-লে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে মহাকাশযানটির গতি ছিল ঘণ্টায় ১৩ হাজার ২০০ মাইল। সুপারসনিক প্যারাসুটের সাহায্যে গতি কমানো হয়। এরপর ক্রেনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ছয় চাকায় ভর করে ভূমিতে নামে রোভার। অবতরণের জায়গাটি নাসার বিজ্ঞানীরা আগেই বেছে নিয়েছিলেন। এখানে অতীতে পানি থাকার অনেক চিহ্ন পাওয়া গেছে। আগামী দু’বছর রোবটযান কিউরিসিটি মঙ্গলের গিরিখাদের তলা থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠবে। এটি মঙ্গল গ্রহের পাথুরে ভূমি খুঁড়ে দেখবে, সেখানে প্রাণের বিকাশের কোন পরিবেশ আছে কি না। মঙ্গলে অবস্থানকালে পারমাণবিক শক্তিতে চলবে কিউরিসিটি। এই রোবটযানে আছে নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। আছে ক্যামেরা, আবহাওয়া নিরীক্ষণ কেন্দ্র, শক্তিশালী ড্রিলসহ রোবটিক হাত, দূর থেকে পাথর চূর্ণ বিচূর্ণ করতে সক্ষম লেজার, রাসায়নিক গবেষণাগার ও বিকিরণ মাপার যন্ত্র।
কিউরিসিটি মঙ্গলে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাবেÑ বিজ্ঞানীরা এমনটা প্রত্যাশ করছেন না। তবে তাঁরা আশা করছেন, কিউরিসিটির মাধ্যমে মঙ্গলের মাটি ও পাথর গবেষণা করে তাঁরা জানতে পারবেন, সেখানে অতীতে প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল কিনা। ২০১১ সালের নবেম্বর মাসে ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভারেল থেকে যাত্রা শুরু করে কিউরিসিটি। গত সাড়ে ৮ মাসের যাত্রাপথে যানটি ইতোমধ্যে বিকিরণের ওপর নানা তথ্য সংগ্রহ করেছে। পৃথিবী থেকে মঙ্গলের পথে কিউরিসিটি প্রায় ৩৫ কোটি ২০ লাখ মাইল পাড়ি দিয়েছে। ১২ বছরের প্রস্তুতি শেষে কিউরিসিটি, প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে ২৫০ কোটি ডলার।
বহুকাল পরে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে সেই ষাট দশকীয় উচ্ছ্বাস ও কৌতূহল আবার সঞ্চারিত হয়েছে অনেকের মধ্যে। মঙ্গলগ্রহে প্রেরিত মার্কিন রোবটযান ‘কিউরিসিটি’ বাস্তবিকই এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে জড়িত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, জাপান, কিংবা ভারতকে একটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে হবে, বিশ্ববাসীর আগামীদিনের ভয়ঙ্কর জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্যই দরকার মহাকাশ গবেষণাকে জোরদার করা। কারণ গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে বিশ্বে জনসংখ্যা বিপুলভাবে বেড়েছে; কিন্তু সেই অনুযায়ী থাকার জায়গা ও সম্পদ বাড়েনি। অপরদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে এবং পরিবেশ বিপর্যয় মারাত্মক রূপ নিয়েছে। বিদ্যুত ও জ্বালানি সঙ্কট আগের তুলনায় তীব্রতর হয়েছে। বিপন্ন পৃথিবীকে রক্ষা করতে এবং নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মানুষকে এখন মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়তে হবে। মানুষের চন্দ্র বিজয়ের পর এ রকম একটি ধারণা অনেকেই পোষণ করতেন। কিন্তু ১৯৭২ সালে এ্যাপোলো-১৭ অভিযানের পর চাঁদে মানুষের অভিযান পরিত্যক্ত হয়। হঠাৎ করে অভিযান পরিত্যক্তের সিদ্ধান্তটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারণ ১৯৬৯ সালে চন্দ্র বিজয়ের পর চাঁদে নানা পর্যায়ে মানুষের বসতি ও অবকাঠামো গড়ে উঠবে-এমনটাই ছিল সবার প্রত্যাশা। একটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে পড়েছিলাম, চাঁদে কিছু সুনির্দিষ্ট এলাকায় মানুষের বসবাসের উপযোগী পরিবেশও গড়ে তোলা হবে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে চন্দ্র অভিযান পরিত্যক্ত হয়। আমাদের অনেকেরই প্রত্যাশা মানুষের কল্যাণে আবার নতুনভাবে শুরু হোক চন্দ্র অভিযান।
কিউরিসিটি মঙ্গলগ্রহে তার কার্যক্রম শুরু করেছে। অনেকেই চায়, এই লালগ্রহ ঘিরে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান অব্যাহত থাকুক। সবকিছুই পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির দৃষ্টিতে দেখা বাস্তবিকই আত্মঘাতী, এ ধরনের মনোভাব আমাদের ক্ষতিই করবে। তাই পৃথিবীতে মানবজাতির একাংশের দারিদ্র্য ও দুর্দশা দূর করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানচর্চা জোরদার করা দরকার। মানবকল্যাণ হওয়া উচিত মহাকাশ বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম মূল লক্ষ্য। মহাকাশ অফুরন্ত শক্তির উৎস। এই শক্তিকে মানুষের কাজে লাগাতে হবে। মানুষ এই পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি; পৃথিবীর অন্য প্রাণীর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি সৃজনশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতাই তাকে আর সবকিছু থেকে আলাদা করেছে। মহাকাশ বিজ্ঞানচর্চায় কোন হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাম্য নয়; বরং প্রয়োজন কল্যাণবোধ ও সহযোগিতা। হয়ত মানুষের মতো কোন সৃজনশীল প্রাণী ভালোবাসা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বসে আছে লক্ষ্য বর্ষ দূরের কোন গ্রহে। তাদের সঙ্গে যে কোন মুহূর্তে যোগাযোগ হতে পারে। অন্তহীন রহস্যে ঘেরা এই মহাবিশ্বে কোন ইতিবাচক সম্ভাবনাকেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে অবশ্যই মানুষের নতুন ঠিকানা গড়ে উঠবে।
iqbalaziz.post@gmail.com
No comments