চিনির পাটালিগুড় by হাসান হাফিজ

ঈশ্বরদী শহর ও আশপাশের হাটবাজারগুলো আজকাল ভেজাল খেজুরের গুড়ে সয়লাব। পাটালি গুড় নকল হচ্ছে ইদানীং। কম দামে চিনি কিনে খেজুরের রসের সঙ্গে মিশিয়ে নকল পাটালি তৈরি করা হচ্ছে। বেধড়ক খেজুর গাছ কাটা চলছে। ইট ভাটায় পুড়ছে সেসব। ফলে রসের বড্ড আকাল। মাত্র চার মাসের পেশা, গাছিরাও এই পেশায় আগ্রহী নয় তেমন। পাটালি নিয়ে ভেজালের কায়কারবারে ফাটাফাটি চলছে।

স্থানীয় কিছু বঙ্গসন্তানের মাথায় উত্তম বুদ্ধির প্রতিফলন এই কাণ্ড। দিনবদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের উদ্ভাবনী প্রতিভার তারিফ করতেই হয়। যারা এ ব্যাপারে কার্পণ্য দেখাতে চায়, তারা উন্নয়নের শত্রু। দেশের ভালো চায় না তারা। উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ দিয়ে আমরা ডিজিটালি প্রমাণ করতে সক্ষম যে তারা দেশের কত উপকার করছে। কারণগুলো আমরা একে একে খতিয়ে দেখতে পারি।
১. খেজুর গাছ অকারণে কাঁটায় ভর্তি থাকে। এর পাতা গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে কাজে লাগে না। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি এলাকা খেজুর গাছশূন্য করে ফেলা যায়, ততই মঙ্গল। ইট ভাটায় কয়লা জোগান দিতে মালিকদের জান কয়লা হয়ে যায়। জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছই উত্তম। তাতে খরচ কম।
২. গুড়ের তৈরি পদ্ধতি এনালগ। মান্ধাতার আমল থেকে হাতে বানানো হয়ে আসছে। দিনবদলের স্বার্থে এখানে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা আবশ্যক। চিনি কারখানায় উত্পাদিত হয়, সেজন্য গুড়ে চিনি মেশালে কিছুটা হলেও ডিজিটালত্ব আসে। এক ধাপ অগ্রগতি অর্জিত হয়।
৩. চিনি দিলে গুড়ের মধ্যে কিঞ্চিত্ ফর্সা ভাব আসে। না না, আমরা ইউরিয়া ব্যবহারের পক্ষপাতী না। এমনিতেই গরুসমাজ ইউরিয়া সারের ব্যাপক অপব্যবহারে অতিষ্ঠ। ফর্সা যে কোনো জিনিসের প্রতি আমাদের জাতীয় দুর্বলতা মজ্জাগত। আমাদের পূর্বপুরুষরা মূর্খ ছিলেন বলেই ‘জাতের মেয়ে কালোও ভালো’ জাতীয় প্রবাদ-প্রবচনের চল করে গেছেন। সেই মূর্খতা থেকে নিজেদের মুক্ত করার সময় এসে গেছে। এটা একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ।
৪. এই মডেল নিশ্চিন্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাতে ব্যবসায়ী সমাজ টু পাইস হাতিয়ে নিতে পারবে। ব্যবসায়ী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। গ্রাম পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর মতো লোকবল প্রশাসনের নেই। সুতরাং এই মডেল প্রসারিত হলে কোনো হাঙ্গামা বা ঝুঁকিও নেই।
৫. ব্যাপক হারে নকল পাটালিতে বাজার ভরলে কূটনৈতিক সুবিধাও কিছু আছে। চিনির ব্যবহার বাড়ছে দেশে। পড়শি দেশ থেকে দেদারসে চিনি বেড়াতে আসতে পারছে। এমনটা অবাধে চললে ফায়দা আছে। পড়শি আমাদের ওপর নাখোশ থাকতে পারবে না। দুই দেশের মৈত্রী জোরদার হবে দিনকে দিন। বিডিআর-বিএসএফ সংঘাত দূর হবে। শীর্ষ বৈঠকের অব্যবহিত পরপরই জৈন্তাপুরে হামলা, গোলাগুলির মতো দুঃখজনক ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তি রোধ হয়তো হয়ে যাবে। ভাইসব, আমরা আশাবাদী। যেমন আমরা তিস্তা ও পদ্মা নদীর প্রবাহে ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে নির্লজ্জভাবে আশাবাদী।
৬. গাছিরা পেশা বদল করতে চাচ্ছে। কাছা বেঁধে গাছে উঠে তারা রস পাড়তে অনিচ্ছুক। এমন অচ্ছুত পেশায় মোটেও পোষাচ্ছে না তাদের। ধাঁই ধাঁই করে দিনই যখন বদল হয়ে যাচ্ছে, তখন বেচারা গাছিরা তো পেশা বদল করতে চাইতেই পারে। এটা তাদের জন্মগত ও মৌলিক অধিকার। আমরা জেনেশুনে এর বিরুদ্ধে যেতে পারি না। রীতিমত অধর্ম হবে।
৭. ম্যানুয়ালি পাটালি বানাতে অযথাই হাজারে বিজারে শ্রম-ঘণ্টার অপচয় হচ্ছে। চিনির ব্যবহার বাড়লে সেই অপচয় থামবে। সংশ্লিষ্ট মানবসম্পদকে আমরা তখন উন্নয়নের অন্য কাজে লাগাতে পারব।
৮. গুড় নিয়ে আমাদের কিছু আদিখ্যেতা আছে। পর্যায়ক্রমে সেই কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুন প্রজন্মকে উপযুক্ত ‘শিক্ষা’ দিতে হবে। ‘শিক্ষা’ বিষয়ক রাজনীতির এখন রমরমা। গণহারে নাম বদলানোর জাতিগত স্বভাব-আচরণও বদলাতে হবে। প্রবাদের মধ্যে উল্লেখ করা যায় এমন নমুনা—লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়, সে গুড়ে বালি ইত্যাদি।
৯. ভেজাল গুড়ের বিক্রিবাট্টায় এক শ্রেণীর পুলিশ ভাই অল্পবিস্তর বখরা পাচ্ছে। এই দুর্দিনে সেসব বাটোয়ারার মালকড়ি তাদের জীবনযাপনে বহুত কাজে লাগছে। সরকারি বেতনে তো পেট চলে না। এদিক-ওদিক করতে হয় সেজন্য। চক্ষুলজ্জার কারণে কোনো অভিযান বা ধরপাকড় তারা চালাচ্ছে না।
দশ নম্বর যুক্তির ধার আমরা এই মুহূর্তে ধারতে নারাজ। তার বদলে (বদলই যখন দেশের চলতি ধারা, যস্মিন দেশে যদাচার!) একটা কৌতুক দিয়ে এই লেখা শেষ করি। এক লোক বেশ দামি হাতির দাঁতের তৈরি একটা চিরুনি কিনল। বাড়িতে নিয়ে দেখে সেটা ভেজাল। চুল আঁচড়ানোর সময় পট করে ভেঙে গেল সেটা। পরের দিন দোকানিকে পাকড়াও করলে সে। দোকানি বিরস মুখে জবাব দেয়—আমার কিছু করার নাই ভাই সাহেব। হাতির দাঁতটা যে বাঁধানো ছিল, সেটা আমি নিজেই জানতাম না!
hasanhafiz51@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.