মেক্সিকোর ইতিহাস, ব্রাজিলের স্বপ্নভঙ্গ by ফারজানা আক্তার সাথী

ফেবারিটের তকমা ছিল তাদের গায়েই। সবাই ভেবেছিল এবার বুঝি অধরা স্বর্ণ জয় করতে যাচ্ছে তারা। কারণ দলে ছিল তরুণ স্ট্রাইকার নেইমারসহ ড্যামিয়াও, ওস্কার, মার্সেলো, হাল্কের মতো ফর্মে থাকা খেলোয়াড়রা। তবে শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। লন্ডন অলিম্পিকের পুরুষ ফুটবলে হতাশ হয়েই বিদায় নিতে হয়েছে ব্রাজিলকে।


আর ইতিহাস সৃষ্টি করেছে মেক্সিকো। প্রথমবারের মতো ফাইনালে এসেই জিতেছে তারা স্বর্ণ (২-১)। আর পুরো টুর্নামেন্ট ছন্দে থেকেও শেষ পর্যন্ত রৌপ্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে পেলের উত্তরসূরিদের। মেক্সিকোর ইতিহাসে ব্রাজিল স্বপ্ন পিষ্ট হওয়ায় সমালোাচনার তীর ধেয়ে ছুটে আসছে কোচ মানো মেনেজেসের দিকে। অনেকেই বলছেন, দূর হটো মেনেজেস, নতুন কোচ হিসেবে আসুক লুইস ফিলিপ সোলারি। রোমারিও তো পরিষ্কার করেই বলেছেন, মেনেজেসের সরে দাঁড়ানো উচিত। তবে মেনেজেস আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, এই শোককে আমরা শক্তিতে পরিণত করে জিতব ২০১৪ বিশ্বকাপ। বরখাস্ত কিংবা বিরূপ কোচ কিছুরই প্রত্যাশা করছি না। তবে উল্টো চিত্র মেক্সিকান শিবিরে। প্রথমবারের মতো স্বর্ণ জিতে ইতিহাস গড়তে পেরে আনন্দের সীমা নেই মেক্সিকান যুবাদের মনে।
বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলের আধিপত্য সবারই জানা। রেকর্ড ৫টি বিশ্বকাপসহ নানা ট্রফি তারা জিতেছে নান্দনিক ছন্দে। সেই ব্রাজিল অলিম্পিক ফুটবলে স্বর্ণ বঞ্চিত। ব্যাপারটি কৌতূহলোদ্দীপক হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। কারণ এখানে মূল দল নয়, খেলে থাকে অনুর্ধ-২৩ দল। তবে এবার ব্রাজিলের দলটি ছিল বেশ ভারস্যামপূর্ণ। দলে ছিলেন ক’জন উঠতি তারকা ফুটবলার। নেইমার, ওস্কার, ড্যামিওদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন অভিজ্ঞ হাল্ক ও মার্সেলো। প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিতেই যেন ভালবাসে তারা। গ্রুপ পর্ব থেকেই তার আঁচ পাওয়া গেছে। টানা তিন ম্যাচে জয় নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে তারা। প্রথম ম্যাচে মিসরকে ৩-২ গোলে, দ্বিতীয় ম্যাচে বেলারুশকে ৩-১ গোলে ও তৃতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে ব্রাজিল। ফলে সি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শেষ আটে নাম লেখায় ব্রাজিল। তবে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্ব পার হতে ব্রাজিলকে ভাল কষ্টই করতে হয়েছে। এখানে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল হন্ডুরাস। ধুন্ধুমার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত ব্রাজিল জেতে ৩-২ গোলে। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ছিল দুরন্ত ছন্দে থাকা দক্ষিণ কোরিয়া। তবে সেমির লড়াইয়ে সেই কোরিয়ানরা পাত্তা পায়নি নেইমারদের কাছে। বলতে গেলে উড়ে গেছে খড়কুটোর মতো (৩-০)। ফাইনালে আসার পথে প্রত্যেকটি ম্যাচেই তিনের অধিক গোল দিয়েছে ব্রাজিল। সেখানে ফাইনালে তারাই হারবে ২-১ গোলে। বিষয়টি অনেকে কল্পনায় না আনলেও তাই হয়েছে। ২৯ সেকেন্ডেই রাফায়েলের ভুল ব্যাক পাসে ব্রাজিলের বুকে শেল বিঁধান মেক্সিকোর ওরিবে পেরাল্টা। ৭৫ মিনিটে হেড করে এই পেরাল্টাই ব্যবাধান করেন দ্বিগুণ। ব্রাজিল তখন যেন ছন্নছাড়া কোন দল। তবে অতিরিক্ত সময়ে হাল্কের একটি গোল আশা জাগায় সেলেকাওদের। তবে স্বল্প সময়ে আর কিছুই করা হয়ে ওঠেনি ব্রাজিলের। সন্তুষ্ট থাকতে হয়ে রৌপ্য পদক নিয়েই। অলিম্পিক ফুটবলে এটি তৃতীয় রৌপ্য ব্রাজিলের।
স্বর্ণ জিততে না পারার কারণে তোপের মুখে ব্রাজিল কোচ। তবে তিনি বলেছেন, ‘এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে সব কোচই প্রস্তুত থাকে। জিতলে লোকে শুধু কোচের প্রশংসা করে না, বেশি করে থাকে দলের। একটি ম্যাচের পরাজয় সবকিছু নির্ধারণ করে না। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট ভাল খেলেছি। একটি ম্যাচই সর্বনাশ করেছে। তবে হারের মধ্যেও অনেক কিছু শেখার থাকে। আশা করি এই তিক্ত অভিজ্ঞতা কাজে দেবে আগামী ২০১৪ ঘরের মাঠে বিশ্বকাপে।’ স্বর্ণ না জেতার আহাজারি মেনেজেসের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে, ‘আমরা ভীষণ দুঃখিত স্বর্ণ জিততে না পারায়। তবে মূল দলের সাহায্যে ভাল করার প্রত্যাশ করছি ব্রাজিল বিশ্বকাপে। একটা জিনিস গুরুত্বপূর্ণ, সঠিক সংশোধন আপনাকে সাফল্যে এনে দেবে।’ পরাজিত হলেও মেক্সিকোর প্রশংসা করেছেন মেনেজেস। তাঁর মতে, যোগ্য দল হিসেবেই স্বর্ণ জিতেছে তারা। অন্যদিকে বিরহে কাতর ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার নেইমার বলেছেন, ‘ভাল খেলেই জিতেছে মেক্সিকো। ফুটবলে হার-জিত দুই-ই থাকবে। আমরা কতটা ভাল খেলতে পেরেছি, এটা কোন ব্যাপার নয়। আমরা এখনও তরুণ, ভেঙ্গে পড়িনি। পরবর্তী লক্ষ্যের দিকে তাকাতে হবে আমাদের।’ অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা বলেন, ‘কঠিন সময়ে সবাইকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। এই তরুণ দলের খেলোয়াড়দের পুরো জীবনটাই সামনে পড়ে আছে। আশা করছি, আগামী বছরের কনফেডারেশন্স কাপ আমাদের হবে।’ অন্যদিকে মেক্সিকোর হয়ে ইতিহাস গড়া কোচ লুইস ফার্নান্ডো টেনা বলেছেন, ‘এটা মেক্সিকান ফুটবলে স্মরণীয় একটা মুহূর্ত। আমাদের ফুটবলাররা সব সময়ই ছিল ইতিবাচক। পেছনে হতাশাকে কখনও প্রশ্রয় দেয়নি তারা। তারা সত্যিকারের বীর। আমার জন্যও বড় পাওয়া এই সাফল্য। আমি এই সাফল্য উৎসর্গ করতে চাই আমার মৃত বাবাকে। যিনি এখনও স্বর্গে বসে ফুটবলে কিক মারছেন।’ পুরুষ ফুটবলে অঘটন হলেও মহিলা ফুটবলে ঠিকই নিজেদের আধিপত্য দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হতে পারত বিশ্বকাপ ফাইনালের পুনর্মঞ্চায়ন। কিন্তু হয়নি। জাপানকে কাঁদিয়ে লন্ডন অলিম্পিকের মহিলা ফুটবলের স্বর্ণ জেতে মার্কিন মেয়েরাই। ওয়েম্বলিতে রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচ জেতে ২-১ গোলে। একমাত্র দল হিসেবে টানা তিন আসরে স্বর্ণ জেতার নৈপুণ্য দেখাল মার্কিন মেয়েরা। সব মিলিয়ে অলিম্পিকে তাদের স্বর্ণ এখন ৪টি। ১৯৯৬ সাল থেকে চালু হওয়া এই ইভেন্টের মোট পাঁচটি আসরে একবারই শুধু যুক্তরাষ্ট্র রানার্সআপ হয়েছে (২০০০ এথেন্স অলিম্পিকে)। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়েই ২০১০ মহিলা ফুটবল বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল জাপান। কিন্তু লন্ডন অলিম্পিকে সেই ধারায় হাঁটতে পারেনি তারা। উল্টো বিশ্বকাপের হারের প্রতিশোধটা ভালমতোই নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েরা। আর প্রথমবারের মতো ফাইনালে এসে রৌপ্য নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে জাপানিজ মেয়েদের। তুখোড় ফর্মে থাকা স্ট্রাইকার ওয়ামব্যাচ, নির্ভরযোগ্য গোলরক্ষক হোপ সোলো, ক্রিস্টি রামপোনদের গড়া যুক্তরাষ্ট্র দল এবার লন্ডন অলিম্পিকে ছিল আসলেই অপ্রতিরোধ্য। প্রতি ম্যাচে তারা জিতেছে দাপট দেখিয়ে। আর পিছিয়ে পড়েও লড়াইয়ে ফেরার উদাহরণ আছে তাদের। সেমিফাইনালে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল কানাডার বিরুদ্ধে পরপর তিনবার পিছিয়ে পড়েও ৪-৩ গোলে ম্যাচ জিতেছিল তারা। ওল্ডট্রাফোর্ডে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচটি ছিল অলিম্পিক ইতিহাসে সেরা রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ। সেই তুলনায় ফাইনালটা জমজমাট না হলেও কম ছিল না উত্তেজনার।

No comments

Powered by Blogger.