বাতায়ন পথে নিরীক্ষণঃ নির্বোধ কথিত এই জীবন by আতাউর রহমান
শোক ও আনন্দ মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী। প্রিয়জনের দুঃখ-বেদনায় আমরা শোকাহত হই। কাছের বা দূরের যে কোনো মানুষের মৃত্যুতে আমরা শোকগ্রস্ত হই। জীবনের প্রতি পদে দুঃখ-শোক আমাদের ছাড়ে না। জীবনে আনন্দ আছে বলেই আমরা শোকটাকে এমন করে বুঝি। মৃত্যুতে আমাদের সব সুখ-দুঃখের দেনা শোধ হয়ে যায়।
রবীন্দ্রাথের ‘শেষ লেখা’র একটি কবিতার চমত্কার ইংরেজি অনুবাদ আমার সামনে রয়েছে। অনুবাদ কেতকী কুশারী ডাইসনের "This 'life's a penance of suffering unto death, to gain truth's terrible price, to clear all debts in death." গত দু’তিন বছরে আমরা কয়েকজন প্রিয় এবং পাশাপাশি নামি মানুষকে হারিয়েছি। এদের বিয়োগে নিশ্চিতভাবে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আমি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রের মানুষদের কথাই বলব, কারণ আমি তাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। অবশ্য একজন শ্রমিক নেতা, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু নূরুল ইসলামের অপঘাতে মৃত্যু আমাকে ক্ষণকালের জন্য হলেও বিমূঢ় করেছিল। একে একে আমরা হারালাম সঙ্গীতজ্ঞ ও সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক, নাট্যকার সেলিম আল দীন, নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন এবং চিত্রগ্রাহক ড. নওয়াজেশ আহমেদকে। এছাড়াও আরও অনেক বন্ধু-বান্ধব আমাদের চিরকালের জন্য ছেড়ে গেছেন। এদের নাম তাত্ক্ষণিকভাবে মনে পড়ছে না, তাই লিখতে পারলাম না। সম্প্রতি সাংবাদিক কে জি মুস্তাফাকে হারালাম। আমি তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে প্রেসক্লাব বা শহীদ মিনারে যেতে পারিনি, কারণ জীবিত মানুষের অনেক জরুরি কাজ থাকে। ১৯৬০ সালে ঢাকা আসার পরপরই কেজি ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। তার স্ত্রী সাবেরা ভাবীর সঙ্গে আমি মঞ্চে ও টিভিতে অভিনয় করতাম এবং সেই সুবাদে তাদের বাসায়ও একাধিকবার গেছি। কেজি ভাই কুয়েতে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেলেন। তখন খুব খুশি হয়েছিলাম। আয়ত চোখের কেজি ভাইয়ের সঙ্গে আমি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের চেহারার আদল খুঁজে পেতাম। আমরা হারাব এবং নিজেরাও একদিন হারিয়ে যাব—এই হচ্ছে আমাদের জীবন। ‘হতভাগ্য এক অভিনেতা রঙ্গমঞ্চে কিছুকাল লাফায়-ঝাঁপায়, তারপর আর শোনা যায় না সংবাদ। এ হলো কাহিনী এক নির্বোধ কথিত, অলঙ্কারে, অনুপ্রাসে ঠাসা ইতি তাত্পর্যবিহীন (ম্যাকবেথ : অনুবাদ সৈয়দ শামসুল হক)।’ এই মৃত্যু প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল মহাভারতের ‘স্ত্রী পর্বে’র কথা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। নিহত যোদ্ধাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান প্রায় শেষ পর্যায়ে, বীর-পত্নীরা নদীতে নেমে তর্পণ করছেন। যদিও পাণ্ডবরাই এই কাজের উদ্যোক্তা, কিন্তু সব ক্রিয়া-কাণ্ডের সামনে রয়েছেন অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র। তখন পাণ্ডব-মাতা কুন্তী হঠাত্ বিলাপ করে বলে উঠলেন—পুত্র অর্জুন যাকে হত্যা করেছে সেই কর্ণ, যাকে তোমরা সূতপুত্র ও রাধার গর্ভজাত বলে জানতে, সে আসলে কিন্তু আমারই পুত্র। কর্ণ সূর্যের ঔরসে আমারই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন তোমাদেরই অগ্রজ ভ্রাতা। তোমরা তার তর্পণ করো। পাণ্ডবেরা মায়ের এ হেন স্বীকারোক্তি শুনে কাতর হয়ে পড়লেন। যুধিষ্ঠির আহত সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের অগ্রজ কর্ণ কীভাবে আপনার পুত্র হয়ে জন্মালেন? যে প্রতিভাবান ও বীর্যবান অগ্নিপুরুষ প্রায় ছাই-ভস্ম মেখে নিজেকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন, সেই কর্ণই ছিলেন আমাদরে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা? আপনিই তাকে প্রসব করেছিলেন? যুধিষ্ঠির মাকে দোষারোপ করে বললেন, আপনি এই ব্যাপারটি গোপন করেছিলেন বলেই আজ আমরা কর্ণের মৃত্যুতে সবাই ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি। অভিমন্যু বধ থেকে নিয়ে যত মৃত্যু আমরা দেখেছি এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে, সবচেয়ে শোকাবহ হলো কর্ণের বিয়োগ। কর্ণ জীবিত থাকলে এই পৃথিবীতে পাণ্ডবদের কিছুই অপ্রাপ্য হতো না। এই যে যুদ্ধ, যার ফলে কুরু বংশ বিলুপ্ত হয়ে গেল, সেই ট্রাজেডিটি ঘটত না। এভাবে বিলাপ করতে করতে যুধিষ্ঠির কর্ণের শেষকৃত্য পালন করলেন এবং শোকাকুল হয়ে নদী থেকে উঠলেন। সব যুদ্ধই শেষ হয়, সব বিরোধের সমাপ্তি ঘটে একদিন; কিন্তু আমরা বেঁচে থাকাকালীন সেটা বুঝেও বুঝি না। তাই শেষ হতে চায় না আমাদের বিলাপ ও অভিশাপের পালাগান এবং অনুশোচনার সঙ্গে জড়ানো নিষ্ঠুর ও আত্মঘাতী শোধ-প্রতিশোধের হিসাব-নিকাশ। এই সত্যটি আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে দর্শন করেছি, তেমনি লক্ষ্য করে আসছি আমাদের সামাজিক ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মে এই নিষ্ঠুর সত্যকে। যে কোনো মানুষের মৃত্যুই শোকাবহ এবং আমাদের কষ্টের কারণ হয়, যেভাবে কষ্টের কারণ হয়ে আসছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মৃত্যু অথবা ছাদ থেকে পড়ে একজন রাজমিস্ত্রির মৃত্যু। সাধারণভাবে দেখলে মানুষে মানুষে বিভেদ নেই। আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক কোষ যে অন্য মানুষের তুলনায় উত্কৃষ্ট ছিল, বিজ্ঞান আজও সেটা ধ্রুবভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। তবুও এই পৃথিবীতে একজন আইনস্টাইন, ভ্যানগঘ, গ্যালিলিও, আইজেনস্টাইন, লরেন্স অলিভিয়ের, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের জন্ম হয়, যারা পৃথিবীর সনাতন অথবা প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে পাল্টে দিতে সক্ষম। বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কও তাই করেছেন। কর্ণের মৃত্যু সেজন্য মহাভারতের সবচেয়ে নিদারুণ মৃত্যু না হলেও সবচেয়ে ক্ষতিকর; কারণ প্রজ্ঞায়, বীরত্বে ও নিরহঙ্কারে তিনি ছিলেন সমাজ ও দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তিনি হয়তোবা একটি নবযুগের প্রবর্তক হতে পারতেন। ট্রোজান যুদ্ধের এক পর্যায়ে প্রজ্ঞাবান হেক্টর বলেন, কার সঙ্গে যুদ্ধ করব, আমার এক হাত হচ্ছে ট্রোজান এবং অন্য হাত হচ্ছে গ্রিক। আমাদের উত্স এক। আমরা কি স্বজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব? মহাভারতের যুদ্ধে একই ঘটনা ঘটেছে। আমরা যে বিশ্বময় হত্যাযজ্ঞে মেতে থাকতে চাই, তা কোনো না কোনোভাবে স্বজন হত্যারই শামিল, সভ্যতার ক্রমবিকাশ তাই বলে। আশায় আছি, আমরা ইতিহাসের পাঠ হয়তো একদিন সঠিকভাবে নিতে শিখব।
লেখক : অভিনেতা-নাট্যনির্দেশক
No comments