ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে স্তূপীকৃত অভিযোগঃ সমূহ সর্বনাশের আগে ব্যবস্থা নিন
অভিযোগের পর অভিযোগ স্তূপীকৃত হয়ে আছে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের স্তূপ কোথাও কোথাও পাহাড় সমান হয়ে আছে। প্রতিদিন গড়ে ৪০০ অভিযোগ জমা পড়ছে। গুম, খুন, ধর্ষণ, হামলা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, বাড়ি দখল, মাদক বাণিজ্য, হুমকি-ধমকিসহ এমন কোনো বিষয় নেই, যা অভিযোগপত্রে নেই।
র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ঠুঁটো জগন্নাথের মতো হাত-পা গুটিয়ে গ্যালারিতে বসে যেন উপভোগ করছেন সরকারি অঙ্গদলের সন্ত্রাসীদের এই ভয়াবহ, ক্ষেত্রবিশেষে নারকীয় এবং বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। যে র্যাব ক্রসফায়ারের বেলায় বিশেষ ইতিহাস সৃষ্টি করে গিনেস রেকর্ডবুকে নাম লেখানোর অপেক্ষায় ছিল, সেই র্যাব যেন এখন সুবোধ-শান্ত বালকের মতো চুপচাপ। পুলিশের কথা তো বলাই বাহুল্য। ফলে প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধ মহামারীর মতো প্রতিনিয়ত বর্ধিত হচ্ছে। অভিযোগ সব ক্ষেত্রে জমা দেয়াও ভুক্তভোগীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা গ্রহণ করে না। অনেক সময় সন্ত্রাসীদের হিংস্র দাঁতের ক্রুর ঘষ্টানির সামনে আতঙ্কে অস্থির সাধারণ মানুষ থানা পর্যন্ত পৌঁছতেও পারে না। যারা শেষ পর্যন্ত অভিযোগ দায়ের করতে পারছেন, তারাও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী হওয়ার ফলে পুলিশ যেন ধরেই নিচ্ছে, তাদের যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার আছে। ফলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। আবার ‘ওপরের নির্দেশে’ পুলিশ সব জেনেশুনেও বোবা-কালা ও অথর্ব সেজে বসে থাকে। অনেক সময় পুলিশ অভিযোগকারীদেরই ভয় দেখিয়ে মামলা না করার পরামর্শ দেয়। প্রেসক্রিপশন দেয় আপসরফার। এমন হয়েছে ওপরের হুকুমে, প্রজাতন্ত্রের নীতিনিষ্ঠ পুলিশ অভিযোগকারীকেই উল্টো গারদে ঢুকিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। আবার থানা হাজতে পিটিয়ে খুন করে সেই খুনকে হার্ট অ্যাটাক বা জুতার ফিতা গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যার রূপকথা প্রচারেও যে আমাদের পুলিশের জুড়ি মেলা ভার, তা তো সবারই জানা।
ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনগুলোর দাপটে সত্যি বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনপদ এখন আতঙ্কের প্রেতপুরীতে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে নেতাকর্মীদের মাত্রাছাড়া হুঙ্কার, চিত্কার ও কাণ্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তার ফলে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে চলে গেছে। ছাত্রলীগের প্রায় সব স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে লুণ্ঠন মনোবৃত্তি। ইডেনের মতো দেশবিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেয়েদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে দেহব্যবসায়—এ লজ্জা রাখি কোথায়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও হল দখলের সঙ্গে ছাত্রলীগের দেশ উদ্ধারকর্মে যুক্ত হয়েছে ভর্তিবাণিজ্য। রক্ত ঝরছে রাজশাহী, ঢাকাসহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্ষমতাসীন দলের এসব বখাটের বিরুদ্ধে পুলিশ কিছু করতে পারছে না বা করছে না—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি খোদ প্রধানমন্ত্রীও তার ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যুবলীগের দাপটে দেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় জনজীবন অস্থির, আকুল এবং অসহায়। আবার চাঁদার ভাগবাটোয়ারা, গ্রুপিং, উপদলীয় কোন্দল নিয়েও এন্তার ঘটছে খুনখারাবির ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা যেমন হল ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে, তেমনই সারাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা। মানুষ প্রতিকারের আশায় থেকে থেকে দেখছে, আইনের শাসন এখন সত্যিকার অর্থেই পরিণত হয়েছে মরীচিকায়। পায়ের নিচে ঊষর ধূসর রূক্ষ্ম বালু, ওপরে বাষ্পশূন্য আকাশ। দিগন্ত পর্যন্ত কোথাও কেউ নেই, যার কাছে জীবন ও সমাজের নিরাপত্তা পাওয়া যেতে পারে।
সাধারণ মানুষের মতো দেশের সচেতন মহলও ভাবতে শুরু করছে, সত্যি কী কোথাও কেউ নেই। যদি থাকে, তাহলে এরকমভাবে ধর্মের ষাঁড়ের মতো উন্মত্ততা নিয়ে সন্ত্রাসীরা জনজীবনকে এফোঁড়-ওফোঁড় করছে কীভাবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসে সেই জনগণের জীবন থেকে যদি হরণ করা হয় নিরাপত্তা ও শান্তি, তাহলে ব্যথাটা বুকে বেশি বাজে বৈকি! শাসকশ্রেণী সব সময় জনকল্যাণ বাদ দিয়ে জনগণকে শাসন করার মতলবে নানাপ্রকার অযৌক্তিক ও অবাঞ্ছিত কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। ভাবে, এ পথেই তার ক্ষমতার ভিত্তি আরও পাকাপোক্ত হবে। কিন্তু শাসকরা ভুলে যায়—যে জনগণ তাদের ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছে, সেই জনগণই নৌকা উল্টো করে বাইলেই নির্ঘাত সলিল সমাধি। সেজন্যই সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্টদের কাছে আমাদের অনুরোধ, যারা ক্ষমতার প্রতাপে অন্ধ হয়ে অপকর্ম করছে, তারা সত্যিকার অর্থে কোনো রাজনৈতিক মিত্র নয়। এরা হলো গণদুশমন—এরা লুম্পেন। এদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে, নইলে এই অপশক্তি সমূহ সর্বনাশ ডেকে আনবে সরকারের। যেভাবে এরা আগের ক্ষমতাসীনদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছে।
No comments