স্মরণঃ এই কে জি সেই কে জি নয় by কে জি মোস্তফা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অবিস্মরণীয় সেই ছোটগল্প ‘জীবিত ও মৃত’-এর শেষ বাক্যটি ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই’। গত ১৩ জুন আমার অবস্থা ছিল তথৈবচ। সেদিন ভোরে মোবাইলের আর্তচিত্কারে হঠাত্ ঘুম ভেঙে গেল। অপর প্রান্ত থেকে জানতে চাওয়া হলো আমি কে জি মোস্তফা কিনা। বললাম হ্যাঁ। তবু একই প্রশ্ন।
বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলাম—কে বলছেন, কেন বারবার একই প্রশ্ন করছেন। বললেন, একটু আগে টিভিতে কে জি মুস্তাফার ইন্তেকালের খবর শুনতে পেয়েছি (ইন্না লিল্লাহি ... রাজিউন)। জানতাম সিনিয়র কে জি মুস্তাফা দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ এবং সম্প্রতি মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমাদের দুজনের আলাদা পরিচিতি তাকে খুলে বললাম। কিন্তু যশোরের সেই ভদ্রলোক তাতেও ক্ষান্ত হলেন না। আশ্বস্ত বোধ করলেন না। সেদিন আরও দুবার তিনি ফোন করেন। জানতাম ওই ভদ্রলোক আমার লেখা গানের এক অন্ধ ভক্ত।
সে যাই হোক, ১৩ মার্চ সারাদিন অজস্র ফোন পেলাম। বলতে গেলে প্রতি ৫-১০ মিনিট পরপরই মোবাইল বাজতে থাকল। এদের প্রায় সবাই চেনা-স্বল্পচেনা, ভক্ত বা অনুরাগী। আবার কাছের-দূরের আত্মীয়স্বজন। এমনকি আত্মীয়দের আত্মীয়, বন্ধুদের বন্ধুরাও। দূর প্রবাস নিউইয়র্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে স্বজনরা। টরেন্টো থেকে বউমার তো কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠস্বর। অবশ্য ছেলে খোন্দকার মাসুদুল হাসান মানু ভালোভাবেই জানত আমাদের একই নামের অন্য জনকে। কানাডায় তার বন্ধুবান্ধবরাও তাকে ফোন করে নিশ্চিত হয়েছে, এই কে জি সেই কে জি নয়।
উপরোক্ত শিরোনামে গত বছর ১ আগস্ট আমি দৈনিক আমার দেশে একই নামের আমাদের দুজনকে নিয়ে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি, সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছিলাম। সঙ্গে দুজনের ছবিও ছাপা হয়েছে। পরে কবি হাসান হাফিজ সম্পাদিত জাতীয় প্রেসক্লাবের বার্ষিক স্মরণিকায় সেই লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হয়। সিনিয়র কে জি মুস্তাফা নিজ বাসভবনে অসুস্থ অবস্থায় আমার সেই লেখাটা পড়েন এবং খুব খুশি হয়েছেন বলে লোক মারফত আমাকে ধন্যবাদ জানান। সেদিন সত্যি আমি খুব অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। তার মৃত্যুর পরদিন অর্থাত্ ১৪ মার্চ ক্লাব চত্বরে প্রবেশ করতেই সহমর্মীদের সকৌতুক প্রশ্ন, কেমন আছেন? বললাম, বেশ আছি ভালো আছি, আপনাদের ভালোবাসার অতি কাছাকাছি। আসলে সময়-চেতনা আমাদের বড় শত্রু। ওরা আমার উজ্জ্বল বেঁচে থাকা নিয়ে এমন প্রশ্ন করে, যেন আমি গত শতাব্দীর লোক।
যাই হোক, তুমি কন্যা হও, পুত্র হও, বন্ধু হও—তুমি আমার সুজন। তুমি আমাকে প্রাণবন্ত সজীব দেখতে চাও। কিন্তু আকাশে এখন অশুভ চিহ্ন, দৈব দুর্বিপাক। মাটির পৃথিবীতে বিশ্বায়নের বর্বরতা। মোটের ওপর যা ঘটছে, যতটুকু বুঝতে পেরেছি এক জায়গায় যেখানে এখনও বেঁচে আছি আমি, তুমি স্পর্শ করেছ স্থবির এ জীবন। আমি আজ পুনরায় বেঁচে ওঠি, ভাবাবেগে স্মৃতিকে আঁকড়ে বাঁচা নয়, মৃত্যুর দিকে ক্রমেই পা বাড়িয়ে আয়ুষ্কালটা জেনেছি তোমার ভেতর। তুমি রোজ পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাক, কেননা তোমার বেঁচে থাকার মধ্যেই আমার ধারণাগুলো থাকবে জীবন্ত।
মাংসকাটা বঁটির মতো সময় তো গলে যাচ্ছে। চূর্ণাকারে ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রবীণ পৃথিবী। কোনো রকমের বিপর্যয় হয়তো চূড়ান্ত অর্থহীন, তবুও আমরা মৃত কিংবা মরতে উদ্যত। দিনান্তের ধারে জীবনের ছায়া দীর্ঘ হয়ে আসছে। দ্বিধা-জিজ্ঞাসায় অতীতের দিকে হাত বাড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, বয়স হয়েছে কত? বিস্মৃতির স্তূপ ভেঙে এবার দেহমনের টুকরো কুড়িয়ে আহ্লাদের বৃক্ষ থেকে নেমে এসো। এই সংসার, এই চরাচর ভঙ্গুর ভুবন ছেড়ে অজানার আঙিনায় দাঁড়াতে হবে একেলা। আয়ু খায় যে যার বয়স। সেই ভয়ে চটুল পঞ্চাশে মাথায় কলপ ধারকরা পেসমেকারে বেকায়দায় পেতে চায় অধিক জীবন! ওরে মন, সাধ্যহীন সাধনায় রাজসিক প্রলোভনে কাজ নেই। অস্থির কষ্ট আর নিস্তব্ধ অভিমান ভুলে প্রাপ্য সম্ভ্রম আর বৈভবে খুশি থাকাই উত্তম। ছোটর ভেতরে উদার নীলিমা, দরদে ফোটানো ফুল, প্রকৃতি মন্থন, ঘুমপাড়ানিয়া গান আর রূপজাগানিয়া স্বপ্নে অনায়াসে কেটে যাক ফসিল সময়।
No comments