দুর্ভাগা ভারতের সেরা অলিম্পিক! by শাকিল আহমেদ মিরাজ

একই সঙ্গে দুর্ভাগা আবার সেরা এ কেমন কথা, দুর্ভাগারা তবে সেরাও হয়! লন্ডন অলিম্পিকে ভারতের পাওয়া না পাওয়ার বিশদ জানার পর এমন অসঙ্গত বাক্যে বিশ্বাস হবে আপনারও। দুর্ভাগা এই জন্য যে ১২১ কোটি জনসংখ্যার দেশকে লন্ডন থেকে ফিরতে হয়েছে ন্যূনতম ১টি স্বর্ণ ছাড়া।


২০৪ জাতির আসরে পদক তালিকায় ৫৫ হয়ে (অবস্থান)। আবার সেরা, দেশটির নিজেদের অতীত অর্জন ছাড়িয়ে যাওয়ায়। মাত্র ৬টি পদকই অলিম্পিক ইতিহাসে ভারতের সর্বাধিক পদক জয়ের নতুন রেকর্ড! রৌপ্য দুটি ও ব্রোঞ্জ ৪টি। রেসলিংয়ে সুশিল কুমার রৌপ্য, যোগেশ্বর দত্ত ব্রোঞ্জ, পিস্টন শূটিংয়ে বিজয় কুমার রৌপ্য, মেয়েদের ব্যাডমিন্টনে সাইনা নেওয়াল ও বক্সিংয়ে ম্যারি কোম ব্রোঞ্জ পদক উপহার দিয়ে ভারতের অর্জনের পথে ইতিহাসে নিজেদের নাম লেখান। অলিম্পিকের শেষ দিনে ভারতকে দ্বিতীয় রৌপ্য পদকটি উপহার দেন রেসলার সুশিল। তার আগে শূটিং বিভাগের আওয়াতাভুক্ত পিস্টন নিক্ষেপে অপর রৌপ্য পান বিজয় কুমার। তবে সুশিল ও বিজয়ের রুপার তেজকেও ছাপিয়ে যায় সাইনা নেওয়াল ও ম্যারি কোমের ব্রোঞ্জ আলো! অলিম্পিক ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় ভারতীয় মেয়ে হিসেবে পদক পান ব্যাডমিন্টন কুইন সাইনা। তৃতীয় মেয়ে হিসেবে বক্সিং তারকা ম্যারি। তাই সাইনা নেওয়াল ও ম্যারি কোমের সাফল্যে উদ্ভাসিত গোটা ভারত। যদিও চূড়ান্ত লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ইনজুরির কবলে পড়ে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ায় ব্রোঞ্জ পদক গলায় ওঠে সাইনার। তবে ম্যারির পদকটি ছিল অনন্য অর্জন। নাম শোনার পর যারা ওমেন বক্সিংয়ের খোঁজখবর তেমন একটা রাখেন না তাঁদের মনে হতে পারে ম্যারি কোম বোধ হয় একজন থাই-চাই কিংবা জাপানিজ। কিন্তু না, মেদহীন শক্ত বাহুর মুষ্টিঘাতে দুনিয়া কাঁপানো ‘ম্যারি’ ভারতেরই মেয়ে। পাঁচটি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী মেরির বক্সিং ক্যারিয়ার শুরু ২০০২ সালে। আগমনেই একাগ্রতা-স্কিল আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে জিতে নেন ৭ম ইস্ট ইন্ডিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মেয়েদের বক্সিংয়ের এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ, কমনওয়েলথ গেমসহ একাধিক আন্তর্জাতিক আসরে সেরা হয়ে লন্ডনের জন্য প্রস্তুত হন তিনি। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন এবার হয়ত ভারতকে স্বর্ণই উপহার দেবেন ম্যারি। শেষ অবধি তা হয়নি। তবে ব্রোঞ্জ লড়াইয়ের দিনেও ভারতীয়দের দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল বক্সিং কোর্টে। ভারতজুড়েই প্রার্থনা ছিল ম্যারির জন্য। বিশেষ করে নিজ রাজ্য মণিপুরের মন্দির ও চার্চে প্রার্থনা হয়েছে এ নারী বক্সারের সাফল্য কামনা করে। ৫১ কেজি ওজন শ্রেণীর সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের নিকোলা এ্যাডামসের কাছে হেরে ব্র্রোঞ্জপদক জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ২৯ বছর বয়সী ম্যারিকে। স্বর্ণপদক জিততে না পারলেও ম্যারির চেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন ভারতের ক্রীড়ামোদীরা। এর মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রী, ক্রীড়ামন্ত্রী, চলচ্চিত্র অভিনেতা, ক্রিকেটারসহ আরও বিভিন্ন পেশাজীবীরা। বলিউড মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন তাঁর টুইটার ব্লগে মন্তব্য করেন, ‘আমি একটি ফোন পেয়ে জানতে পারি ম্যারি ব্রোঞ্জপদক পেয়েছেন। খবরটা শুনে এত খুশি হয়েছি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কি অসাধারণ মহিলা! পুরো জাতি ওর জন্য গর্বিত।’ ভারতীয় ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকরও ম্যারিকে শ্রদ্ধা জানান টুইটার ব্লগে, ‘ম্যারি কোম একজন বিস্ময়কর মহিলা। তাঁর নিষ্ঠা, একাগ্রতা সবকিছুই অনুকরণীয়।’ ব্রোঞ্জ জয়ের পরদিন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো ম্যারি কোমকেই তাঁদের মূল সংবাদের শিরোনাম করে। ধামাচাপা পড়ে যায় অন্য সব ইস্যু। নিতান্ত দরিদ্র পরিবার থেকে আজকের এ পর্যায়ে উঠে আসতে প্রচ- কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে ম্যারিকে। তিনি এর আগে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ৪৬ এবং ৪৮ কেজি ওজন শ্রেণীতে মোট ৫টি স্বর্ণপদক করায়ত্ত করেন। ভারতীয় নারীরা যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বক্সিংয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে, এটাই ছিল বিস্ময়কর। তারপর এমন অভূতপূর্ব সাফল্য! লন্ডন অলিম্পিকে সেমিফাইনালে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। চতুর্থ রাউন্ডের খেলায় ১১-৬ ব্যবধানে হেরে যান মণিপুরের নারী। চার রাউন্ডের লড়াইয়ে ১-৩, ১-২, ২-৩, ২-৩ ব্যবধানে জেতেন র‌্যাঙ্কিংয়ের দ্বিতীয় সেরা নিকোলা। লড়াইয়ে হারার পরেই জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘দুঃখিত, স্বর্ণ বা রৌপ্য জিততে পারলাম না। কিন্তু আমি সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছি।’ শেষ দিনে ভারতকে আরেকটি পদক উপহার দেন রেসলার যোগেশ্বর দত্ত। পুরুষদের ৬০ কেজি ওজন শ্রেণীর ফ্রিস্টাইল রেসলিংয়ে উত্তর কোরিয়ার রি জং মিয়ংকে ৩-১ হিটে ধরাশায়ী করে বোঞ্জ জয় করেন যোগেশ্বর। পদক নিশ্চিত হওয়ার পর পরই যোগেশ্বরের জন্য ১ লাখ ৮১ হাজার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেন তার জন্মস্থান হারিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিং হুদা। ভারত পুলিশের সদস্য যোগেশ্বরের অর্জনে আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়ে গোটা ভারতে। ১৯৮২ সালের ২ নবেম্বর হরিয়ানা রাজ্যের ভাইনশাল কানালে জন্ম নেয়া যোগেশ্বর ভারত পুলিশের সদস্য। পাশাপাশি তরুণ বয়স থেকেই বক্সিং রিংয়ে আলো ছড়ানো তারকা। ২০০৬ সালের দোহা এশিয়ান গেমসের ব্রোঞ্জ জিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পান। এরপর ২০১০-এ দিল্লী কমনওয়েলথ গেমসের স্বর্ণ জিতে আরও ভাল কিছুর ইঙ্গিত দেন। অলিম্পিকের ব্রোঞ্জ জয় করে তাতে পূর্ণতা আনেন যোগেশ্বর। নিজেদের অলিম্পিক ইতিহাসে সর্বাধিক ছয় পদক জয়ের রেকর্ডে নেপথ্যে থাকা ক্রীড়াবিদদের নৈপুণ্যে দারুণ সন্তুষ্ট দেশটির ক্রীড়ামন্ত্রী অজয় মেকিন। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে দু’তিনটি বিভাগে স্বর্ণপদক আসেনি। আবার কিছু ইভেন্টে আমাদের ক্রীড়াবিদরা সেরা পাঁচ থেকে দশের মধ্যে থেকে শেষ করেছে। সেসব ক্ষেত্রে সফল হলে পদকসংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারত। তারপরও অলিম্পিক পদকপ্রাপ্তিতে অতীতকে ছাড়িয়ে যাওয়া লন্ডন আসর নিয়ে সন্তুষ্ট, গর্বিত আমি।’ ২০২০ সালের অলিম্পিকে ভারত কমপক্ষে ২৫টি পদক পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন ক্রীড়ামন্ত্রী। সরকার, অলিম্পিক কমিটি সন্তুষ্ট হলেও ভারতের নৈপুণ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখায় দেশটির সংবাদ মাধ্যম। বহুল প্রচারিত হিন্দুস্তান টাইমস যেমন লেখে, ‘১.২ বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ ভারত অর্থনৈতিকভাবেও বিশ্বের আগমনী পরাশক্তি। অনেক কিছুতেই এ দেশ যখন আমেরিকা, চীনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে তখন কোন স্বর্ণ ছাড়াই লন্ডন থেকে ফিরতে হলো আমাদের ক্রীড়াবিদদের।

No comments

Powered by Blogger.