মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানে সাকা স্পিøন্টারবিদ্ধ হয়, ড্রাইভার মারা যায়- যুদ্ধাপরাধী বিচার- ১০ ও ১১ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দশম ও ১১তম সাক্ষী তাঁদের জবানবন্দী প্রদান করেছেন। উভয় সাক্ষী একাত্তরে সাকার নেতৃত্বে গণহত্যা, গুম ও নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন।
একই ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাফাই সাক্ষীর জন্য পাঁচজনের তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন তার আইনজীবী। আজ সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। মঙ্গলবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১ এ এই আদেশ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষী আবদুল মোমেনকে জেরা করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী এইএম খলিলুর রহমান। তবে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের বাবা মারা যাওয়ায় জেরা অসমাপ্ত রেখেই ট্রাইব্যুনালের কাজ শেষ হয়। মঙ্গলবার চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল-২ এ এই জেরা অনুষ্ঠিত হয়।
ট্রাইব্যুনাল-১ এ মঙ্গলবার ১০ সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কাজী মোঃ নূরুল আফছার ও ১১তম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা এসএম মাহবুব-উল আলম ট্রাইব্যুনালে সাকার বিরুদ্ধে একাত্তরের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দী প্রদান করেন। দশম সাক্ষী মোঃ নূরুল আফছার তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, সাকা চৌধুরী তাদের গুডস হিলের বাসায় স্বাধীনতাকামী লোকদের ধরে এনে অত্যাচার করত। কে বাঁচবে কি বাঁচবে না এটা জানার জন্য ডা. সমির উদ্দিনের বাসায় গভীর রাতে গাড়িতে করে গোপনে নিয়ে যেত। ডা. সমির চেক করার পরে যাদের বাঁচার সম্ভাবনা ছিল তাদের হয় জেলে না হয় তাদের পছন্দ কোন লোকের কাছে হস্তান্তর করা হতো। আর যাদের বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না তাদের ধ্বংস করে ফেলত। তাদের আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যেত না। একই ভাবে মাহবুব আলমের কোন খোঁজ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে ১১তম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব-উল-আলম তাঁর জবানবন্দীতে বলেছেন, ট্রেনিং শেষে মেজর জিয়াউর রহমান তাঁকে গ্রুপ কমান্ডার নিয়োগ দান করেন। এরপর জিযাউর রহমান একটি হিটলিস্ট দেন । সেখানে কয়েকজনের নাম ও প্রতিষ্ঠানের নামসহ ২২টি অপারেশনের নাম ছিল। ঐ হিটলিস্টে প্রথম নাম ছিল ফজলুল কাদের চৌধুরী, দ্বিতীয় নাম ছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরী। তৃতীয় নাম ছিল দেওয়ান বাজারের দিদার মিয়া, চতুর্থ নাম ছিল চানগাঁও থানার মুসলিম লীগ নেতা শরাফত উল্লা। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামসহ রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারীতে যে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ হয়েছে তার নেতৃত্ব দিয়েছেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
মোঃ নূরুল আফছার
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দশম সাক্ষী মোঃ নূরুল আফছার জবানবন্দী প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁর বিবরণ প্রদান করা হলো।
সাক্ষী তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম কাজী নূরুল আবছার, পিতা কাজী মোঃ জাবের, মা-কাজী যায়েদা বেগম। সাক্ষী বলেন, একাত্তর সালে আমার বয়স ছিল ২০ বছর। আমি ১৯৭০ সালে ডিগ্রী পাস করি। তিনি বলেন, আমি ৭১ সালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তখন আমি রাঙ্গুনিয়া থানা ও কলেজ শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। আমার পরে মাহবুব আলম কলেজ শাখার সভাপতি হন। তিনি আমার সঙ্গে একমত ছিলেন। তিনি ওই সময় বাড়িতে না থেকে খাতুনগঞ্জে তাঁর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান শাহেব মিঞা এন্ড সন্সে থাকতেন। তখন পরিস্থিতি এতই খারাপ ছিল যে, তাঁর সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগ করা সম্ভব হতো না।
সাক্ষী বলেন, ওই সময় আমার সৈয়দ মাহবুব আলমের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং আমি তাঁর দলে রিক্রুট হই। আমি খাওয়া ও থাকার দায়িত্ব পালন করি। ইতোমধ্যে জুন-জুলাইয়ের মধ্যে খাতুনগঞ্জের মাহবুবের কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি। আমাদের চন্দনপুরায় বন্ধুবান্ধবদের একটা আড্ডা ছিল। সেখানেও আলাপ আলোচনা হয় মাহবুবকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমি যে ধরনের দৈহিক বর্ণনা দিয়েছি সে ধরনের একটা ছেলে আমার বন্ধুর বাসায় আহত অবস্থায় আছে। সেই বন্ধুর কাছে জানতে পারি সাকা চৌধুরীর গুডস্ হিলের বাড়িতে স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে এনে অত্যাচার করে। তাদের মধ্যে যারা বেশি অত্যাচারিত হতো তার অবস্থা জানার জন্য গভীর রাতে গোপনে ডা. সমিউদ্দিনের বাসায় নিয়ে যাওয়া হতো কে বাঁচবে কে বাঁচবে না তা জানার জন্য।
ওই সময় ডা. সমিরউদ্দিন তাদের দেখার পরে হয় তাদের জেলে অথবা তাদের পছন্দের লোকদের কাছে হস্তান্তর করত অন্যদের মেরে ফেলা হতো। মাহবুবের গ্রামের বাড়ির ইউসুফ খান নামে একটি ছেলে তার সমবয়সী ছিল। সে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসার পরে তাকে গুডস হিলে নিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করানো হয়। ইউসুফ খান সাকার সকল কাজের সহযোগী হয়ে যায়।
সাক্ষী বলেন, সাকা চৌধুরীসহ ইউসুফ, মাকসুদ, খোকা, জিয়াউদ্দিন এরা খাতুনগঞ্জ থেকে মাহবুব আলমকে গুডস্ হিলে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আমরা আজিজ উদ্দিনের কাছে জানতে পারি নির্যাতনের ফলে তাদের গায়ে কোন চামড়া ছিল না। পেরেক মারা টেবিলের ওপরে তক্তা চাপা দিয়ে তাদের নির্যাতন করা হতো। ফলে তার বাঁচার কোন সম্ভাবনা ছিল না এবং আজও পর্যন্ত তার কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি।
সাক্ষী বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক করা হয় যে, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাকে খতম করতে হবে। তবে তিনি যথেষ্ট গার্ডের মধ্যে থাকতেন। ফলে তার বিরুদ্ধে কোন কিছু করা খুব সহজ বিষয় ছিল না।তিনি বলেন, পরে আমি আমার গ্রুপ কমান্ডার এসএম মাহবুবের সঙ্গে কথা বললাম। তখন মাহবুব তাঁর দলের দু’জনের সঙ্গে আলাপ করে আমাকে রেকি করার দায়িত্ব দেয়। রেকি শেষে আমরা একত্রে চারজন মিটিং করি। মিটিংয়ে আমরা আমাদের প্রোগ্রামের দায়িত্ব বণ্টন করি। আমি রাস্তা চেক দেয়ার দায়িত্ব নেই। ওই দিন পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি ছাড়া বাকি তিনজন তাদের অস্ত্র নিয়ে যার যার অবস্থান গ্রহণ করেন।
সাক্ষী বলেন, সাকা চৌধুরী এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ ডা. সমিরউদ্দিনের বাড়িতে দাওয়াতে যান। ওই সময় আমি রাস্তার উপরে দাঁড়ানো ছিলাম। আমার সঙ্গী তিনজন সমিরউদ্দিনের বাড়ির বড় একটি ড্রেনের স্লাবের ওপর অবস্থান নিয়ে ছিল। আমরা সংবাদ পেয়েছিলাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজে গাড়ি চালিয়ে আসছে। কিন্তু ওই দিন সে নিজে গাড়ি না চালিয়ে ড্রাইভার চালাচ্ছিল। আমাদের লক্ষ্য ছিল ড্রাইভিং ছিটে। গুলি চালালে ড্রইভারের গায়ে গুলি লাগে। সাকা চৌধুরীর পায়ে গুলির স্পিøন্টার লেগে আহত হয়। পরের দিন লোক মুখে পত্রিকা পড়ে জানতে পারি ড্রাইভার মারা গেছে। পরে সাকা বিদেশ চলে যায়। সাক্ষীর জবানবন্দী শেষে তাকে একটি প্রশ্ন করে জেরার কার্যক্রম মুলতবি করা হয়।
মাহবুব-উল-আলম
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ¦িবরুদ্ধে ১১তম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব-উল- আলম মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দী প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁর জবানবন্দী প্রদান করা হলো।
আমার নাম এসএম মাহবুব-উল- আলম, পিত- ইসহাক মিয়া, মাতা-সৈয়দা কুলসুম খাতুন। বয়স ৬৩ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ২২ /২৩ বছর। ১৯৭০ সালে এইচএসসির ছাত্র ছিলাম। বর্তমানে ব্যবসা করি। ১৯৬৯ সালে আমি গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। ৭০-এর নির্বাচনের পর একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
২৫ মার্চ রাতে পাকহানাদার কর্তক ম্যাসাকার শুরু হবার পরে চট্টগ্রাম পাকবাহিনী আংশিক দখল করে। পরে আমি রামগড়ে চলে যাই। তৎকালীন ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। মেজর জিয়া তখন রামগড়ে ছিলেন। স্বপন কুমার চৌধুরী তখন মেজর জিয়ার কাছে নিয়ে যান। মেজর জিয়া আমাকে বললেন, পরের দিন সকালের ভিতরে ট্রেনিং সেন্টারে যেতে। আমার সঙ্গে ট্রেনিংয়ে ১৪ জন ছিল। আমরা বিকেলে সেখানে পৌঁছি। ট্রেনিং সেন্টারটি ত্রিপুরা রাজ্যের বোগাফায় অবস্থিত। ওখানে গিয়ে দেখি চট্টগ্রামের ডা. শাহ আলমগীর, বীরউত্তমসহ অন্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত আছেন।
ঐদিন রেস্ট নেয়ার পর পরের দিন ট্রেনিং শুরু হয়। ট্রেনিং ১০ দিন চলে। ওখান থেকে ৪৫ জনের একটি গ্রুপ যার নাম সিটি গ্রুপ ত্রিপুরার উর্মি নগর ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে ট্রেনিং শেষ করে আমাদের হরিণা ক্যাম্পে পাঠানো হয়, যা সাবরুমে অবস্থিত। ওখানে ৭দিন বিশ্রাম করি।
এ সময় মেজর জিয়া সেক্টর কমান্ডার হয়ে যান। তিনি আমাদের ডেকে চট্টগ্রাম শহরের খাল বিল চেনে এ রকম একটি গ্রুপ তৈরি করতে বলেন। আমরা ওখানে ১৬ জনের লিস্ট তৈরি করি। তা জিয়াউর রহমানের হাতে দেই। তিনি সবাইকে ডেকে আনতে বললেন। সবাই এলে উনি সবার সঙ্গে কথা বলেন। ১৬ জনকে উনি একটি ফরম ফিলাপ করালেন। আমাকে ১৬ জনের গ্রুপ কমান্ডার নিয়োগ করেন। আমাদের গ্রুপ নম্বর -৮। নাম ছিল ব্রাভো কোম্পানি। উনি আমাদের সবাইকে অজু গোসল করে পরের দিন সকাল ১০টায় আসতে বলেন। আসার পর পবিত্র কোরানর ওপর উনি হাত দিয়ে শপথ পড়ান। উনি আমাদের একটি হিটলিস্ট দেন ২২টি অপারেশনের জন্য। এর ভিতর প্রথম নাম ছিল ফজলুল কাদের চৌধুরী (ফকা চৌধুরী)। দ্বিতীয় নাম ছিল তার ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরী । তৃতীয় নাম ছিল দিদার মিয়া, চতুর্থ শরাফত উল্লাহ। এর পর বিভিন্ন স্থাপনা উল্লেখ করে অপারেশনের কথা বলা হয়। আমাকে অস্ত্র ও কিছু টাকা পয়সা দেয়া হয়। এর পর আমরা চট্টগ্রামের পথে রওনা হই। আমার সঙ্গে ফজুলল হক ভুইয়া, সৌরেন্দ্র নাথ সেন ওরফে কামাল, মোঃ মহসীন, মোঃ নাসির উদ্দিন, মোঃ জামাল উদ্দিন, দেওয়ান মাহমুদ, প্রণব বড়ুয়া, মোঃ রফিকুল ইসলাম, মোঃ কাশেম, ইউসুফ চৌধুরী, মোঃ নাসির উদ্দিন চৌধুরী (অন্যজন), আহম্মেদ কামরুল হাসান চৌধুরী, জেমস রোজারিও ও আমিসহ ১৬ জন।
চট্টগ্রামের এসে পাথরঘাটা সেন্টারে উঠি। পরে সহযোদ্ধাদের বিভিন্ন সেন্টারে সেট করিয়ে দেয়া হয়। কিছু দিন আমরা বিশ্রাম করি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অপারেশন শুরু করি। যাতে জনগণ জানতে পারে আমরা এসেছি। বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগী দোসররা চট্টগ্রাম শহরসহ রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারীতে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিœসংযোগ করছে। পাক বাহিনী বাঙালী যারা পাকিস্তান সমর্থক তারা এ সব কাজে সহযোগিতা করে। এবং সালাউদ্দিন কাদের তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সাক্ষী আরও বলেন, আমার সঙ্গে একটি পরিবারের সাক্ষাত হয়। মোজাফ্ফর সাহেবের ছেলে দেখা করে অভিযোগ দেয়, তার পিতা ও ভাইকে সাকা চৌধুরী শনাক্ত করে এবং তার নেতৃত্বে পাক বাহিনী গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ রকম অভিযোগ শুনে অন্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করি। এরপর ইনফরমার নিয়োগ করলাম। আমরা বিভিন্ন সেন্টারে সেন্টার মাস্টার ও ইনফরমার নিয়োগ করি, যা আমাদের কাজের জন্য প্রযোজনীয় ছিল।
মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব-উল- আলম সাক্ষ্যে বলেন, আমরা লোকাল ছেলেদের রিক্রুট করে গ্রেনেড খোলা ও ছুড়ে মারা শিখিয়েছি। আমাদের কাছে আরাও খবার আসে ঊনসত্তরপাড়া, রাউজান ম্যাসাকার হচ্ছে। এ সব জায়গা থেকে খবর আসে সাকার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ও আলসামস দ্বারা এ গুলো হচ্ছে। আরও খবর আসে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে গুডস হিলে নেয়া হয়। এবং সেখানে রেখে হত্যা এবং নির্যাতন, গুম করা হয়। এগুলোর নেতৃত্বে সাকা চৌধুরীর নাম আসে।
জবানবন্দী শেষে তাকে জেরা করতে ৩০ আগস্ট দিন ধার্য করে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম মুলতবি করা হয়। ৪ এপ্রিল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে সুনির্দিষ্ট ২৩টি ঘটনায় ৭২টি অভিযোগ গঠন করা হয়। তাকে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ১৯ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফতার দেখানো হয়। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর অপর একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
গত বছরের ৪ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্ত রিপোর্টে ৫৫ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রের সঙ্গে এক হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্রসহ ১৮টি সিডি উপস্থাপন করা হয়। গত ১৪ নবেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়। ১৮ নবেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
আব্দুল আলীম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিশন পক্ষের সাক্ষী আবদুল মোমেনকে জেরা করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী এইএম খলিলুর রহমান। তবে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের বাবা মারা যাওয়ায় জেরা অসমাপ্ত রেখেই ট্রাইব্যুনালের কাজ শেষ হয়। মঙ্গলবার বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই জেরার কাজ চলে।
সাঈদী
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাফাই সাক্ষীর জন্য পাঁচজনের তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন তার আইনজীবী। মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারক নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর পক্ষে ডিফেন্সের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে এসব সাক্ষীর নামের তালিকা জমা দেন।
এর আগে গত ১৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল-১ এ ৪৮ জন সাফাই সাক্ষীর আবেদন করলে ২০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য দিতে পারবে মর্মে আদেশ দেয়া হয়। সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, আমরা আমাদের পক্ষে পাঁচজন সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছি এবং সময়ের আবেদন করেছিলাম। আদালত সময় না দিয়ে বুধবার সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ঠিক করে দেন।
২৩ আগস্ট আসামিপক্ষকে ২০ জন সাক্ষীর তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ২৮ আগস্ট আসামিপক্ষের সাক্ষী হাজিরের জন্য ধার্য ছিল। ২৩ তারিখ তালিকা জমা না দিয়ে মঙ্গলবার তারা পাঁচজন সাক্ষীর তালিকা জমা দেন।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষী আবদুল মোমেনকে জেরা করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী এইএম খলিলুর রহমান। তবে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের বাবা মারা যাওয়ায় জেরা অসমাপ্ত রেখেই ট্রাইব্যুনালের কাজ শেষ হয়। মঙ্গলবার চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল-২ এ এই জেরা অনুষ্ঠিত হয়।
ট্রাইব্যুনাল-১ এ মঙ্গলবার ১০ সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কাজী মোঃ নূরুল আফছার ও ১১তম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা এসএম মাহবুব-উল আলম ট্রাইব্যুনালে সাকার বিরুদ্ধে একাত্তরের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দী প্রদান করেন। দশম সাক্ষী মোঃ নূরুল আফছার তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, সাকা চৌধুরী তাদের গুডস হিলের বাসায় স্বাধীনতাকামী লোকদের ধরে এনে অত্যাচার করত। কে বাঁচবে কি বাঁচবে না এটা জানার জন্য ডা. সমির উদ্দিনের বাসায় গভীর রাতে গাড়িতে করে গোপনে নিয়ে যেত। ডা. সমির চেক করার পরে যাদের বাঁচার সম্ভাবনা ছিল তাদের হয় জেলে না হয় তাদের পছন্দ কোন লোকের কাছে হস্তান্তর করা হতো। আর যাদের বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না তাদের ধ্বংস করে ফেলত। তাদের আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যেত না। একই ভাবে মাহবুব আলমের কোন খোঁজ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে ১১তম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব-উল-আলম তাঁর জবানবন্দীতে বলেছেন, ট্রেনিং শেষে মেজর জিয়াউর রহমান তাঁকে গ্রুপ কমান্ডার নিয়োগ দান করেন। এরপর জিযাউর রহমান একটি হিটলিস্ট দেন । সেখানে কয়েকজনের নাম ও প্রতিষ্ঠানের নামসহ ২২টি অপারেশনের নাম ছিল। ঐ হিটলিস্টে প্রথম নাম ছিল ফজলুল কাদের চৌধুরী, দ্বিতীয় নাম ছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরী। তৃতীয় নাম ছিল দেওয়ান বাজারের দিদার মিয়া, চতুর্থ নাম ছিল চানগাঁও থানার মুসলিম লীগ নেতা শরাফত উল্লা। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামসহ রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারীতে যে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ হয়েছে তার নেতৃত্ব দিয়েছেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
মোঃ নূরুল আফছার
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দশম সাক্ষী মোঃ নূরুল আফছার জবানবন্দী প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁর বিবরণ প্রদান করা হলো।
সাক্ষী তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম কাজী নূরুল আবছার, পিতা কাজী মোঃ জাবের, মা-কাজী যায়েদা বেগম। সাক্ষী বলেন, একাত্তর সালে আমার বয়স ছিল ২০ বছর। আমি ১৯৭০ সালে ডিগ্রী পাস করি। তিনি বলেন, আমি ৭১ সালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তখন আমি রাঙ্গুনিয়া থানা ও কলেজ শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। আমার পরে মাহবুব আলম কলেজ শাখার সভাপতি হন। তিনি আমার সঙ্গে একমত ছিলেন। তিনি ওই সময় বাড়িতে না থেকে খাতুনগঞ্জে তাঁর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান শাহেব মিঞা এন্ড সন্সে থাকতেন। তখন পরিস্থিতি এতই খারাপ ছিল যে, তাঁর সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগ করা সম্ভব হতো না।
সাক্ষী বলেন, ওই সময় আমার সৈয়দ মাহবুব আলমের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং আমি তাঁর দলে রিক্রুট হই। আমি খাওয়া ও থাকার দায়িত্ব পালন করি। ইতোমধ্যে জুন-জুলাইয়ের মধ্যে খাতুনগঞ্জের মাহবুবের কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি। আমাদের চন্দনপুরায় বন্ধুবান্ধবদের একটা আড্ডা ছিল। সেখানেও আলাপ আলোচনা হয় মাহবুবকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমি যে ধরনের দৈহিক বর্ণনা দিয়েছি সে ধরনের একটা ছেলে আমার বন্ধুর বাসায় আহত অবস্থায় আছে। সেই বন্ধুর কাছে জানতে পারি সাকা চৌধুরীর গুডস্ হিলের বাড়িতে স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে এনে অত্যাচার করে। তাদের মধ্যে যারা বেশি অত্যাচারিত হতো তার অবস্থা জানার জন্য গভীর রাতে গোপনে ডা. সমিউদ্দিনের বাসায় নিয়ে যাওয়া হতো কে বাঁচবে কে বাঁচবে না তা জানার জন্য।
ওই সময় ডা. সমিরউদ্দিন তাদের দেখার পরে হয় তাদের জেলে অথবা তাদের পছন্দের লোকদের কাছে হস্তান্তর করত অন্যদের মেরে ফেলা হতো। মাহবুবের গ্রামের বাড়ির ইউসুফ খান নামে একটি ছেলে তার সমবয়সী ছিল। সে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসার পরে তাকে গুডস হিলে নিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করানো হয়। ইউসুফ খান সাকার সকল কাজের সহযোগী হয়ে যায়।
সাক্ষী বলেন, সাকা চৌধুরীসহ ইউসুফ, মাকসুদ, খোকা, জিয়াউদ্দিন এরা খাতুনগঞ্জ থেকে মাহবুব আলমকে গুডস্ হিলে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আমরা আজিজ উদ্দিনের কাছে জানতে পারি নির্যাতনের ফলে তাদের গায়ে কোন চামড়া ছিল না। পেরেক মারা টেবিলের ওপরে তক্তা চাপা দিয়ে তাদের নির্যাতন করা হতো। ফলে তার বাঁচার কোন সম্ভাবনা ছিল না এবং আজও পর্যন্ত তার কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি।
সাক্ষী বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক করা হয় যে, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাকে খতম করতে হবে। তবে তিনি যথেষ্ট গার্ডের মধ্যে থাকতেন। ফলে তার বিরুদ্ধে কোন কিছু করা খুব সহজ বিষয় ছিল না।তিনি বলেন, পরে আমি আমার গ্রুপ কমান্ডার এসএম মাহবুবের সঙ্গে কথা বললাম। তখন মাহবুব তাঁর দলের দু’জনের সঙ্গে আলাপ করে আমাকে রেকি করার দায়িত্ব দেয়। রেকি শেষে আমরা একত্রে চারজন মিটিং করি। মিটিংয়ে আমরা আমাদের প্রোগ্রামের দায়িত্ব বণ্টন করি। আমি রাস্তা চেক দেয়ার দায়িত্ব নেই। ওই দিন পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি ছাড়া বাকি তিনজন তাদের অস্ত্র নিয়ে যার যার অবস্থান গ্রহণ করেন।
সাক্ষী বলেন, সাকা চৌধুরী এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ ডা. সমিরউদ্দিনের বাড়িতে দাওয়াতে যান। ওই সময় আমি রাস্তার উপরে দাঁড়ানো ছিলাম। আমার সঙ্গী তিনজন সমিরউদ্দিনের বাড়ির বড় একটি ড্রেনের স্লাবের ওপর অবস্থান নিয়ে ছিল। আমরা সংবাদ পেয়েছিলাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজে গাড়ি চালিয়ে আসছে। কিন্তু ওই দিন সে নিজে গাড়ি না চালিয়ে ড্রাইভার চালাচ্ছিল। আমাদের লক্ষ্য ছিল ড্রাইভিং ছিটে। গুলি চালালে ড্রইভারের গায়ে গুলি লাগে। সাকা চৌধুরীর পায়ে গুলির স্পিøন্টার লেগে আহত হয়। পরের দিন লোক মুখে পত্রিকা পড়ে জানতে পারি ড্রাইভার মারা গেছে। পরে সাকা বিদেশ চলে যায়। সাক্ষীর জবানবন্দী শেষে তাকে একটি প্রশ্ন করে জেরার কার্যক্রম মুলতবি করা হয়।
মাহবুব-উল-আলম
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ¦িবরুদ্ধে ১১তম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব-উল- আলম মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দী প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁর জবানবন্দী প্রদান করা হলো।
আমার নাম এসএম মাহবুব-উল- আলম, পিত- ইসহাক মিয়া, মাতা-সৈয়দা কুলসুম খাতুন। বয়স ৬৩ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ২২ /২৩ বছর। ১৯৭০ সালে এইচএসসির ছাত্র ছিলাম। বর্তমানে ব্যবসা করি। ১৯৬৯ সালে আমি গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। ৭০-এর নির্বাচনের পর একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
২৫ মার্চ রাতে পাকহানাদার কর্তক ম্যাসাকার শুরু হবার পরে চট্টগ্রাম পাকবাহিনী আংশিক দখল করে। পরে আমি রামগড়ে চলে যাই। তৎকালীন ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। মেজর জিয়া তখন রামগড়ে ছিলেন। স্বপন কুমার চৌধুরী তখন মেজর জিয়ার কাছে নিয়ে যান। মেজর জিয়া আমাকে বললেন, পরের দিন সকালের ভিতরে ট্রেনিং সেন্টারে যেতে। আমার সঙ্গে ট্রেনিংয়ে ১৪ জন ছিল। আমরা বিকেলে সেখানে পৌঁছি। ট্রেনিং সেন্টারটি ত্রিপুরা রাজ্যের বোগাফায় অবস্থিত। ওখানে গিয়ে দেখি চট্টগ্রামের ডা. শাহ আলমগীর, বীরউত্তমসহ অন্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত আছেন।
ঐদিন রেস্ট নেয়ার পর পরের দিন ট্রেনিং শুরু হয়। ট্রেনিং ১০ দিন চলে। ওখান থেকে ৪৫ জনের একটি গ্রুপ যার নাম সিটি গ্রুপ ত্রিপুরার উর্মি নগর ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে ট্রেনিং শেষ করে আমাদের হরিণা ক্যাম্পে পাঠানো হয়, যা সাবরুমে অবস্থিত। ওখানে ৭দিন বিশ্রাম করি।
এ সময় মেজর জিয়া সেক্টর কমান্ডার হয়ে যান। তিনি আমাদের ডেকে চট্টগ্রাম শহরের খাল বিল চেনে এ রকম একটি গ্রুপ তৈরি করতে বলেন। আমরা ওখানে ১৬ জনের লিস্ট তৈরি করি। তা জিয়াউর রহমানের হাতে দেই। তিনি সবাইকে ডেকে আনতে বললেন। সবাই এলে উনি সবার সঙ্গে কথা বলেন। ১৬ জনকে উনি একটি ফরম ফিলাপ করালেন। আমাকে ১৬ জনের গ্রুপ কমান্ডার নিয়োগ করেন। আমাদের গ্রুপ নম্বর -৮। নাম ছিল ব্রাভো কোম্পানি। উনি আমাদের সবাইকে অজু গোসল করে পরের দিন সকাল ১০টায় আসতে বলেন। আসার পর পবিত্র কোরানর ওপর উনি হাত দিয়ে শপথ পড়ান। উনি আমাদের একটি হিটলিস্ট দেন ২২টি অপারেশনের জন্য। এর ভিতর প্রথম নাম ছিল ফজলুল কাদের চৌধুরী (ফকা চৌধুরী)। দ্বিতীয় নাম ছিল তার ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরী । তৃতীয় নাম ছিল দিদার মিয়া, চতুর্থ শরাফত উল্লাহ। এর পর বিভিন্ন স্থাপনা উল্লেখ করে অপারেশনের কথা বলা হয়। আমাকে অস্ত্র ও কিছু টাকা পয়সা দেয়া হয়। এর পর আমরা চট্টগ্রামের পথে রওনা হই। আমার সঙ্গে ফজুলল হক ভুইয়া, সৌরেন্দ্র নাথ সেন ওরফে কামাল, মোঃ মহসীন, মোঃ নাসির উদ্দিন, মোঃ জামাল উদ্দিন, দেওয়ান মাহমুদ, প্রণব বড়ুয়া, মোঃ রফিকুল ইসলাম, মোঃ কাশেম, ইউসুফ চৌধুরী, মোঃ নাসির উদ্দিন চৌধুরী (অন্যজন), আহম্মেদ কামরুল হাসান চৌধুরী, জেমস রোজারিও ও আমিসহ ১৬ জন।
চট্টগ্রামের এসে পাথরঘাটা সেন্টারে উঠি। পরে সহযোদ্ধাদের বিভিন্ন সেন্টারে সেট করিয়ে দেয়া হয়। কিছু দিন আমরা বিশ্রাম করি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অপারেশন শুরু করি। যাতে জনগণ জানতে পারে আমরা এসেছি। বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগী দোসররা চট্টগ্রাম শহরসহ রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারীতে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিœসংযোগ করছে। পাক বাহিনী বাঙালী যারা পাকিস্তান সমর্থক তারা এ সব কাজে সহযোগিতা করে। এবং সালাউদ্দিন কাদের তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সাক্ষী আরও বলেন, আমার সঙ্গে একটি পরিবারের সাক্ষাত হয়। মোজাফ্ফর সাহেবের ছেলে দেখা করে অভিযোগ দেয়, তার পিতা ও ভাইকে সাকা চৌধুরী শনাক্ত করে এবং তার নেতৃত্বে পাক বাহিনী গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ রকম অভিযোগ শুনে অন্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করি। এরপর ইনফরমার নিয়োগ করলাম। আমরা বিভিন্ন সেন্টারে সেন্টার মাস্টার ও ইনফরমার নিয়োগ করি, যা আমাদের কাজের জন্য প্রযোজনীয় ছিল।
মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব-উল- আলম সাক্ষ্যে বলেন, আমরা লোকাল ছেলেদের রিক্রুট করে গ্রেনেড খোলা ও ছুড়ে মারা শিখিয়েছি। আমাদের কাছে আরাও খবার আসে ঊনসত্তরপাড়া, রাউজান ম্যাসাকার হচ্ছে। এ সব জায়গা থেকে খবর আসে সাকার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ও আলসামস দ্বারা এ গুলো হচ্ছে। আরও খবর আসে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে গুডস হিলে নেয়া হয়। এবং সেখানে রেখে হত্যা এবং নির্যাতন, গুম করা হয়। এগুলোর নেতৃত্বে সাকা চৌধুরীর নাম আসে।
জবানবন্দী শেষে তাকে জেরা করতে ৩০ আগস্ট দিন ধার্য করে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম মুলতবি করা হয়। ৪ এপ্রিল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে সুনির্দিষ্ট ২৩টি ঘটনায় ৭২টি অভিযোগ গঠন করা হয়। তাকে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ১৯ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফতার দেখানো হয়। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর অপর একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
গত বছরের ৪ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্ত রিপোর্টে ৫৫ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রের সঙ্গে এক হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্রসহ ১৮টি সিডি উপস্থাপন করা হয়। গত ১৪ নবেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়। ১৮ নবেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
আব্দুল আলীম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিশন পক্ষের সাক্ষী আবদুল মোমেনকে জেরা করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী এইএম খলিলুর রহমান। তবে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের বাবা মারা যাওয়ায় জেরা অসমাপ্ত রেখেই ট্রাইব্যুনালের কাজ শেষ হয়। মঙ্গলবার বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই জেরার কাজ চলে।
সাঈদী
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাফাই সাক্ষীর জন্য পাঁচজনের তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন তার আইনজীবী। মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারক নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর পক্ষে ডিফেন্সের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে এসব সাক্ষীর নামের তালিকা জমা দেন।
এর আগে গত ১৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল-১ এ ৪৮ জন সাফাই সাক্ষীর আবেদন করলে ২০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য দিতে পারবে মর্মে আদেশ দেয়া হয়। সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, আমরা আমাদের পক্ষে পাঁচজন সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছি এবং সময়ের আবেদন করেছিলাম। আদালত সময় না দিয়ে বুধবার সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ঠিক করে দেন।
২৩ আগস্ট আসামিপক্ষকে ২০ জন সাক্ষীর তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ২৮ আগস্ট আসামিপক্ষের সাক্ষী হাজিরের জন্য ধার্য ছিল। ২৩ তারিখ তালিকা জমা না দিয়ে মঙ্গলবার তারা পাঁচজন সাক্ষীর তালিকা জমা দেন।
No comments