সাক্ষাৎকার-ন্যাম উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্যকর ফোরাম by ড. দেলোয়ার হোসেন
সাক্ষাৎকার গ্রহণ :সুভাষ সাহা ও মাহফুজুর রহমান মানিকঅধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এর আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে (বিআইআইএসএস) গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ
করেন। ২০০৯ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এডিবি ও মনোবসু বৃত্তি নিয়ে তিনি জাপান থেকে যথাক্রমে স্নাতকোত্তর (২০০১) ও পিএইচডি (২০০৭) ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে ১৯৮৮ সালে স্নাতক এবং ১৯৮৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণার ক্ষেত্রে তার আগ্রহের বিষয় বৈশ্বিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন; বৈদেশিক নীতি ও নিরাপত্তা; বিশ্বায়নের রাজনীতি প্রভৃতি। এসব বিষয়ে তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১০ সালে তার প্রকাশিত বইয়ের নাম গ্গ্নোবালাইজেশন অ্যান্ড নিউ রিজিওনালিজম ইন সাউথ এশিয়া : ইস্যুস অ্যান্ড ডাইনামিকস। ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণকারী ড. দেলোয়ার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষণা
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত
সমকাল : একটু পেছন থেকে শুরু করি। ২০০১ সালে বাংলাদেশ ছিল ন্যামের (জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন) হোস্ট কান্ট্রি। কিন্তু সরকার ন্যাম শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে সেবার ন্যাম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তখন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেছিলেন, 'ন্যাম নাউ ইজ অ্যা ডেড হর্স'। এখন এমন কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যে, সারা দুনিয়ায় ন্যাম সম্মেলন নিয়ে বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে?
দেলোয়ার হোসেন :অনেকে অনেক কথা বলেন, কখনও আমরা গুরুত্বহীন বিষয়কে গুরুত্ব দেই। আবার অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগুরুত্বপূর্ণ বলে উড়িয়ে দেই। সাইফুর রহমান তার স্ট্যান্ড থেকে কথাটি বলেছেন। তিনি বিএনপিকে রিপ্রেজেন্ট করেন। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাদের একটা ভাব ছিল। সে যাই হোক, কথা হলো জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) ডেড হর্স কিনা। উত্তর হলো, না। এবারের তেহরানে ন্যাম সম্মেলনই তার প্রমাণ। ন্যাম কেন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা দেখাও জরুরি। এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে ন্যাটোর দরকার নেই, কারণ ১৯৪৯ সালে ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক সম্প্রসারণ দমন করার জন্য। এখন সোভিয়েত ইউনিয়নও নেই, সে অবস্থাও নেই। তাই বলে ন্যাটোর দরকার নেই এটা বলা যাবে না।
সমকাল :রাশিয়াও বলেছে ন্যাটোর দরকার নেই।
দেলোয়ার হোসেন : হ্যাঁ, রাশিয়া বলেছে। তবে আগে যারা ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো অবস্থায় ছিল তাদের কেউ কেউ এখন ন্যাটোর সদস্য। অর্থাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবস্থানের পরিবর্তন হয়। ন্যাটো একটা গ্গ্নোবাল এলায়েন্স। বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তা রক্ষা ইত্যাদির জন্য ন্যামের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামের সবসময়ই প্রয়োজন আছে। ন্যাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যখন গোটা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে দুটি এলায়েন্স ছিল। তখন এই দুই ধারার বাইরে গিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা তৈরির প্লাটফর্মই হলো ন্যাম। যেটার প্রাসঙ্গিকতা এখনও আছে বলে আমি মনে করি।
সমকাল :তৃতীয় ধারা বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? ন্যাম কার্যকর কোনো ফোরাম বা সংস্থা নয়_ এমন ধারণা রয়েছে...
দেলোয়ার হোসেন : ন্যামকে বলা হচ্ছে গল্প করার জায়গা। এমনকি অন্যান্য সংস্থা যেমন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনকেও অনেকে তেমনই মনে করেন। এরকম ন্যাম, আসিয়ান, অন্যান্য আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সামিট নিয়েও এসব কথা বলা হয়। যারা এসব কথা বলেন, তারা অনেক কথা বুঝে বলেন আবার না বুঝেও বলেন। আসলে ন্যাম বলুন আর যাই বলুন, এগুলো সবই তো রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত সংস্থা। রাষ্ট্রগুলো চাইলে এগুলো কার্যকর হবে, না চাইলে হবে না। এটা সম্পূর্ণই রাষ্ট্রের ইচ্ছা। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বা ফ্রান্স, জার্মানি চেয়েছে ইইউ-কে কার্যকর করতে, তারা সেটা করেছে। তারা বিশ্বে একটি সফল সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। এমনকি সার্কের ক্ষেত্রেও সেটা বলা যায়।
তৃতীয় ধারা বলতে আসলে বোঝাতে চাইছি, ১৯৪৫ সাল থেকে বিশ্বব্যবস্থায় দুটি ধারা আধিপত্য বিস্তার করেছে। পূর্ব এবং পশ্চিম_ দুটি ধারা। পূর্ব-পশ্চিম বা সমাজতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী ধারা। এই দুই ধারা যখন বিশ্বে সামগ্রিকভাবে ডমিনেট করছিল, এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও ডমিনেট করেছে, তখন এখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ হয়েছে। যেমন ষাটের দশকের শুরুতে ফিদেল কাস্ত্রো, জওয়াহেরলাল নেহরু, মার্শাল টিটো, গামাল আবদুল নাসের, তারা বিভিন্ন মতাবলম্বী কেউ গণতান্ত্রিক, কেউ অটোক্রেটিক, কেউ জাতীয়তাবাদী_ এ রকম সবাই মিলে এই দুই ধারার আধিপত্য থেকে বের হওয়ার জন্য একটা তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করার চিন্তা করছিল। সেটা বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, সেই ধারা থেকেই ন্যাম এসেছে এবং এটা আজও প্রাসঙ্গিক_ এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমি একে তৃতীয় ধারা বলেছি।
সমকাল : ন্যাম সম্মেলনে যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় তা কতটা কার্যকর?
দেলোয়ার হোসেন : জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা জাতিসংঘের অধিবেশনের মতো বিশ্ব কূটনীতিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সংস্থা হিসেবে যদি বলা হয়, বিশ্বে আসিয়ান, ইইউ ছাড়া যাদের নির্দিষ্ট সদর দফতর আছে, ক্লোজ মেম্বার, সেক্রেটারিয়েট আছে যেমন ওআইসি, আরব লীগ তারাও তো যে সফল সেটা সেভাবে যাবে না। এটা আসলে একটা আপেক্ষিক প্রশ্ন। তার ক্রাইটেরিয়াই কী, এখানে সাফল্য-ব্যর্থতা সরাসরি মূল্যায়নের সুযোগ নেই। কার্যকরের কথা বললে, কারা কার্যকর করবে সে প্রশ্ন এসে যায়। বিশ্বে যে রাষ্ট্রগুলো আধিপত্য বিস্তার করে বিশ্ব রাজনীতিতে যেমন আমেরিকা বা অর্থনীতির দিক থেকে আধিপত্য রয়েছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ। এ রকম উন্নয়নশীল দেশেরও তো একটা প্লাটফর্ম চাই। যেহেতু ছোট ছোট অনেক সংস্থা আছে, সেহেতু এখন এককভাবে কোনো সংস্থাকে জনপ্রিয় করার সুযোগ নেই। এখন যেহেতু আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত একটি বড় সংস্থা রয়েছে সে হিসেবে আমরা ন্যামকে ব্যবহার করতে পারি।
সমকাল : শীতল যুদ্ধ পর্যন্ত ওয়েস্টফালিয়া স্টেটের সিস্টেম কার্যকর ছিল। এখন শীতল যুদ্ধ পরিস্থিতি নেই। এখনও কি ছোট রাষ্ট্রগুলো তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বলিষ্ঠভাবে আওয়াজ তোলার জন্য ন্যাম উন্নয়নশীল বিশ্বের কণ্ঠস্বর হিসেবে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে?
দেলোয়ার হোসেন : আমার তো মনে হয় ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেমে রাষ্ট্রগুলোর যে স্বাধীনতা-সার্বভৗমত্ব শীতল যুদ্ধের সময় আরও বেশি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তখন তো মনে করা হতো, কেবল যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নই স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। অন্য দেশগুলোর ওপর এদের হস্তক্ষেপের অনেক প্রমাণ আছে। অনেক দেশই তাদের হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। এখন তো বলা চলে হস্তক্ষেপ কমেছে। তবে এখনও তা চলছে। এখন অবশ্য দু'ধরনের হস্তক্ষেপ হচ্ছে_ একটা হচ্ছে ইরাক এবং আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের নামে। আরেকটা হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক হস্তক্ষেপ। আমরাও তো এ ধরনের হস্তক্ষেপের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি। যেমন জাতিসংঘ শান্তি মিশনে আমরা সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছি, তারা সোমালিয়া, আইভরি কোস্ট, ইথিওপিয়া ইত্যাদিতে হস্তক্ষেপ করছে। এখানেও বলা চলে ওয়েস্টফালিয়া কনসেপ্ট কম্প্রোমাইজ করা হচ্ছে। গ্গ্নোবালাইজেশনের কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আসছে বাইরের বিশ্ব থেকে তাও তো এক ধরনের প্রভাব। এই প্রভাবের কারণে রাষ্ট্রগুলো চাইলেও তার নাগরিকদের ওপর সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ খাটাতে পারছে না।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা হস্তক্ষেপের দিক বিচার করলেও আছে। মিসরে অনুষ্ঠিত ১৫তম সম্মেলনের ঘোষণায় রাষ্ট্রগুলোর সংস্কৃতি, সার্বভৌমত্ব, স্বকীয়তা রক্ষায় ন্যাম ভূমিকা রাখবে বলা হয়েছে।
সমকাল : দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসান, পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা... ন্যামের সাফল্য বলে মনে করা হয়...
দেলোয়ার হোসেন : হ্যাঁ, ন্যামের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান হিসেবে দেখা হয়। এ ছাড়া বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্ব পরাশক্তিদের যে ব্যাপক প্রভাব তা থেকে বিশ্বকে কিছুটা মুক্ত করার চেষ্টা তারা করতে পেরেছে। সত্তরের দশকে এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটা সফল হয়েছে এবং অব্যাহতভাবে তারা এটা করেছে। তবে শীতল যুদ্ধের অবসানের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ফ্রন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ন্যাম। আর তখনই এককেন্দ্রিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সর্বত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তার করেছে। এমনকি প্যালেস্টাইন ইস্যু নিয়ে ন্যাম যে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিল সেটাও দুর্বল হয়েছে। সে সময় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেমন ন্যাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, একই সঙ্গে অন্যান্য সংস্থা যেমন আঙ্কটাড, জি-৭৭ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; যেগুলো এক সময় ন্যামের কারণেই শক্তিশালী ছিল।
সমকাল : ন্যাম তো জাতিসংঘের পুনর্গঠন চেয়েছে...
দেলোয়ার হোসেন : ন্যাম জাতিসংঘের পুনর্গঠন চেয়েছে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নিজেদের অংশগ্রহণ চেয়েছে এবং সেটা প্রতিষ্ঠিতও হতো। কিন্তু শীতল যুদ্ধের পর জাতিসংঘে ন্যামের দাবিগুলো শক্তিহীন হয়ে পড়েছে।
সমকাল :এবারের ন্যাম সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য তেহরানে যেতে জাতিসংঘের মহাসচিবকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল বলা চলে দৃষ্টিকটুভাবে বারণই করেছে। এটা কী কারণে হয়েছে?
দেলোয়ার হোসেন : এবারের ন্যাম শীর্ষ সম্মেলন নিশ্চয়ই ইরানের জন্য একটা বোনানজা, ডিপ্লোম্যাটিক বোনানজা। এটা অবশ্য আগ থেকেই নির্ধারণ করা সম্মেলন। তবে টাইমিংটা এখন ইরানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের যে সম্পর্ক তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইরান বলেছে, তারা শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে চায়। অথচ পশ্চিমা বিশ্ব বলছে, তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে। এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে চাপে ফেলতে চায়। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি দু'ধরনের_ ইরানের জন্য এক রকম আর ইসরায়েলের জন্য এক রকম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল জাতিসংঘের মহাসচিবকে যেতে বারণ করেছে। কারণ, তারা চায় যাতে এ সম্মেলনের মাধ্যমে ইরান বাড়তি কূটনৈতিক সুবিধা না পেয়ে যায়। জাতিসংঘ মহাসচিব তেহরান সম্মেলনে যোগ দিলে এর গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। আগের সম্মেলনগুলোতেও জাতিসংঘ মহাসচিব গিয়েছিলেন।
সমকাল : সম্মেলনে বিভিন্ন শক্তিধর দেশ যোগ দিচ্ছে, সেখানে শতাধিক দেশ যোগ দিচ্ছে। ভারতসহ ৫১টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং উপ-রাষ্ট্রপতি মর্যাদার নেতারা যোগ দিচ্ছেন। এতে কি মনে হচ্ছে, উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে কথা বলার জায়গাটি শক্তিশালী হচ্ছে...
দেলোয়ার হোসেন : হ্যাঁ, ভারতসহ অনেকে যাচ্ছে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সম্পর্ক তাতে ভারতের অংশগ্রহণের বিষয়টা হাস্যকর মনে হতে পারে। বিষয়টাকে এভাবে দেখা উচিত নয়। তবে এটা ঠিক, কথা বলার জন্য এটা ভালো জায়গা। কারণ, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভক্তি, সেটা অর্থনীতির ক্ষেত্রেই হোক, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বা অন্য যে কারণেই হোক, উন্নয়নশীল বিশ্ব যদি একত্র হয়, কথা বলে, একটা প্লাটফর্ম হয়, সেটা উন্নয়নশীল বিশ্বে উন্নত বিশ্বের হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে একটা বাধা হতে পারে। তখন তারা ভাববে যে, এর বিরুদ্ধে একটা জনমত সৃষ্টি হচ্ছে, কথা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ঐক্য আছে। তখন তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অনেক ভাবনাচিন্তা করবে। আর ন্যাম সম্মেলনটাই হতে পারে এ ধরনের কথা বলার অন্যতম জায়গা।
সমকাল : এখন প্রায় দুই ডজন উন্নয়নশীল দেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে, সব সূচকে তাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। চীন, ভারত, ব্রাজিল,.. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও চমকে দেওয়ার মতো। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এটা এ সম্মেলনকে প্রভাবিত করবে?
দেলোয়ার হোসেন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন ইরানকে আইসোলেটেড করতে চাইছে এবং একই সঙ্গে অনেকেই ইরানের পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে কথা বলেছে বটে, তাদের অনেকেই হয়তো এ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে, তার মানে এই নয় যে তারা ইরানকে সমর্থন করছে। এমনকি তারা এও মনে করে যে, ন্যাম আর আগের মতো নেই। ইরান যদি একটা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারে আর তা যদি হয় সেটা মাথাব্যথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের; অন্য দেশগুলোর নয়। আমরা তো মনে করি ক্ষমতার ব্যালেন্সের জন্য বরং এটা ভালো।
উন্নয়নশীল দেশগুলো এখানে আসছে। এখন একেক দেশ একেকভাবে উন্নয়ন করছে। সব যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফের মাধ্যমে হচ্ছে তা নয়। তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় হচ্ছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে একটা সম্পর্ক থাকবে, যেটা আমরা মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে দেখেছি। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সখ্য থাকতে হবে তা নয়। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের ওপর হামলা করে সেখানে বাংলাদেশ যেমন জাতিসংঘের সহায়তা চাইবে, ঠিক একইভাবে ন্যামেরও প্রতিক্রিয়া চাইবে এবং ন্যাম তা করবেও।
সমকাল : চীন, রাশিয়া তো সিরিয়ায় হামলা সমর্থন করছে না। এখন এ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা তাদের অবস্থানের পক্ষে তার একটা অনুসমর্থন তৈরি করবে কি?
দেলোয়ার হোসেন : সেটা করতেই পারে, যদিও চীন ন্যামের অবজার্ভার কান্ট্রি। সিরিয়ার ব্যাপারে মতপার্থক্য সুস্পষ্ট। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র শক্তি, অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন। যদিও মার্কিন পক্ষ শক্তিশালী। এ সম্মেলন সিরিয়ার পক্ষে একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত আসতে পারে। তবে এর দ্বারা সংকট উত্তরণ হবে বলে মনে হয় না।
সমকাল : ন্যাম সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ কীভাবে উপকৃত হতে পারে?
দেলোয়ার হোসেন : পত্রিকাগুলোই তো বলছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ হচ্ছে ন্যাম সম্মেলনে। এ রকম বহু গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বসার একটা ভালো জায়গা বা উপলক্ষ হতে পারে ন্যাম সম্মেলন। এটা বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের একটা বিরাট মাধ্যম। শুধু ন্যাম নয়, যে কোনো সম্মেলনের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। ন্যাম জাতিসংঘের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্লাটফর্ম। ্বাংলাদেশ এর সঙ্গে যুক্ত থেকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক বাড়াতে পারে সহজেই।
সমকাল :তাহলে ন্যাম এখনও প্রাসঙ্গিক?
দেলোয়ার হোসেন : অবশ্যই ন্যাম প্রাসঙ্গিক। ন্যাম তো একটা প্লাটফর্ম। বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। যারা ন্যামের বিরোধিতা করেন তারাও কেন বিরোধিতা করেন ...
সমকাল : তাহলে ২০০১-এ ঢাকায় ন্যাম সম্মেলন বাতিল করা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইতিহাসে বিরাট ব্যর্থতা ...
দেলোয়ার হোসেন : বাংলাদেশের জন্য এটা আসলেই কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বাংলাদেশের শক্তির জায়গা আসলে কূটনীতি। ন্যাম সম্মেলন বাংলাদেশে হলে সবাই মিলেই এর অর্থায়নও করত, বাংলাদেশকে হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে হয়তো একটু বেশি করতে হতো। এর মাধ্যমে ন্যামে কথা বলার জন্যও আমাদের একটা শক্তিশালী অবস্থান থাকত। বিশ্ব রাজনীতিতে প্রত্যেকটা রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সে রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের, যোগাযোগের একটা বড় মাধ্যম হতে পারত।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
দেলোয়ার হোসেন : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত
সমকাল : একটু পেছন থেকে শুরু করি। ২০০১ সালে বাংলাদেশ ছিল ন্যামের (জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন) হোস্ট কান্ট্রি। কিন্তু সরকার ন্যাম শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে সেবার ন্যাম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তখন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেছিলেন, 'ন্যাম নাউ ইজ অ্যা ডেড হর্স'। এখন এমন কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যে, সারা দুনিয়ায় ন্যাম সম্মেলন নিয়ে বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে?
দেলোয়ার হোসেন :অনেকে অনেক কথা বলেন, কখনও আমরা গুরুত্বহীন বিষয়কে গুরুত্ব দেই। আবার অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগুরুত্বপূর্ণ বলে উড়িয়ে দেই। সাইফুর রহমান তার স্ট্যান্ড থেকে কথাটি বলেছেন। তিনি বিএনপিকে রিপ্রেজেন্ট করেন। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাদের একটা ভাব ছিল। সে যাই হোক, কথা হলো জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) ডেড হর্স কিনা। উত্তর হলো, না। এবারের তেহরানে ন্যাম সম্মেলনই তার প্রমাণ। ন্যাম কেন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা দেখাও জরুরি। এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে ন্যাটোর দরকার নেই, কারণ ১৯৪৯ সালে ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক সম্প্রসারণ দমন করার জন্য। এখন সোভিয়েত ইউনিয়নও নেই, সে অবস্থাও নেই। তাই বলে ন্যাটোর দরকার নেই এটা বলা যাবে না।
সমকাল :রাশিয়াও বলেছে ন্যাটোর দরকার নেই।
দেলোয়ার হোসেন : হ্যাঁ, রাশিয়া বলেছে। তবে আগে যারা ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো অবস্থায় ছিল তাদের কেউ কেউ এখন ন্যাটোর সদস্য। অর্থাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবস্থানের পরিবর্তন হয়। ন্যাটো একটা গ্গ্নোবাল এলায়েন্স। বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তা রক্ষা ইত্যাদির জন্য ন্যামের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামের সবসময়ই প্রয়োজন আছে। ন্যাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যখন গোটা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে দুটি এলায়েন্স ছিল। তখন এই দুই ধারার বাইরে গিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা তৈরির প্লাটফর্মই হলো ন্যাম। যেটার প্রাসঙ্গিকতা এখনও আছে বলে আমি মনে করি।
সমকাল :তৃতীয় ধারা বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? ন্যাম কার্যকর কোনো ফোরাম বা সংস্থা নয়_ এমন ধারণা রয়েছে...
দেলোয়ার হোসেন : ন্যামকে বলা হচ্ছে গল্প করার জায়গা। এমনকি অন্যান্য সংস্থা যেমন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনকেও অনেকে তেমনই মনে করেন। এরকম ন্যাম, আসিয়ান, অন্যান্য আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সামিট নিয়েও এসব কথা বলা হয়। যারা এসব কথা বলেন, তারা অনেক কথা বুঝে বলেন আবার না বুঝেও বলেন। আসলে ন্যাম বলুন আর যাই বলুন, এগুলো সবই তো রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত সংস্থা। রাষ্ট্রগুলো চাইলে এগুলো কার্যকর হবে, না চাইলে হবে না। এটা সম্পূর্ণই রাষ্ট্রের ইচ্ছা। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বা ফ্রান্স, জার্মানি চেয়েছে ইইউ-কে কার্যকর করতে, তারা সেটা করেছে। তারা বিশ্বে একটি সফল সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। এমনকি সার্কের ক্ষেত্রেও সেটা বলা যায়।
তৃতীয় ধারা বলতে আসলে বোঝাতে চাইছি, ১৯৪৫ সাল থেকে বিশ্বব্যবস্থায় দুটি ধারা আধিপত্য বিস্তার করেছে। পূর্ব এবং পশ্চিম_ দুটি ধারা। পূর্ব-পশ্চিম বা সমাজতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী ধারা। এই দুই ধারা যখন বিশ্বে সামগ্রিকভাবে ডমিনেট করছিল, এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও ডমিনেট করেছে, তখন এখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ হয়েছে। যেমন ষাটের দশকের শুরুতে ফিদেল কাস্ত্রো, জওয়াহেরলাল নেহরু, মার্শাল টিটো, গামাল আবদুল নাসের, তারা বিভিন্ন মতাবলম্বী কেউ গণতান্ত্রিক, কেউ অটোক্রেটিক, কেউ জাতীয়তাবাদী_ এ রকম সবাই মিলে এই দুই ধারার আধিপত্য থেকে বের হওয়ার জন্য একটা তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করার চিন্তা করছিল। সেটা বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, সেই ধারা থেকেই ন্যাম এসেছে এবং এটা আজও প্রাসঙ্গিক_ এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমি একে তৃতীয় ধারা বলেছি।
সমকাল : ন্যাম সম্মেলনে যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় তা কতটা কার্যকর?
দেলোয়ার হোসেন : জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা জাতিসংঘের অধিবেশনের মতো বিশ্ব কূটনীতিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সংস্থা হিসেবে যদি বলা হয়, বিশ্বে আসিয়ান, ইইউ ছাড়া যাদের নির্দিষ্ট সদর দফতর আছে, ক্লোজ মেম্বার, সেক্রেটারিয়েট আছে যেমন ওআইসি, আরব লীগ তারাও তো যে সফল সেটা সেভাবে যাবে না। এটা আসলে একটা আপেক্ষিক প্রশ্ন। তার ক্রাইটেরিয়াই কী, এখানে সাফল্য-ব্যর্থতা সরাসরি মূল্যায়নের সুযোগ নেই। কার্যকরের কথা বললে, কারা কার্যকর করবে সে প্রশ্ন এসে যায়। বিশ্বে যে রাষ্ট্রগুলো আধিপত্য বিস্তার করে বিশ্ব রাজনীতিতে যেমন আমেরিকা বা অর্থনীতির দিক থেকে আধিপত্য রয়েছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ। এ রকম উন্নয়নশীল দেশেরও তো একটা প্লাটফর্ম চাই। যেহেতু ছোট ছোট অনেক সংস্থা আছে, সেহেতু এখন এককভাবে কোনো সংস্থাকে জনপ্রিয় করার সুযোগ নেই। এখন যেহেতু আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত একটি বড় সংস্থা রয়েছে সে হিসেবে আমরা ন্যামকে ব্যবহার করতে পারি।
সমকাল : শীতল যুদ্ধ পর্যন্ত ওয়েস্টফালিয়া স্টেটের সিস্টেম কার্যকর ছিল। এখন শীতল যুদ্ধ পরিস্থিতি নেই। এখনও কি ছোট রাষ্ট্রগুলো তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বলিষ্ঠভাবে আওয়াজ তোলার জন্য ন্যাম উন্নয়নশীল বিশ্বের কণ্ঠস্বর হিসেবে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে?
দেলোয়ার হোসেন : আমার তো মনে হয় ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেমে রাষ্ট্রগুলোর যে স্বাধীনতা-সার্বভৗমত্ব শীতল যুদ্ধের সময় আরও বেশি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তখন তো মনে করা হতো, কেবল যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নই স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। অন্য দেশগুলোর ওপর এদের হস্তক্ষেপের অনেক প্রমাণ আছে। অনেক দেশই তাদের হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। এখন তো বলা চলে হস্তক্ষেপ কমেছে। তবে এখনও তা চলছে। এখন অবশ্য দু'ধরনের হস্তক্ষেপ হচ্ছে_ একটা হচ্ছে ইরাক এবং আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের নামে। আরেকটা হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক হস্তক্ষেপ। আমরাও তো এ ধরনের হস্তক্ষেপের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি। যেমন জাতিসংঘ শান্তি মিশনে আমরা সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছি, তারা সোমালিয়া, আইভরি কোস্ট, ইথিওপিয়া ইত্যাদিতে হস্তক্ষেপ করছে। এখানেও বলা চলে ওয়েস্টফালিয়া কনসেপ্ট কম্প্রোমাইজ করা হচ্ছে। গ্গ্নোবালাইজেশনের কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আসছে বাইরের বিশ্ব থেকে তাও তো এক ধরনের প্রভাব। এই প্রভাবের কারণে রাষ্ট্রগুলো চাইলেও তার নাগরিকদের ওপর সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ খাটাতে পারছে না।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা হস্তক্ষেপের দিক বিচার করলেও আছে। মিসরে অনুষ্ঠিত ১৫তম সম্মেলনের ঘোষণায় রাষ্ট্রগুলোর সংস্কৃতি, সার্বভৌমত্ব, স্বকীয়তা রক্ষায় ন্যাম ভূমিকা রাখবে বলা হয়েছে।
সমকাল : দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসান, পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা... ন্যামের সাফল্য বলে মনে করা হয়...
দেলোয়ার হোসেন : হ্যাঁ, ন্যামের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান হিসেবে দেখা হয়। এ ছাড়া বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্ব পরাশক্তিদের যে ব্যাপক প্রভাব তা থেকে বিশ্বকে কিছুটা মুক্ত করার চেষ্টা তারা করতে পেরেছে। সত্তরের দশকে এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটা সফল হয়েছে এবং অব্যাহতভাবে তারা এটা করেছে। তবে শীতল যুদ্ধের অবসানের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ফ্রন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ন্যাম। আর তখনই এককেন্দ্রিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সর্বত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তার করেছে। এমনকি প্যালেস্টাইন ইস্যু নিয়ে ন্যাম যে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিল সেটাও দুর্বল হয়েছে। সে সময় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেমন ন্যাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, একই সঙ্গে অন্যান্য সংস্থা যেমন আঙ্কটাড, জি-৭৭ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; যেগুলো এক সময় ন্যামের কারণেই শক্তিশালী ছিল।
সমকাল : ন্যাম তো জাতিসংঘের পুনর্গঠন চেয়েছে...
দেলোয়ার হোসেন : ন্যাম জাতিসংঘের পুনর্গঠন চেয়েছে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নিজেদের অংশগ্রহণ চেয়েছে এবং সেটা প্রতিষ্ঠিতও হতো। কিন্তু শীতল যুদ্ধের পর জাতিসংঘে ন্যামের দাবিগুলো শক্তিহীন হয়ে পড়েছে।
সমকাল :এবারের ন্যাম সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য তেহরানে যেতে জাতিসংঘের মহাসচিবকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল বলা চলে দৃষ্টিকটুভাবে বারণই করেছে। এটা কী কারণে হয়েছে?
দেলোয়ার হোসেন : এবারের ন্যাম শীর্ষ সম্মেলন নিশ্চয়ই ইরানের জন্য একটা বোনানজা, ডিপ্লোম্যাটিক বোনানজা। এটা অবশ্য আগ থেকেই নির্ধারণ করা সম্মেলন। তবে টাইমিংটা এখন ইরানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের যে সম্পর্ক তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইরান বলেছে, তারা শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে চায়। অথচ পশ্চিমা বিশ্ব বলছে, তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে। এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে চাপে ফেলতে চায়। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি দু'ধরনের_ ইরানের জন্য এক রকম আর ইসরায়েলের জন্য এক রকম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল জাতিসংঘের মহাসচিবকে যেতে বারণ করেছে। কারণ, তারা চায় যাতে এ সম্মেলনের মাধ্যমে ইরান বাড়তি কূটনৈতিক সুবিধা না পেয়ে যায়। জাতিসংঘ মহাসচিব তেহরান সম্মেলনে যোগ দিলে এর গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। আগের সম্মেলনগুলোতেও জাতিসংঘ মহাসচিব গিয়েছিলেন।
সমকাল : সম্মেলনে বিভিন্ন শক্তিধর দেশ যোগ দিচ্ছে, সেখানে শতাধিক দেশ যোগ দিচ্ছে। ভারতসহ ৫১টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং উপ-রাষ্ট্রপতি মর্যাদার নেতারা যোগ দিচ্ছেন। এতে কি মনে হচ্ছে, উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে কথা বলার জায়গাটি শক্তিশালী হচ্ছে...
দেলোয়ার হোসেন : হ্যাঁ, ভারতসহ অনেকে যাচ্ছে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সম্পর্ক তাতে ভারতের অংশগ্রহণের বিষয়টা হাস্যকর মনে হতে পারে। বিষয়টাকে এভাবে দেখা উচিত নয়। তবে এটা ঠিক, কথা বলার জন্য এটা ভালো জায়গা। কারণ, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভক্তি, সেটা অর্থনীতির ক্ষেত্রেই হোক, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বা অন্য যে কারণেই হোক, উন্নয়নশীল বিশ্ব যদি একত্র হয়, কথা বলে, একটা প্লাটফর্ম হয়, সেটা উন্নয়নশীল বিশ্বে উন্নত বিশ্বের হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে একটা বাধা হতে পারে। তখন তারা ভাববে যে, এর বিরুদ্ধে একটা জনমত সৃষ্টি হচ্ছে, কথা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ঐক্য আছে। তখন তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অনেক ভাবনাচিন্তা করবে। আর ন্যাম সম্মেলনটাই হতে পারে এ ধরনের কথা বলার অন্যতম জায়গা।
সমকাল : এখন প্রায় দুই ডজন উন্নয়নশীল দেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে, সব সূচকে তাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। চীন, ভারত, ব্রাজিল,.. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও চমকে দেওয়ার মতো। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এটা এ সম্মেলনকে প্রভাবিত করবে?
দেলোয়ার হোসেন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন ইরানকে আইসোলেটেড করতে চাইছে এবং একই সঙ্গে অনেকেই ইরানের পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে কথা বলেছে বটে, তাদের অনেকেই হয়তো এ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে, তার মানে এই নয় যে তারা ইরানকে সমর্থন করছে। এমনকি তারা এও মনে করে যে, ন্যাম আর আগের মতো নেই। ইরান যদি একটা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারে আর তা যদি হয় সেটা মাথাব্যথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের; অন্য দেশগুলোর নয়। আমরা তো মনে করি ক্ষমতার ব্যালেন্সের জন্য বরং এটা ভালো।
উন্নয়নশীল দেশগুলো এখানে আসছে। এখন একেক দেশ একেকভাবে উন্নয়ন করছে। সব যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফের মাধ্যমে হচ্ছে তা নয়। তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় হচ্ছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে একটা সম্পর্ক থাকবে, যেটা আমরা মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে দেখেছি। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সখ্য থাকতে হবে তা নয়। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের ওপর হামলা করে সেখানে বাংলাদেশ যেমন জাতিসংঘের সহায়তা চাইবে, ঠিক একইভাবে ন্যামেরও প্রতিক্রিয়া চাইবে এবং ন্যাম তা করবেও।
সমকাল : চীন, রাশিয়া তো সিরিয়ায় হামলা সমর্থন করছে না। এখন এ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা তাদের অবস্থানের পক্ষে তার একটা অনুসমর্থন তৈরি করবে কি?
দেলোয়ার হোসেন : সেটা করতেই পারে, যদিও চীন ন্যামের অবজার্ভার কান্ট্রি। সিরিয়ার ব্যাপারে মতপার্থক্য সুস্পষ্ট। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র শক্তি, অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন। যদিও মার্কিন পক্ষ শক্তিশালী। এ সম্মেলন সিরিয়ার পক্ষে একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত আসতে পারে। তবে এর দ্বারা সংকট উত্তরণ হবে বলে মনে হয় না।
সমকাল : ন্যাম সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ কীভাবে উপকৃত হতে পারে?
দেলোয়ার হোসেন : পত্রিকাগুলোই তো বলছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ হচ্ছে ন্যাম সম্মেলনে। এ রকম বহু গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বসার একটা ভালো জায়গা বা উপলক্ষ হতে পারে ন্যাম সম্মেলন। এটা বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের একটা বিরাট মাধ্যম। শুধু ন্যাম নয়, যে কোনো সম্মেলনের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। ন্যাম জাতিসংঘের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্লাটফর্ম। ্বাংলাদেশ এর সঙ্গে যুক্ত থেকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক বাড়াতে পারে সহজেই।
সমকাল :তাহলে ন্যাম এখনও প্রাসঙ্গিক?
দেলোয়ার হোসেন : অবশ্যই ন্যাম প্রাসঙ্গিক। ন্যাম তো একটা প্লাটফর্ম। বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। যারা ন্যামের বিরোধিতা করেন তারাও কেন বিরোধিতা করেন ...
সমকাল : তাহলে ২০০১-এ ঢাকায় ন্যাম সম্মেলন বাতিল করা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইতিহাসে বিরাট ব্যর্থতা ...
দেলোয়ার হোসেন : বাংলাদেশের জন্য এটা আসলেই কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বাংলাদেশের শক্তির জায়গা আসলে কূটনীতি। ন্যাম সম্মেলন বাংলাদেশে হলে সবাই মিলেই এর অর্থায়নও করত, বাংলাদেশকে হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে হয়তো একটু বেশি করতে হতো। এর মাধ্যমে ন্যামে কথা বলার জন্যও আমাদের একটা শক্তিশালী অবস্থান থাকত। বিশ্ব রাজনীতিতে প্রত্যেকটা রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সে রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের, যোগাযোগের একটা বড় মাধ্যম হতে পারত।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
দেলোয়ার হোসেন : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
No comments