ভিভিএস লক্ষ্মণ অস্বীকৃত হিরোর বিদায় ঘিরে বিতর্ক by মোঃ এনামুল হাসান

ভিভিএস লক্ষ্মণ ভারতীয় ক্রিকেটের এমন এক নাম, ব্যাট হাতে বাইশগজী জমিনে ঝড় তোলা ছাড়া যার আর কোন ঝলকানি ছিল না। শচীনের মতো অগণিত বিজ্ঞাপনী ব্র্যান্ড, নিজের তারকাখ্যাতি বিক্রি করে অগাধ টাকা কামানোর ক্ষমতাও তাঁর ছিল না।


সৌরভ-দ্রাবিড় কিংবা শচীনের মতো দলকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগটাও হয়নি কখনই। তাই তো ক্যারিয়ারজুড়ে ব্যাট হাতে বিপদের ত্রাতা হয়েও মিডিয়ার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারেননি। ধোনি-রায়না-কোহলিদের প্রতিটা হাঁচি-কাশিও দেশটিতে যেভাবে জাতীয় গুরুত্বের সঙ্গে পরিবেশিত হয়, লক্ষ্মণের ভাগ্যে তার ছিটেফোঁটা জোটেনি। নিভৃতে কেবল দিয়েই গেছেন, বিনিময়ে চাননি কিছু। অথচ অসিদের মতো বুনোবাঘ, যারা হারতে খুব একটা পছন্দ করে না তাদের খাঁচায় ইন্ডিয়া টিমের সঙ্গে লক্ষ্মণকে ঢুকিয়ে দিয়ে বার বারই স্পষ্টত যে দৃশ্যটা দেখা গেছে তা হলো দলের রাঘব-বোয়াল ক্রিকেটারদের বড় বড় মাথা উপড়ে যাওয়ার পর, নিশ্চিত পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়েও লক্ষ্মণ অক্ষত দেহে ভারতের পতাকা হাতে বেরিয়ে এসেছেন। এমন বহু ম্যাচের উদাহরণ রয়েছে যেখানে এই হায়দরাবাদী প্রায় নিশ্চিত পরাজয়ের মুখ থেকে ভারতকে টেনে তুলেছেন। নিখুঁত ক্রিকেটীয় শিল্প আর ত্রুটিহীন টাইমিং নিয়ে লক্ষ্মণ এমন সব ম্যাচে ঝলসে উঠেছেন, যেখানে ‘পিচের নিচে প্রায়ই মাইন পোতা থাকে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় জঙ্গী বিমান’... ভারতের মৃত্যু নিশ্চিত!
এমন আনপ্যারালাল হিরোকেই কি-না বিদায় নিতে হলো মাঠের বাইরে থেকে। ঘরের মাঠে শেষ ম্যাচটি খেলতে মনটি তাঁর টলল না! লক্ষ্মণের আচমকা অবসরকে তাই বিস্ময়ের ঘোর লাগানিয়া বলেই মনে হয়। সঙ্গে ‘ধোনি বিতর্ক’ সেই বিস্ময়ের সলতেটাকে আরও উস্কে দেয়। সব চেপে মাঠের পেশাদারিত্বের মতো বিদায়ের ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘আমি ১৬ বছর ধরে ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলার সুযোগকে খুব ভাগ্যের মনে করি এবং আমি অনেক বেশি গর্বিত এ কারণে যে আমার অধিকাংশ সতীর্থ বিশ্বক্রিকেটের কিংবদন্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর তাঁরা দেশের জন্য যে গর্ব বয়ে এনেছেন সেটাও আমরা ভালবাসা, আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের মধ্যে একত্রে উদযাপন করেছি।’ বিদায়বেলায় যে সতীর্থদের প্রশংসা করেছেন তাঁরাও ভোলেননি লক্ষ্মণের কথা। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি অনেক বেশি অভাব বোধ করছেন লক্ষ্মণের। আর ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ ক্রিকেটার হিসেবে খ্যাত লক্ষ্মণের বিদায়ের পর ‘দ্য ওয়াল’খ্যাত দ্রাবিড়ের অভাবটা আরেকটু বেশিই মনে করছেন ধোনি। আর লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকর তো মনে করছেন লক্ষ্মণের অভাব পূরণ করতে ভারতকে অপেক্ষা করতে হবে আরও দশ বছর। সব মিলিয়ে ভারত প্রতিমুহূর্তেই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারবে হায়দারাবাদী এ ক্রিকেটারের অভাব। এ কারণে ভারতীয় ক্রিকেটে একজন ক্রিকেটার হিসেবে না থেকেও আসলে বিশাল একটা শূন্যতা নিয়ে থেকে যাচ্ছেন ৩৭ বছর বয়েসী এ ডানহাতি। তবে তাঁর অবসরকে বাঁকা চোখেও দেখছেন অনেকে আর অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাসও ফেলেছেন।
পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাক্সক্ষীদের সামনে অবসরের ঘোষণা দেন লক্ষ্মণ। ওই সময় তিনি বলেন, ‘ভারতের পক্ষে ১৬ বছর আগে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগমন করেছি। কিন্তু এখন সরে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি দেশের সাফল্য ধরে রাখার এবং এজন্য নিজের উচ্চাভিলাষকে প্রাধান্য দেইনি। কিন্তু আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে তরুণদের সুযোগ করে দেয়ার। দলে আমাকে যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে সেটা ধরে রেখে আমি প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছি তা সমুন্নত রাখার। কিন্তু অনেক সময়ই আমি মানুষকে হতাশ করেছি। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই সেটা আমার প্রচেষ্টার কোন ঘাটতির কারণে হয়নি।’ লক্ষ্মণের সতীর্থরা একেজন ভারতীয় ও বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তি। শচীন, দ্রাবিড়, বীরেন্দর শেবাগ, অনিল কুম্বলে প্রত্যেকেই বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ক্রিকেটার। এ কারণেই তাঁদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্টটাও বোধ করেছেন লক্ষ্মণ, ‘আমি আমার জীবনের অবিস্মরণীয় মুহূর্তগুলো কাটিয়েছি। যেসব অধিনায়কের অধীনে খেলেছি তাঁরা সবসময় আমাকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছেন এবং যে সতীর্থদের সঙ্গে খেলেছি তাঁরা আমাকে স্মরণীয় অনেক আনন্দময় মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন।’ লক্ষ্মণ অবসর নিয়ে নেয়ার পর আরেকটি বড় শূন্যতা সৃষ্টি হলো ভারতীয় দলে। লক্ষ্মণ ১৩৪ টেস্টে ১৭ সেঞ্চুরি ও ৫৬ হাফসেঞ্চুরিসহ ৪৫.৯৭ গড়ে ৮ হাজার ৭৮১ রান এবং ৮৬ ওয়ানডেতে ৩০.৭৬ গড়ে ৬ সেঞ্চুরি ও ১০ হাফসেঞ্চুরিসহ করেছেন ২৩৩৮ রান। এর আগে মার্চে দ্রাবিড় অবসর নেয়ার পর ওই শূন্যতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ভারতীয়রা। আর এবার আরেক ব্যাটিং স্তম্ভ লক্ষ্মণ চলে যাওয়ায় আরেকটি শূন্যস্থান তৈরি হলো। এ কারণেই অধিনায়ক ধোনি বলেন, ‘ভারতীয় দল লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের অনুপস্থিতি বোধ করবে। তবে আমি আশা করি তাঁদের জায়গায় যেসব তরুণ ক্রিকেটার সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরাও ভাল নৈপুণ্য দেখাতে পারবেন। এটা নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণের দারুণ সুযোগ তাঁদের জন্য।’ লক্ষ্মণের ক্রিকেট থেকে বিদায় নেয়ার ঘোষণাটা একেবারেই আকস্মিক। কারণ চলতি মৌসুমের জন্য নিজেকে ভালভাবেই প্রস্তুত করছিলেন তিনি। জাতীয় ক্রিকেট একাডেমীতে (এনসিএ) নিয়মিতই অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং সম্প্রতিই দুটি শতরান হাঁেিকয়েছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট স্কোয়াড থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়ে তিনি অবসরের ঘোষণা দিলেন। তবে তাঁকে সম্মানও জানিয়েছেন সবাই। তাঁর বিষয়ে দীর্ঘদিনের সতীর্থ শচীন বলেন, ‘দ্রাবিড়ের পর লক্ষ্মণও চলে গেলেন। এমন দু’জন ক্রিকেটার পেতে অন্তত ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।’ আর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) এক বার্তায় বলেছে, এখন থেকে আর বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি নয় এখন থেকে আমরা ভিভিএস ট্রফি নামে সিরিজ খেলতে চাই।

No comments

Powered by Blogger.