পরীক্ষা ছাড়াই পদোন্নতি! by আশরাফুল হক রাজীব

পদোন্নতির জন্য প্রশাসন ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তা পরীক্ষায় বসবেন না। তাঁদের দাবি, আগে যেভাবে পরীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বেলাও একইভাবে পদোন্নতি দিতে হবে। এখানে কোনো সংস্কার তাঁরা চান না। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট এসব জুনিয়র কর্মকর্তার কাছে নতিস্বীকার করে সরকার পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়ার সংস্কারকাজ থেকে সরে এসেছে।


তঅথচ পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির দাবি বেশির ভাগ কর্মকর্তার। সরকারের প্রায় সব সচিব এ বিষয়ে একমত থাকলেও পারছেন না জুনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য। তাঁদের চাপে এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে সরকার 'ধীরে চলো' নীতি নিয়েছে। এ বিষয়ে বিধিবিধান থাকলেও তা কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। পরীক্ষার সিলেবাস প্রণয়ন করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মকর্তা বাছাইয়ের জন্য পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসি। কিন্তু তা কার্যকর করা হয়নি।
শুধু পদোন্নতিতে নয়, পদে পদে বিধি লঙ্ঘন হচ্ছে জনপ্রশাসনে। পদোন্নতি থেকে শুরু করে পদায়ন, প্রেষণ, বদলি প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়মই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে উপসচিব ও তার ওপরের পদগুলোতে বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়তই। সর্বশেষ পদোন্নতির ক্ষেত্রেও জ্যেষ্ঠতার সাধারণ নীতিমালা মানা হয়নি। একই ব্যাচের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি না দিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তাকে উপসচিব করা হয়েছে। সব যোগ্যতা থাকার পাশাপাশি বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) কোনো নেতিবাচক মন্তব্য না থাকা সত্ত্বেও বাদ পড়েছেন অনেকে। এভাবে প্রশাসনের বিধি প্রণয়নকারী মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসনেই পদে পদে বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
তত্ত্বাবধায়ক সাবেক সরকারের উপদেষ্টা এবং সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এম হাফিজউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একটি ভালো প্রশাসন গড়ার জন্য মেধাবী কর্মকর্তার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সার্ভিসে মেধাবী কর্মকর্তা আছেন কিন্তু তাঁরা পদোন্নতি পান না। যাঁরা বিএনপি-আওয়ামী লীগ করেন তাঁরাই পদোন্নতি পান। রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে মেধাবী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার জন্য পরীক্ষায় বসানো যেতে পারে। কিন্তু কোনো সরকারই এটা করতে চায় না। কারণ তাদের সমর্থনপুষ্ট কর্মকর্তারা এটা চান না। জুনিয়র কর্মকর্তারা চান সমর্থনের বিনিময়ে নিশ্চিত পদোন্নতি। আর পদোন্নতির মতো পদায়ন, প্রেষণ, বদলিতেও রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। কাউকে পদায়ন করার সময় আগে দেখা হয় সে কোন দলের সমর্থক, পরে পদায়ন করা হয়। এখানে যোগ্যতা তার পথ হারিয়ে ফেলেছে।'
তত্ত্বাবধায়ক সাবেক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, প্রশাসন নষ্ট হয়েছে রাজনীতির কারণে। নষ্ট প্রশাসনে ভালো কিছু আশা করা উচিত নয়। প্রশাসন থেকে রাজনীতি দূর করতে না পারলে কোনো কিছুতেই কাজ হবে না।
জানা গেছে, উপসচিব এবং পরবর্তী পদে পদোন্নতির জন্য কর্মকর্তাদের পরীক্ষার বিধান রেখে সরকার সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া প্রকাশ করে। তা দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সিনিয়র সহকারী সচিব ও উপসচিবরা। বিশেষ করে প্রশাসন ব্যাচের সরকার সমর্থকরা। তাঁদের যুক্তি, 'এখন যাঁরা সচিব হয়েছেন তাঁরা কি পরীক্ষা দিয়ে হয়েছেন? তাহলে আমরা কেন পরীক্ষা দিয়ে হবো।' নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৩তম ব্যাচের একজন সিনিয়র সহকারী সচিব বলেন, 'রাজনীতি করে লাভ কী, যদি পদোন্নতিটাই নিশ্চিত না করতে পারি?'
প্রশাসনের এসব ডাকসাইটে কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়ায় সরকার পদোন্নতির জন্য পরীক্ষায় বসার আইন প্রণয়ন থেকে সরে এসেছে। সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ইকবাল মাহমুদ কর্মকর্তাদের পরীক্ষার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। কয়েক দিন পরই দেখা যায় তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ইআরডিতে বদলি হয়ে গেছেন। নতুন সচিব হিসেবে জনপ্রশাসনে যোগ দেন আবদুস সোবহান সিকদার। এরপর সিভিল সার্ভিস আইনের ধরনটাই পাল্টে ফেলা হয়। পদোন্নতির জন্য পরীক্ষায় বসার অংশটা বাদ দিয়ে খসড়া করা হয় সরকারি কর্মচারী আইনের। যা নিয়ে শুরুতেই আপত্তি তুলেছে প্রশাসন বাদে অন্য সব ক্যাডার।
আবদুস সোবহান সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকারি কর্মচারী আইনের কাজ চলছে। বিভিন্ন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। পদায়ন, বদলি বা প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধিভঙ্গের কোনো ঘটনা নেই। আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে এসব বিষয়ে কাজ করি। কাউকে কোনো পদে পদায়ন করার আগে তাঁর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়।'
জানা গেছে, সরকারের উপসচিব থেকে ওপরের পদগুলো নির্দিষ্ট কোনো ক্যাডারের পদ না হলেও বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার এসব পদ পুরোমাত্রায় দখল করে নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের উচ্চ স্তরের এ পদগুলো এখন প্রশাসন ক্যাডারের পদ হিসেবে ধরা হয়। অথচ সিভিল সার্ভিস ক্যাডার কম্পোজিশন ও ক্যাডার রুল, ১৯৮০ অনুযায়ী বিসিএস প্রশাসনসহ ২৮টি ক্যাডারের জন্য আলাদা পদ স্তর রয়েছে। এসব পদ প্রতিটি ক্যাডারের তফসিলে সুনির্দিষ্ট করা রয়েছে। এ পদগুলো বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের লাইন পদ। সব ক্যাডারেই সরকারের উপসচিব ও ঊর্ধ্বের সমমর্যাদার লাইন পদ রয়েছে। অন্যসব ক্যাডারের ক্ষেত্রে এসব পদে পদোন্নতির পর কোনো কর্মকর্তাকে সরকারের উপসচিব বা ঊর্ধ্বের পদগুলোতে পদায়ন করা হয় না। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষেত্রে এ নিয়মের কোনো বালাই নেই। ১৯৯২ সালে প্রশাসন ক্যাডার ও সাবেক সচিবালয় ক্যাডার একীভূত হওয়ার পর বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের জন্য নতুন একটি তফসিল জারি করা হয়। এ প্রজ্ঞাপনেও সরকারের উপসচিব ও ঊর্ধ্বের পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের লাইন পদ হিসেবে দেখানো হয়নি। অথচ প্রশাসন ক্যাডারের সব কর্মকর্তাকেই পর্যায়ক্রমে উপসচিব ও ঊর্ধ্বের পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
উপসচিব ও তার উপরের পদগুলোতে পদোন্নতি দিয়ে তারপর লাইন পদে পদায়ন করা হচ্ছে। সিভিল সার্ভিস রুল অনুযায়ী এভাবে পদায়ন করা অনিয়ম। অন্যান্য ক্যাডার থেকে উপসচিব বা ঊর্ধ্বের পদে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের ওই সব পদে পদায়ন করা হয় না। কিন্তু বর্তমানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, প্রশাসন ক্যাডারের বেলায় লাইন পদের পঞ্চম গ্রেড ও তার উপরের স্তরে পদায়ন করতে আগে উপসচিব ও তার উপরের পদে নিয়োগ দিতে হবে। এভাবে অনিয়মের মাধ্যমে সচিবালয়ের উপসচিব ও ঊর্ধ্বের পদগুলো বর্তমানে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আন্তক্যাডার বৈষম্য।
এ অনিয়ম বন্ধ করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জনপ্রশাসনের উপসচিব ও ঊর্ধ্বের পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। সিভিল সার্ভিস গঠনকালে উপসচিব ও ঊর্ধ্বের পদগুলোকে পুল পদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পুল পদে নিয়োগের জন্য সব ক্যাডারের মেধাবী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য ১৯৭৯ সালে জারি করা হয় 'সিনিয়র পুল সার্ভিস পুল এক্সামিনেশন রুল'। কিন্তু তা কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। পরীক্ষার সিলেবাস প্রণয়ন করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মকর্তা বাছাইয়ের জন্য পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসি। কিন্তু তা কার্যকর করা হয়নি।
উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে জনপ্রশাসনে মেধাবী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ফলে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে বিসিএস সমন্বয় পরিষদ। নব্বইয়ের দশকে সমন্বয় পরিষদ প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও কৃষি এ তিনটি পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলে। দাবি তোলা হয়, পেশাভিত্তিক জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠার। এখনো এ দাবির প্রতি অনড় রয়েছে এসব সংগঠন।
সমন্বয় কমিটির সভাপতি কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, জনপ্রশাসনে মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষপাতিত্ব নয় বা কারো প্রতি বিরাগের বিষয় নয়। এটি দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। যাঁরা দেশ পরিচালনা করছেন, বিষয়টি তাঁদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হলে উপসচিব পদে বিশেষ কোনো ক্যাডার শতভাগ অর্জন করলেও কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু যে প্রশাসন ক্যাডার মেধাবী বলে দাবি করে তারাই তো এ ব্যবস্থার আওতায় আসতে চায় না। আর এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য, কোটা অবশ্যই মেধাবীকে বঞ্চিত করে।
কর ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ছাড়া অন্যান্য পদে পদোন্নতির বিষয়টি পুরোটাই অস্বচ্ছ। অন্যান্য ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেড ও চতুর্থ গ্রেডের পদোন্নতি বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির মাধ্যমে হলেও প্রশাসন ক্যাডারে তা করা হচ্ছে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড বা এসএসবির মাধ্যমে। এ বোর্ডেই সরকারের উপসচিব ও ঊর্ধ্বের পদগুলোর পদোন্নতি দেওয়া হয়। এসএসবিতে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার সময় প্রশাসন ক্যাডারের লাইনপদে পদোন্নতি দেওয়ার নামে মূলত সব কর্মকর্তাকেই উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কারণ যেসব কর্মকর্তাকে প্রশাসন ক্যাডারের লাইন পদের বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে পরবর্তীতে তাঁদেরই আবার বদলি করা হচ্ছে সরকারের উপসচিব পদে। এভাবে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে যে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা লাইন পদের বিপরীতে পদোন্নতি নিয়ে যে পদেই পোস্টিং পান না কেন কোনোভাবেই সচিবালয়ের উপসচিব বা সমমর্যাদার পদে পোস্টিং পান না। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বেলায় এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে সচিবালয়ের সব পদই প্রশাসন ক্যাডারের পদ। অথচ জেলা পর্যায়ে ডেপুটি কমিশনার বা ডিসি এবং বিভাগীয় পর্যায়ে কমিশনার পদ বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত পদ। প্রশাসন ক্যাডারে সদস্য হিসেবে ডিসি পদে উপসচিব এবং কমিশনার পদে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়। আবার এ কর্মকর্তাকে বদলি করে এনে সরকারের উপসচিব ও অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত পদে পদায়ন করা হচ্ছে অথবা যুগ্ম সচিব এবং সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এটি শুধু ক্যাডার আইনের লঙ্ঘন নয়, সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতির বিধিমালারও লঙ্ঘন।

No comments

Powered by Blogger.