সংবাদ বিশ্লেষণ- উৎসাহ পেল হলমার্ক by শওকত হোসেন

অর্থমন্ত্রী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশ্বের ব্যাংকিং ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা এতে বিস্মিত হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কী করতে পারবে আর কী পারবে না, তা সুস্পষ্টভাবে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-তে উল্লেখ আছে।


তবাংলাদেশ ব্যাংক ওই আইন অনুযায়ী গত সোমবার সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের অনুরোধ করে অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায় পর্ষদের ওপর বর্তায় উল্লেখ করে সেই প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ওই পর্ষদ পুনর্গঠন করার কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন।
এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি পাঠানোর পরপরই একটি মহল সক্রিয় হয়ে ওঠে। সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলাম উপস্থিত হন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। বৈঠক হয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীও এ সময় সেখানে ছিলেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরাও বাইরে থেকে যোগাযোগ করা শুরু করে। অর্থমন্ত্রীকে নানা মহল থেকে বোঝানো হয় যে, এভাবে চিঠি লেখার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই।
অথচ, বাংলাদেশ ব্যাংক গত সোমবারের চিঠিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে যে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬(৬) ধারা অনুযায়ী প্রতিবেদনটি বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। এই ধারায় বলা আছে, ‘সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত কোনো চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর আচরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নিকট কোন প্রতিবেদন পেশ করিলে সরকার উহা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করিবে।’
অথচ চিঠি পাঠানোর এক দিন পর খোদ অর্থমন্ত্রীই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্ব কমিয়ে দিলেন। গতকাল মঙ্গলবার একটি অনুষ্ঠানে আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এটা তাদের দায়িত্ব নয়।’ এই বক্তব্যের ফলে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মর্যাদা যেমন কমল, তেমনি উৎসাহ পেল হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরা। এর ফলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো যা ইচ্ছা তাই করার একধরনের বার্তা পেয়ে গেল।
সোনালী ব্যাংকের মাত্র একটি শাখা থেকেই অখ্যাত হলমার্ক গ্রুপসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। বেসরকারি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোনো বেসরকারি ব্যাংকে এ ধরনের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলে সেই ব্যাংক চালানো কঠিন হয়ে পড়ত। এর চেয়ে অনেক কম অর্থ আত্মসাতের কারণে বন্ধ হয়ে যায় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। কিন্তু বড় মূলধন ভিত্তি এবং আমানতের পরিমাণ অনেক বেশি বলে সোনালী ব্যাংকের ওপর বড় ধরনের সংকট পড়বে না। তবে এ ঘটনা সমগ্র ব্যাংকিং খাতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বলে তিনি জানান।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। তিনিও মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক গ্রুপ যা করেছে, তাতে এর কোনো ক্ষমা নেই। এর সবচেয়ে বড় দায় সোনালী ব্যাংকের। তবে দেরিতে হলেও তাদের সম্ভবত বোধোদয় হয়েছে। তারাও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবহেলা বাংলাদেশ ব্যাংকেরও আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতেও কমতি আছে। তা না থাকলে হলমার্ক বা ডেসটিনির মতো ঘটনা ঘটত না। সুতরাং তারাও দায় এড়াতে পারে না।
ড. ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, কথা উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠি নিয়ে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫, ৪৬ ও ৪৭ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। সেই ক্ষমতা তার আছে। তবে চিরাচরিতভাবে যেটি চলে আসছে সেটি হলো, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের মালিক সরকার, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে কর্তৃত্ব করে না। সুতরাং আইনে থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পর্ষদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় না।
ড. ফরাসউদ্দিন সবশেষে বলেন, চিঠি দেওয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আছে। তবে সরকার এ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সব দায়িত্ব এখন সরকারের ওপর চলে এল। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এখন সরকারকেই নিতে হবে। ব্যবস্থা না নেওয়াটা ঠিক হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গতকাল প্রথম আলোকে এ নিয়ে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আইন মেনেই প্রতিবেদন দিয়েছে। আইনের বাইরে কিছু হয়নি, বরং বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এ ধরনের পদক্ষেপ না নিত, তাহলে উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ তোলা হতো।
এদিকে, ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে কেবল ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পর্ষদ অবশ্যই এর দায় এড়াতে পারে না। এখানে উল্লেখ করা যায়, ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক-পরিস্থিতি ও পর্ষদের ভূমিকা নিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে পর্ষদ পরিবর্তনের সুপারিশ করে গভর্নর লিখেছিলেন, ‘ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন, বদলি ও পদোন্নতি ইত্যাদিতে পর্ষদ সদস্যরা সরাসরি হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তার করছে।’ সে সময়েও এই চিঠি আমলে নেওয়া হয়নি, বরং পর্ষদ সদস্যদের ডেকে এনে বৈঠক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেই বৈঠকে একাধিক পর্ষদ সদস্য অর্থমন্ত্রীর সামনে গভর্নরের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। এভাবে সে সময়ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল। অথচ সে সময়ে গভর্নরের চিঠি আমলে নেওয়া হলে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা এড়ানো যেত বলে ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। দুবার তিনি ব্যাংক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে বলেই আমি মনে করি। সোনালী ব্যাংকে অনিয়মের যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি সত্য হলে টাকার বিচারে তা নজিরবিহীন এবং অকল্পনীয় মাত্রার দুর্নীতি ঘটেছে। বিষয়টিকে নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে। আবার সোনালী ব্যাংকের পর্ষদের থেকেও অন্তত নৈতিক দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়টি আছে।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আইনে যা-ই থাকুক, ব্যাংক খাতের সর্বোচ্চ নীতিনিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এ ক্ষেত্রে নজরদারির দায়িত্ব মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর বর্তায়। এটা ঠিক, বেসরকারি খাতের ব্যাংকের পর্ষদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা আছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা নেই। এ খাতের বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে এটাই বড় ধরনের অসংগতি। অতীতে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই অসংগতি দূর করার সুপারিশ একাধিকবার করা হয়েছে, যাতে বেসরকারি ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক একইভাবে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। ব্যাংকিং খাতে অনেক সংস্কারের বাস্তবায়ন হলেও এই সুপারিশটি কোনো সরকারই গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়নি।
অধ্যাপক মাহমুদ আরও বলেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে এটা একটি বাধা হিসেবে থেকে গেছে। তবে বিদ্যমান আইনি কাঠামোতেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে পুরো ব্যাংকিং খাতের ওপর নজরদারি করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকেরই। এত বড় অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে মতামত দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আইন যা-ই থাকুক, এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, রাষ্ট্রমালিকানাধীন অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে পুরো ব্যাংক খাত বিপদগ্রস্ত হতে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। তবে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই পর্ষদ ভেঙে দিতে পারে।’
সরকার কেন এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ারের প্রশ্ন তুলে ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে, তাঁর কাছে বোধগম্য নয় বলে জানান সাবেক গভর্নর। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ মেনে নিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অন্ততপক্ষে কালক্ষেপণ না করা। কালক্ষেপণ বা দীর্ঘসূত্রতা অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা বলেও তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.