ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর একটি উক্তি by ড. মাহবুব উল্লাহ্
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মিথ্যা ঘটনা ছিল না : ডেপুটি স্পিকার’ শিরোনামে আমাদের সময় পত্রিকায় ১৩ মার্চ ২০১০ একটি সংবাদ গুরুত্ব সহকারে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদদাতা নুরুল ইসলামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী বলেছেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র কোনো মিথ্যা ঘটনা ছিল না।
আমরা চেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করতে। একথা উল্লেখ করে তিনি এ সত্য ঘটনা দেশবাসীকে অবহিত করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। খবর বাসস’। প্রতিবেদক সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসকে উদ্ধৃত করেছেন। সুতরাং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বক্তব্য সরকারি সংবাদ সংস্থা বিকৃতভাবে পরিবেশন করেনি বলেই আমরা ধরে নেব। যা হোক, শেষ পর্যন্ত দেশবাসী ডেপুটি স্পিকার জনাব শওকত আলীর বরাতে জানতে পারল আগরতলা ষড়যন্ত্র বলে একটা ঘটনা ছিল। শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা ও নিষ্পেষণের মুখে সমাজের কোনো অগ্রবর্তী অংশ যদি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করার চিন্তা করে থাকে তাহলে তাতে দোষের কিছু থাকতে পারে না। বরং গৌরবের অনেক কিছু আছে। কিন্তু খটকা লাগে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ কথাটি নিয়ে। উল্লেখ্য, ডেপুটি স্পিকার জনাব শওকত আলী যিনি কর্নেল (অব.) শওকত আলী হিসেবে সমধিক পরিচিত তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২৬ নম্বরে অভিযুক্ত ছিলেন। অভিযুক্তের তালিকায় তার পরিচয় দেয়া হয়েছে পিটিসি-৫৭২৭ ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী মিয়া, পিতা মুন্সি মুবারক আলী, গ্রাম-চকর্বা, থানা-নরিয়া, জেলা-ফরিদপুর। এই মামলার ১ নম্বর অভিযুক্ত ছিলেন মি. শেখ মুজিবুর রহমান, পিতা মৌ. শেখ লুত্ফর রহমান, গ্রাম-টুঙ্গিপাড়া, থানা-গোপালগঞ্জ, জেলা-ফরিদপুর। মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ৩৫ জন। (সূত্র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র, সাহিদা বেগম, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০০)। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সরকারী ভাষ্য দীর্ঘ। সম্পূর্ণ ভাষ্যটি দৈনিক পত্রিকার কলামে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তবে কৌতূহলী পাঠক সাহিদা বেগম সম্পাদিত এবং বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত উপর্যুক্ত গ্রন্থটি পড়ে নিতে পারেন। আমি সরকারি ভাষ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রথম অংশ পাঠকের সুবিধার্থে উদ্ধৃত করছি। এর শিরোনামে বলা আছে, ‘১৯৬৮ সালের ফৌজদারি আইন (সংশোধনী) বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অর্ডিন্যান্সের ৪ ধারা অনুযায়ী ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিলের বিজ্ঞপ্তি নং এসআরও ৫ (আর) ৬৮ বলে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আসামি।’ ভাষ্যে বলা হয়, ‘১৯৬৮ সালের সংশোধিত ফৌজদারি আইন অধ্যাদেশের ইউ/এস-৫ ধারা মতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই মামলার ভাষ্য আদালতে উপস্থাপন করা হলো। যথাযথ সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করা যাচ্ছে যে : ১. গোপন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের অনুসরণে এমন একটি ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন করা হয়, যার মাধ্যমে ভারত কর্তৃক প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও অর্থ ব্যবহার করে পাকিস্তানের একাংশে সামরিক বিদ্রোহের দ্বারা ভারতের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি স্বাধীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কতিপয় ব্যক্তিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় এবং কতিপয় ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চাকরির সঙ্গে সম্পৃক্ত আইনের আওতায় গ্রেফতার করা হয়। ২. ঐ সকল ব্যক্তির কয়েকজনের নিকট থেকে উদ্ধারকৃত তথ্যপ্রমাণাদিতে দেখা যায় যে, তারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এবং কিছু নির্দিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের ছদ্মনাম ব্যবহার করছে এবং একটি ‘ডি ডে’তে করণীয় কার্যাদি সম্পর্কে ও অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা অনুরূপ ছদ্ম শব্দাবলী ব্যবহার করছে। ৩. তাদের প্রধান কর্মপরিকল্পনা ছিল সামরিক ইউনিটগুলোর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে তাদের অচল করে দেয়া। কমান্ডো স্টাইলে অভিযান চালিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে তারা অগ্রসর হয় : ক. সামরিক বাহিনী থেকে আসা লোকদের এবং প্রাক্তন সৈনিক ও বেসামরিক চাকরিজীবীদের দলভুক্ত করা, যাদের দ্বারা সশস্ত্র সংগ্রামের অগ্রগামী দল গঠন করা যায়। খ. ভারত থেকে প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়াও স্থানীয় উত্সসমূহ থেকে প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিরাপদে রাখা। গ. মিথ্যা প্রচারণার সাহায্যে সর্বসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক আনুগত্যহীনতা সৃষ্টি করা এবং ঘ. জোরপূর্বক সামরিক কৌশলগত স্থানসমূহ দখল করার উদ্দেশ্যে ‘ডি ডে’র মতো একটি সুযোগের মুহূর্ত নির্ধারণ করা। ৪. এই ষড়যন্ত্র কার্যকর করার জন্য একটি সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় পাকিস্তানের যারা ওই অভিযান কার্যকর করার দায়িত্বে ছিলেন তাদের প্রতিনিধিরা এবং ভারতীয় পক্ষের যারা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এ ষড়যন্ত্রকে সহায়তা করার উদ্যোগ নিয়েছিল তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই ভারতের আগরতলায় এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।’ সরকারি ভাষ্যটি বেশ দীর্ঘ। সুতরাং এটি পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা গেল না।
ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী মনে হয় তিনি পাকিস্তান সরকারের ভাষ্যটি সত্য বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন। সত্য সত্যই। সত্য স্বীকারে কোনো গ্লানি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রায় ৪৩ বছর পরে কেন? এ কারণে কি জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হবে না? আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি। ১৯৬২ সালে যখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল তখন থেকেই আমি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম। তখন আমি ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলাম। শুধু আমি কেন, আমার মতো অনেক তরুণই স্বাধীনতার কথা ভাবত। আমাদের কাছে এটাও স্পষ্ট ছিল যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করা সম্ভব হবে না। কাজটা যে বেশ দুরূহ এবং বিশাল ত্যাগ ও রক্ত না দিয়ে এ যে অর্জন সম্ভব নয়, সেই বিষয়টিও আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল।
এই রাজনৈতিক সচেতনতাকে পুঁজি করেই একদিন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৬৭-র ডিসেম্বরে আমি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তত্কালীন সরকারের কোপানলেও পড়তে হয়েছিল। এমনি এক সময়ে শুরু হলো ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান। দেশ কাঁপানো সেই অভ্যুত্থানে আইয়ুবশাহীর পতন ঘটল। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচিকে ভিত্তি করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচির ১১তম দফাটি ছিল সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি। ১৯৬৭ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হওয়ার আগে কিছুসংখ্যক বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সামরিক হেফাজতে নেয়া হয়। আজকাল আমরা যাকে বলি রিমান্ডে নেয়া। সামরিক হেফাজতে এদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলে। নির্যাতনের খবর একান-ওকান ঘুরে রাজধানী ঢাকার জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের দু’চারজন সাহসী কর্মী লিফলেট আকারে নির্যাতনের কাহিনী চোরাগুপ্তা কায়দায় জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু প্রকাশ্য প্রতিবাদ করার সাহস কেউ পাচ্ছিল না। এ পর্যায়ে আমি আমার সংগঠনের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের কিছু জঙ্গিকর্মীকে একটি সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা করার প্রস্তাব দেই। আমাদের সমর্থন পেয়ে তারা সাহসী হয়ে ওঠে। তত্কালীন ইকবাল হলের (বর্তমান জহুরুল হক হল) ক্যাফেটেরিয়ার সামনে সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। সভাটি পনের-বিশ মিনিট চলার পর পুলিশ ও ইপিআর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে। আসন্ন আক্রমণের কথা ভেবে দ্রুত সমাবেশ শেষ করা হয় এবং যে যার মত নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের প্রতি প্রকাশ্যে সহানুভূতি জ্ঞাপনের এটিই ছিল প্রথম আয়োজন। এই আয়োজনকে ভিত্তি করেই ’৬৯-র জানুয়ারির প্রথম দিকে ১১ দফা কর্মসূচি গৃহীত হয়। এরই মধ্যে ১৯৬৮-র ডিসেম্বরে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ডাকে ঢাকায় হরতাল পালিত হয় এবং সারাদেশে গ্রামের হাটগুলোতে কৃষক সমিতির উদ্যোগে হাট-হরতাল পালিত হয়। অর্থাত্ অত্যাসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১১ দফার গণঅভ্যুত্থানের সময় লাখো জনতার মিছিলে মিছিলে স্লোগান উঠেছিল, মিথ্যা মামলা আগরতলা মানি না মানি না। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মঞ্চ থেকেও বহুবার এ স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে এবং পল্টনের জনসমুদ্র মানি না মানি না বলে আকাশ-পাতাল বিদীর্ণ করেছে। ১১ দফার আর্থ-সামাজিক দাবিগুলো সবিস্তারে ব্যাখ্যা না করলেও ছাত্রলীগের নেতারা বিশেষ করে তোফায়েল আহমদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ ষড়যন্ত্র মামলার সব আসামি মুক্তির দাবি করেছেন বারবার। জনাব তোফায়েল আহমদের একটি উক্তি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। উক্তিটি ছিল ‘এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র নয়, এটি হলো পিন্ডি ষড়যন্ত্র’।
এখন ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী সাহেবের কাছে প্রশ্ন, সেদিন যদি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বলতেন আগরতলা ষড়যন্ত্রের ঘটনা সত্য, তাহলে কি জনগণ আমাদের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ব্যক্ত করত? তারা কি পুষ্পমাল্যের মতো বুলেটকে বুকে ধারণ করে ১১ দফার জন্য অকাতরে জীবন দিত? সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই হয়তো তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠছিল। কিন্তু তখনও ভারতের সহযোগিতা গ্রহণের প্রশ্নটি প্রায় কল্পনাতীত ছিল। এমনকি এতে অনেকে আশঙ্কাও বোধ করত। কর্নেল (অব.) শওকত আলী সাহেব আগরতলা ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করে ইতিহাসের এক অজানা রহস্যঘেরা অধ্যায়ের উন্মোচন ঘটিয়েছেন—একথা যেমন সত্য, তেমনি প্রমাণিত হলো পাকিস্তানি শাসকরা যে অভিযোগ উত্থাপন করেছিল সেটিও সত্য বলে বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি স্বীকার করে নিলেন। মুক্তি সংগ্রামে সাফল্য অর্জনের প্রয়োজনে বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তবে সেই বৈদেশিক শক্তিকে অবশ্যই স্ট্যাটেজিক দৃষ্টিতে বন্ধু-ভাবাপন্ন হতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা সেরকম কিছু বলে কি?
উল্লেখ্য, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতিপর্বের প্রাকমুহূর্তে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা অভ্যুত্থান সফল হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে জনসভা করে বজ্রগম্ভীর নিনাদে উচ্চারণ করেছিলেন ‘আমরা ফরাসি বিপ্লবের মতো বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটানোর মতো শেখ মুজিবকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে আনব।’ মওলানা ভাসানীর সেই জলদগম্ভীর উচ্চারণের পর ঢাকা শহরে পাকিস্তানি শাসকদের বেশকিছু স্থাপনায় আগুন জ্বলেছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি হামিদুর রহমান কোনোক্রমে তার বাসভবন থেকে সরে পড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীর এরকম বলিষ্ঠ সমর্থন না থাকলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে আরও বিলম্ব হতে পারত। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক আদেশ বলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব অভিযুক্ত বন্দি দশা থেকে মুক্তি লাভ করেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো সেই মওলানা ভাসানীকেও আওয়ামী লীগ যথার্থ সম্মান দেয়নি। স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান গোলটেবিল বৈঠক শেষে ঢাকায় এসে মওলানা ভাসানীকে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে এটিও ইতিহাসের একটি সত্য যে, কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত্ করেছিলেন। তাদের দু’জনের রাজনৈতিক পথ ১৯৫৭ থেকেই পৃথক হয়ে গিয়েছিল।
যাই হোক, ইতিহাস নিয়ে এদেশে অনেক অর্থহীন বিতর্ক হয়। ইতিহাস বিকৃতির কথাও বারবার উচ্চারিত হয়। যারা ইতিহাস বিকৃতির কথা বলে তারা ইতিহাসকে বহুগুণে বিকৃত করে। আজ ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে হলেও প্রকৃত ইতিহাস উন্মোচিত হচ্ছে। কর্নেল (অব.) শওকত আলীর উক্তি তারই প্রাথমিক প্রতিফলন। কিন্তু রহস্যের পর্দার এই সামান্য অপসারণ আমাদের দৃষ্টিকে যতটুকু অবারিত করেছে তাতে ভবিষ্যতের ইতিহাস গবেষকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে অনেক কথাই ভাববেন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও কেন আমরা ভারতীয় আধিপত্যবাদের প্রভাব কাটিয়ে ওঠে আজও কেন একটি আত্মগর্বে বলীয়ান জাতিতে পরিণত হতে পারছি না তার কিঞ্চিত্ জবাব ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর উক্তি থেকে খুঁজে নিতে পারি বৈকি।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী মনে হয় তিনি পাকিস্তান সরকারের ভাষ্যটি সত্য বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন। সত্য সত্যই। সত্য স্বীকারে কোনো গ্লানি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রায় ৪৩ বছর পরে কেন? এ কারণে কি জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হবে না? আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি। ১৯৬২ সালে যখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল তখন থেকেই আমি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম। তখন আমি ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলাম। শুধু আমি কেন, আমার মতো অনেক তরুণই স্বাধীনতার কথা ভাবত। আমাদের কাছে এটাও স্পষ্ট ছিল যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করা সম্ভব হবে না। কাজটা যে বেশ দুরূহ এবং বিশাল ত্যাগ ও রক্ত না দিয়ে এ যে অর্জন সম্ভব নয়, সেই বিষয়টিও আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল।
এই রাজনৈতিক সচেতনতাকে পুঁজি করেই একদিন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৬৭-র ডিসেম্বরে আমি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তত্কালীন সরকারের কোপানলেও পড়তে হয়েছিল। এমনি এক সময়ে শুরু হলো ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান। দেশ কাঁপানো সেই অভ্যুত্থানে আইয়ুবশাহীর পতন ঘটল। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচিকে ভিত্তি করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচির ১১তম দফাটি ছিল সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি। ১৯৬৭ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হওয়ার আগে কিছুসংখ্যক বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সামরিক হেফাজতে নেয়া হয়। আজকাল আমরা যাকে বলি রিমান্ডে নেয়া। সামরিক হেফাজতে এদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলে। নির্যাতনের খবর একান-ওকান ঘুরে রাজধানী ঢাকার জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের দু’চারজন সাহসী কর্মী লিফলেট আকারে নির্যাতনের কাহিনী চোরাগুপ্তা কায়দায় জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু প্রকাশ্য প্রতিবাদ করার সাহস কেউ পাচ্ছিল না। এ পর্যায়ে আমি আমার সংগঠনের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের কিছু জঙ্গিকর্মীকে একটি সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা করার প্রস্তাব দেই। আমাদের সমর্থন পেয়ে তারা সাহসী হয়ে ওঠে। তত্কালীন ইকবাল হলের (বর্তমান জহুরুল হক হল) ক্যাফেটেরিয়ার সামনে সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। সভাটি পনের-বিশ মিনিট চলার পর পুলিশ ও ইপিআর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে। আসন্ন আক্রমণের কথা ভেবে দ্রুত সমাবেশ শেষ করা হয় এবং যে যার মত নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের প্রতি প্রকাশ্যে সহানুভূতি জ্ঞাপনের এটিই ছিল প্রথম আয়োজন। এই আয়োজনকে ভিত্তি করেই ’৬৯-র জানুয়ারির প্রথম দিকে ১১ দফা কর্মসূচি গৃহীত হয়। এরই মধ্যে ১৯৬৮-র ডিসেম্বরে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ডাকে ঢাকায় হরতাল পালিত হয় এবং সারাদেশে গ্রামের হাটগুলোতে কৃষক সমিতির উদ্যোগে হাট-হরতাল পালিত হয়। অর্থাত্ অত্যাসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১১ দফার গণঅভ্যুত্থানের সময় লাখো জনতার মিছিলে মিছিলে স্লোগান উঠেছিল, মিথ্যা মামলা আগরতলা মানি না মানি না। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মঞ্চ থেকেও বহুবার এ স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে এবং পল্টনের জনসমুদ্র মানি না মানি না বলে আকাশ-পাতাল বিদীর্ণ করেছে। ১১ দফার আর্থ-সামাজিক দাবিগুলো সবিস্তারে ব্যাখ্যা না করলেও ছাত্রলীগের নেতারা বিশেষ করে তোফায়েল আহমদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ ষড়যন্ত্র মামলার সব আসামি মুক্তির দাবি করেছেন বারবার। জনাব তোফায়েল আহমদের একটি উক্তি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। উক্তিটি ছিল ‘এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র নয়, এটি হলো পিন্ডি ষড়যন্ত্র’।
এখন ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী সাহেবের কাছে প্রশ্ন, সেদিন যদি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বলতেন আগরতলা ষড়যন্ত্রের ঘটনা সত্য, তাহলে কি জনগণ আমাদের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ব্যক্ত করত? তারা কি পুষ্পমাল্যের মতো বুলেটকে বুকে ধারণ করে ১১ দফার জন্য অকাতরে জীবন দিত? সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই হয়তো তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠছিল। কিন্তু তখনও ভারতের সহযোগিতা গ্রহণের প্রশ্নটি প্রায় কল্পনাতীত ছিল। এমনকি এতে অনেকে আশঙ্কাও বোধ করত। কর্নেল (অব.) শওকত আলী সাহেব আগরতলা ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করে ইতিহাসের এক অজানা রহস্যঘেরা অধ্যায়ের উন্মোচন ঘটিয়েছেন—একথা যেমন সত্য, তেমনি প্রমাণিত হলো পাকিস্তানি শাসকরা যে অভিযোগ উত্থাপন করেছিল সেটিও সত্য বলে বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি স্বীকার করে নিলেন। মুক্তি সংগ্রামে সাফল্য অর্জনের প্রয়োজনে বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তবে সেই বৈদেশিক শক্তিকে অবশ্যই স্ট্যাটেজিক দৃষ্টিতে বন্ধু-ভাবাপন্ন হতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা সেরকম কিছু বলে কি?
উল্লেখ্য, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতিপর্বের প্রাকমুহূর্তে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা অভ্যুত্থান সফল হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে জনসভা করে বজ্রগম্ভীর নিনাদে উচ্চারণ করেছিলেন ‘আমরা ফরাসি বিপ্লবের মতো বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটানোর মতো শেখ মুজিবকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে আনব।’ মওলানা ভাসানীর সেই জলদগম্ভীর উচ্চারণের পর ঢাকা শহরে পাকিস্তানি শাসকদের বেশকিছু স্থাপনায় আগুন জ্বলেছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি হামিদুর রহমান কোনোক্রমে তার বাসভবন থেকে সরে পড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীর এরকম বলিষ্ঠ সমর্থন না থাকলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে আরও বিলম্ব হতে পারত। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক আদেশ বলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব অভিযুক্ত বন্দি দশা থেকে মুক্তি লাভ করেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো সেই মওলানা ভাসানীকেও আওয়ামী লীগ যথার্থ সম্মান দেয়নি। স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান গোলটেবিল বৈঠক শেষে ঢাকায় এসে মওলানা ভাসানীকে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে এটিও ইতিহাসের একটি সত্য যে, কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত্ করেছিলেন। তাদের দু’জনের রাজনৈতিক পথ ১৯৫৭ থেকেই পৃথক হয়ে গিয়েছিল।
যাই হোক, ইতিহাস নিয়ে এদেশে অনেক অর্থহীন বিতর্ক হয়। ইতিহাস বিকৃতির কথাও বারবার উচ্চারিত হয়। যারা ইতিহাস বিকৃতির কথা বলে তারা ইতিহাসকে বহুগুণে বিকৃত করে। আজ ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে হলেও প্রকৃত ইতিহাস উন্মোচিত হচ্ছে। কর্নেল (অব.) শওকত আলীর উক্তি তারই প্রাথমিক প্রতিফলন। কিন্তু রহস্যের পর্দার এই সামান্য অপসারণ আমাদের দৃষ্টিকে যতটুকু অবারিত করেছে তাতে ভবিষ্যতের ইতিহাস গবেষকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে অনেক কথাই ভাববেন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও কেন আমরা ভারতীয় আধিপত্যবাদের প্রভাব কাটিয়ে ওঠে আজও কেন একটি আত্মগর্বে বলীয়ান জাতিতে পরিণত হতে পারছি না তার কিঞ্চিত্ জবাব ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর উক্তি থেকে খুঁজে নিতে পারি বৈকি।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments