রেলমন্ত্রীর এপিএসের গাড়ি হঠাৎ পিলখানায় by শরিফুল হাসান
একটি গাড়ি। তিনজন যাত্রী। একজন চালক। কয়েক লাখ টাকা। রাত প্রায় ১১টা। ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়ক থেকে ছুটে চলা। গন্তব্য কাছেই, জিগাতলা। পথে বিজিবির সদর দপ্তর, পিলখানা। হঠাৎ চালকের সেখানে ঢুকে পড়া। রাতভর ‘আটকে থাকা’। দিনভর আলোচনা, গল্প-ডালপালা। অতঃপর দুটি তদন্ত কমিটির ঘোষণা।
গাড়ির তিন যাত্রী হলেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা, তাঁর নিরাপত্তা কর্মকর্তা রেলওয়ের কমান্ড্যান্ট এনামুল হক ও রেলমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার। মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-চ ১৩-৭৯৯২) চালাচ্ছিলেন এপিএস ফারুকের ব্যক্তিগত চালক আজম খান। গন্তব্য—রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসা। বাকি সব ঠিক আছে, গোল বাধিয়েছে টাকা।
ঘটনা সম্পর্কে রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজম দুই বছর ধরে আমার গাড়ি চালায়। কিন্তু সোমবার রাতে সে আমাকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের চেষ্টা করে। মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় যাওয়ার পথে হঠাৎ করে গাড়িটি সে বিজিবি সদর দপ্তরে ঢুকিয়ে দেয় এবং চেঁচামেচি করে বলতে থাকে, গাড়িতে অনেক টাকা আছে। তাঁর হইচই শুনে বিজিবির সদস্য ও সেনাসদস্যরা সেখানে আসেন। তাঁরা আমাদের বিজিবির নিরাপত্তাকক্ষে নিয়ে বসিয়ে রাখেন। গতকাল সকালে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর আমাদের ছেড়ে দেন।’
রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন একটি ট্রেন চালু হবে। সেটি শায়েস্তাগঞ্জে থামবে কি থামবে না, সে বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় যাচ্ছিলাম। এর আগেও বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি মন্ত্রীর বাসায় গিয়েছি। সোমবার রাতে আমি ফারুক ভাইকে (মন্ত্রীর এপিএস) ফোন দিয়ে বলি, মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় যাব। ফারুক ভাই আমাকে ধানমন্ডিতে যেতে বলেন। সেখানে তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় যাই এবং ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে উঠি। মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় যাওয়ার পথে গাড়িচালক হঠাৎ করে পিলখানায় ঢুকে পড়ে। সে আমাদের সবার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।’
অপর যাত্রী এনামুল হক রেলওয়ের কমান্ড্যান্ট ও ইউসুফ আলী মৃধার নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘জিএম স্যার আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাঁর আদেশেই আমি কমলাপুর থেকে তাঁর সঙ্গে যাই। ধানমন্ডি থেকে গাড়ি নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের বাসার দিকে যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই আজম গাড়িটি পিলখানায় ঢুকিয়ে দেয়। আমরা তখন তাকে বলি, “তুমি কই যাচ্ছ?” সে বলে, “আপনারা সবাই গাড়ি থেকে নেমে যান। নইলে আমি সিনক্রিয়েট করব।” এর পরই সে হইচই শুরু করে দিলে বিজিবির সদস্যরা এগিয়ে আসে। এরপর সারা রাত আমাদের একটি কক্ষে বসিয়ে রাখে বিজিবির সদস্যরা। তবে তারা সবাই ভালো ব্যবহার করেছে।”’
গত রাত ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গাড়িচালক আজম বিজিবির হেফাজতে থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তবে ঘটনার রাতেই তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের কাছে দাবি করেছেন, গাড়িতে অনেক টাকা ছিল। গাড়ি নিয়ে পিলখানায় ঢুকে পড়লে ওমর ফারুক তাঁকে বলেন, ‘এখান থেকে তোমাকে ৩০ লাখ টাকা দিব, গাড়ি ঘুরিয়ে আমাদের বাইরে দিয়ে আসো।’
জানতে চাইলে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতের বেলা তিনজন লোক একটি গাড়িয়ে নিয়ে পিলখানায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় পিলখানার ভেতরে বসিয়ে রাখা হয়। সকালে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রেলভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি হয়েছে। জিএম ইউসুফ আলী মৃধার বিষয়ে তদন্ত করবেন রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) শশী কুমার সিং। ওমর ফারুক তালুকদারের বিষয়ে তদন্ত করবেন মন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) আখতারুজ্জামান। দুটি কমিটিকেই আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
টাকা, গন্তব্য এবং সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: চালক আজম হঠাৎ করে এমন ঘটনা কেন ঘটালেন, জানতে চাইলে মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক বলেন, ‘আজম ইদানীং মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। গাড়িতে আমার ব্যক্তিগত কিছু টাকা ছিল, ২৫ লাখ। আজম বিজিবিতে আমাদের নামিয়ে দিয়ে সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে আমাদের তিনজনের মোবাইলও ছিনিয়ে নিয়েছিল।’
এত রাতে মন্ত্রীর বাসায় কেন যাচ্ছিলেন জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলেন, ‘শায়েস্তাগঞ্জে নতুন রেলওয়ে নিয়ে কিছু সমস্যার বিষয়ে পরামর্শ নিতে রাতে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলাম।’ রাতে গাড়িতে এত টাকা নিয়ে বের হলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ব্যবসায়িক টাকা। গাড়িতেই ছিল।’ গাড়িতে নাকি ৭০ লাখ টাকা ছিল? ‘এটি ঠিক নয়, ২৫ লাখ টাকা’—দাবি এপিএস ফারুকের। মন্ত্রীর এই এপিএস জানান, গতকাল সকালেই তিনি ওই টাকা তাঁর ব্যাংক হিসাবে জমা করে দিয়েছেন।
টাকার বিষয়ে রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা বললেন, ‘গাড়িতে কী টাকা ছিল, কত টাকা ছিল, কিছুই আমি জানি না। ফারুক ভাই বলছেন, এগুলো তাঁর টাকা। আমি আর তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। চালক আজম ওই টাকা নিয়ে পালাতে চেয়েছিল।’
এনামুল হক বলেন, ‘টাকা কোথা থেকে এসেছে, আমি জানি না। আমি কোনো টাকা দেখিনি।’
সোমবার রাতে এটিএন নিউজকে টেলিফোনে দেওয়া বক্তব্যে গাড়িচালক আজম খান বলেন, ‘রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক গাড়িতে উঠে আমাকে বলে, “ধানমন্ডি ৩ নম্বরে যাও।” সেখানে যাওয়ার পর বলে, “গাড়ির সিটটা ভাঙো। একটা ব্যাগ উঠাও।” এরপর তিনজন লোক ওঠে। বলে, “জিগাতলার দিকে যাও।” আমি তখন বলি, “এত টাকা নিয়ে আমি গাড়ি চালাতে পারব না। অবৈধ টাকা। আমার ভয় লাগে।” এ সময় ওমর ফারুক বলেন, “কী বলো তুমি, উল্টাপাল্টা!” আমি এ সময় বিডিআরের (বিজিবি) ৪ নম্বর গেটের সামনে ছিলাম। আমি তখন গাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে দিই। তখন তারা আমাকে বলে, “তুমি ৩০ লাখ টাকা নিয়ে যাও। আমাদের বাইরে দিয়ে আসো।” তারা বলে, “৩০ লাখ টাকা! তোমার সারা জীবন আর কিছু করা লাগবে না।”’
টাকাসহ গাড়িটি সোমবার সারা রাত পিলখানায় ছিল। টাকার পরিমাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘টাকার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’
দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে প্রশ্ন করেছিলেন, শোনা যাচ্ছে, গাড়িতে নাকি ৭০ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এটা কি সরকারি টাকা? জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না।’ আপনার এপিএস ওমর ফারুকের কাছে এত টাকা কোথা থেকে এল জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘এটা তাঁর ব্যক্তিগত টাকা। ফারুককে “ব্ল্যাকমেইল ও হাইজ্যাক” করার জন্য গাড়িচালক বিজিবির সদর দপ্তরে ঢুকে পড়ে। গাড়িতে ওই সময় রেলওয়ের মহাপরিচালক (পূর্ব) ইউসুফ আলী মৃধাও ছিলেন।’
মন্ত্রী বলেন, ‘দেশীয় আইনে নিজের টাকা নিয়ে চলার অধিকার সবারই আছে। যদি তাদের আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ অর্থ পাওয়া যায়, এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) তা খতিয়ে দেখবে। এটা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়।’
কিছু অসংগতি: প্রথম আলো গাড়িচালক আজম ছাড়া এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছে। রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা বলেছেন, ‘সোমবার সকালে আমি ঢাকায় এসেছি। অফিশিয়াল একটি মিটিং ছিল। রাতে মন্ত্রীর বাসায় যাওয়ার সময় এনামুলকে সঙ্গে নিয়ে যাই।’
এপিএস ওমর ফারুক বলেছিলেন, ইউসুফ আলী মৃধা মন্ত্রীর বাসা চেনেন না। তাই তাঁকে তিনি সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে দাঁড়াতে বলেন এবং সেখান থেকে (ইউসুফ আলী) গাড়িতে তুলে নেন। আর ইউসুফ আলী বলেছেন, তিনি ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কে এক আত্মীয়ের বাসায় গেছেন। সেখান থেকে একসঙ্গে মন্ত্রীর বাসায় রওনা হন। তিনি এর আগেও মন্ত্রীর বাসায় গেছেন।
ইউসুফ আলী মৃধা ও ওমর ফারুক বলেছেন, গাড়িচালক আজম তাঁদের তিনজনেরই মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছেন। তবে এনামুল হক বলেছেন, মোবাইল ফোন তাঁর কাছেই ছিল।
টিভিতে দেওয়া গাড়িচালক আজমের বক্তব্যের সঙ্গে বাকিদের কারও বক্তব্যের মিল নেই। আজম বলছেন, গাড়িতে টাকা তোলা হয়েছে ৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি থেকে। আর ওমর একবার বলেছেন, এগুলো তাঁর টাকা। আবার বলেছেন, তাঁর এক আত্মীয় লন্ডন থেকে এসেছেন। তাঁর আনা পাউন্ড ভাঙিয়ে এই টাকা করা হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ইউসুফ আলী মৃধা ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্বাঞ্চলের (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট) মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। রেলওয়েতে বর্তমানে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের সাত হাজার পদে নিয়োগ চলছে। এর মধ্যে গত কয়েক মাসে সাড়ে তিন হাজার নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। ইউসুফ আলী পূর্বাঞ্চলের নিয়োগ কমিটির প্রধান। নিয়োগ নিয়ে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ আছে—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইউসুফ আলী বলেন, ‘একটা ঘটনা ঘটেছে। এখন লোকজন বানিয়ে বানিয়ে কত কথা বলবে।’
ঘটনা সম্পর্কে রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজম দুই বছর ধরে আমার গাড়ি চালায়। কিন্তু সোমবার রাতে সে আমাকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের চেষ্টা করে। মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় যাওয়ার পথে হঠাৎ করে গাড়িটি সে বিজিবি সদর দপ্তরে ঢুকিয়ে দেয় এবং চেঁচামেচি করে বলতে থাকে, গাড়িতে অনেক টাকা আছে। তাঁর হইচই শুনে বিজিবির সদস্য ও সেনাসদস্যরা সেখানে আসেন। তাঁরা আমাদের বিজিবির নিরাপত্তাকক্ষে নিয়ে বসিয়ে রাখেন। গতকাল সকালে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর আমাদের ছেড়ে দেন।’
রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন একটি ট্রেন চালু হবে। সেটি শায়েস্তাগঞ্জে থামবে কি থামবে না, সে বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় যাচ্ছিলাম। এর আগেও বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি মন্ত্রীর বাসায় গিয়েছি। সোমবার রাতে আমি ফারুক ভাইকে (মন্ত্রীর এপিএস) ফোন দিয়ে বলি, মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় যাব। ফারুক ভাই আমাকে ধানমন্ডিতে যেতে বলেন। সেখানে তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় যাই এবং ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে উঠি। মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায় যাওয়ার পথে গাড়িচালক হঠাৎ করে পিলখানায় ঢুকে পড়ে। সে আমাদের সবার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।’
অপর যাত্রী এনামুল হক রেলওয়ের কমান্ড্যান্ট ও ইউসুফ আলী মৃধার নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘জিএম স্যার আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাঁর আদেশেই আমি কমলাপুর থেকে তাঁর সঙ্গে যাই। ধানমন্ডি থেকে গাড়ি নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের বাসার দিকে যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই আজম গাড়িটি পিলখানায় ঢুকিয়ে দেয়। আমরা তখন তাকে বলি, “তুমি কই যাচ্ছ?” সে বলে, “আপনারা সবাই গাড়ি থেকে নেমে যান। নইলে আমি সিনক্রিয়েট করব।” এর পরই সে হইচই শুরু করে দিলে বিজিবির সদস্যরা এগিয়ে আসে। এরপর সারা রাত আমাদের একটি কক্ষে বসিয়ে রাখে বিজিবির সদস্যরা। তবে তারা সবাই ভালো ব্যবহার করেছে।”’
গত রাত ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গাড়িচালক আজম বিজিবির হেফাজতে থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তবে ঘটনার রাতেই তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের কাছে দাবি করেছেন, গাড়িতে অনেক টাকা ছিল। গাড়ি নিয়ে পিলখানায় ঢুকে পড়লে ওমর ফারুক তাঁকে বলেন, ‘এখান থেকে তোমাকে ৩০ লাখ টাকা দিব, গাড়ি ঘুরিয়ে আমাদের বাইরে দিয়ে আসো।’
জানতে চাইলে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতের বেলা তিনজন লোক একটি গাড়িয়ে নিয়ে পিলখানায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় পিলখানার ভেতরে বসিয়ে রাখা হয়। সকালে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রেলভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি হয়েছে। জিএম ইউসুফ আলী মৃধার বিষয়ে তদন্ত করবেন রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) শশী কুমার সিং। ওমর ফারুক তালুকদারের বিষয়ে তদন্ত করবেন মন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) আখতারুজ্জামান। দুটি কমিটিকেই আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
টাকা, গন্তব্য এবং সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: চালক আজম হঠাৎ করে এমন ঘটনা কেন ঘটালেন, জানতে চাইলে মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক বলেন, ‘আজম ইদানীং মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। গাড়িতে আমার ব্যক্তিগত কিছু টাকা ছিল, ২৫ লাখ। আজম বিজিবিতে আমাদের নামিয়ে দিয়ে সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে আমাদের তিনজনের মোবাইলও ছিনিয়ে নিয়েছিল।’
এত রাতে মন্ত্রীর বাসায় কেন যাচ্ছিলেন জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলেন, ‘শায়েস্তাগঞ্জে নতুন রেলওয়ে নিয়ে কিছু সমস্যার বিষয়ে পরামর্শ নিতে রাতে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলাম।’ রাতে গাড়িতে এত টাকা নিয়ে বের হলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ব্যবসায়িক টাকা। গাড়িতেই ছিল।’ গাড়িতে নাকি ৭০ লাখ টাকা ছিল? ‘এটি ঠিক নয়, ২৫ লাখ টাকা’—দাবি এপিএস ফারুকের। মন্ত্রীর এই এপিএস জানান, গতকাল সকালেই তিনি ওই টাকা তাঁর ব্যাংক হিসাবে জমা করে দিয়েছেন।
টাকার বিষয়ে রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা বললেন, ‘গাড়িতে কী টাকা ছিল, কত টাকা ছিল, কিছুই আমি জানি না। ফারুক ভাই বলছেন, এগুলো তাঁর টাকা। আমি আর তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। চালক আজম ওই টাকা নিয়ে পালাতে চেয়েছিল।’
এনামুল হক বলেন, ‘টাকা কোথা থেকে এসেছে, আমি জানি না। আমি কোনো টাকা দেখিনি।’
সোমবার রাতে এটিএন নিউজকে টেলিফোনে দেওয়া বক্তব্যে গাড়িচালক আজম খান বলেন, ‘রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক গাড়িতে উঠে আমাকে বলে, “ধানমন্ডি ৩ নম্বরে যাও।” সেখানে যাওয়ার পর বলে, “গাড়ির সিটটা ভাঙো। একটা ব্যাগ উঠাও।” এরপর তিনজন লোক ওঠে। বলে, “জিগাতলার দিকে যাও।” আমি তখন বলি, “এত টাকা নিয়ে আমি গাড়ি চালাতে পারব না। অবৈধ টাকা। আমার ভয় লাগে।” এ সময় ওমর ফারুক বলেন, “কী বলো তুমি, উল্টাপাল্টা!” আমি এ সময় বিডিআরের (বিজিবি) ৪ নম্বর গেটের সামনে ছিলাম। আমি তখন গাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে দিই। তখন তারা আমাকে বলে, “তুমি ৩০ লাখ টাকা নিয়ে যাও। আমাদের বাইরে দিয়ে আসো।” তারা বলে, “৩০ লাখ টাকা! তোমার সারা জীবন আর কিছু করা লাগবে না।”’
টাকাসহ গাড়িটি সোমবার সারা রাত পিলখানায় ছিল। টাকার পরিমাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘টাকার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’
দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে প্রশ্ন করেছিলেন, শোনা যাচ্ছে, গাড়িতে নাকি ৭০ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এটা কি সরকারি টাকা? জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না।’ আপনার এপিএস ওমর ফারুকের কাছে এত টাকা কোথা থেকে এল জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘এটা তাঁর ব্যক্তিগত টাকা। ফারুককে “ব্ল্যাকমেইল ও হাইজ্যাক” করার জন্য গাড়িচালক বিজিবির সদর দপ্তরে ঢুকে পড়ে। গাড়িতে ওই সময় রেলওয়ের মহাপরিচালক (পূর্ব) ইউসুফ আলী মৃধাও ছিলেন।’
মন্ত্রী বলেন, ‘দেশীয় আইনে নিজের টাকা নিয়ে চলার অধিকার সবারই আছে। যদি তাদের আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ অর্থ পাওয়া যায়, এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) তা খতিয়ে দেখবে। এটা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়।’
কিছু অসংগতি: প্রথম আলো গাড়িচালক আজম ছাড়া এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছে। রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা বলেছেন, ‘সোমবার সকালে আমি ঢাকায় এসেছি। অফিশিয়াল একটি মিটিং ছিল। রাতে মন্ত্রীর বাসায় যাওয়ার সময় এনামুলকে সঙ্গে নিয়ে যাই।’
এপিএস ওমর ফারুক বলেছিলেন, ইউসুফ আলী মৃধা মন্ত্রীর বাসা চেনেন না। তাই তাঁকে তিনি সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে দাঁড়াতে বলেন এবং সেখান থেকে (ইউসুফ আলী) গাড়িতে তুলে নেন। আর ইউসুফ আলী বলেছেন, তিনি ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কে এক আত্মীয়ের বাসায় গেছেন। সেখান থেকে একসঙ্গে মন্ত্রীর বাসায় রওনা হন। তিনি এর আগেও মন্ত্রীর বাসায় গেছেন।
ইউসুফ আলী মৃধা ও ওমর ফারুক বলেছেন, গাড়িচালক আজম তাঁদের তিনজনেরই মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছেন। তবে এনামুল হক বলেছেন, মোবাইল ফোন তাঁর কাছেই ছিল।
টিভিতে দেওয়া গাড়িচালক আজমের বক্তব্যের সঙ্গে বাকিদের কারও বক্তব্যের মিল নেই। আজম বলছেন, গাড়িতে টাকা তোলা হয়েছে ৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি থেকে। আর ওমর একবার বলেছেন, এগুলো তাঁর টাকা। আবার বলেছেন, তাঁর এক আত্মীয় লন্ডন থেকে এসেছেন। তাঁর আনা পাউন্ড ভাঙিয়ে এই টাকা করা হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ইউসুফ আলী মৃধা ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্বাঞ্চলের (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট) মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। রেলওয়েতে বর্তমানে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের সাত হাজার পদে নিয়োগ চলছে। এর মধ্যে গত কয়েক মাসে সাড়ে তিন হাজার নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। ইউসুফ আলী পূর্বাঞ্চলের নিয়োগ কমিটির প্রধান। নিয়োগ নিয়ে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ আছে—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইউসুফ আলী বলেন, ‘একটা ঘটনা ঘটেছে। এখন লোকজন বানিয়ে বানিয়ে কত কথা বলবে।’
No comments