এ খেলার শেষ কোথায় by লুৎফর রহমান রনো

তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির নিকৃষ্টতম বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার লক্ষ্যে প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের খুন, গুম করা ও নির্যাতন জারি রাখা। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এ দেশে প্রায় প্রতিবাদহীন তুঘলকি তাণ্ডব চলেছে।


জিয়াউর রহমানের শাসনামলে খুন-গুম হয়েছেন শত শত আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলের নেতা-কর্মী। আর ব্যর্থ অভ্যুত্থান সংঘটনের সঙ্গে জড়িত বলে হাজার হাজার সেনাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় বিনা বিচারে। অন্ধকারে নিঃশব্দে নিশ্চিহ্ন হয়েছে কত জীবন, যাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এরশাদের শাসনামলেও প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন, খুন হয়েছে। বিশেষ করে 'ছাত্রসমাজের' ক্যাডাররা শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাসের স্বর্গ করে তুলেছিল। এরশাদ প্রশাসনের ক্ষমতাসীন মুষ্টিমেয় লোক মত্ত হয়ে উঠেছিল দেশের সম্পদ লুটপাটে। যাকে বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তখন বলেছিলেন 'মার্কোস সিন্ড্রোম' বলে। (দৈনিক ইত্তেফাক ৪ জানুয়ারি ১৯৮২)। অর্থাৎ ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক মার্কোসের সঙ্গে তুলনীয়। বিদেশে এরশাদের পরিচয় ছিল, 'রিটেস্ট প্রেসিডেন্ট অব দ্য
পুওরেস্ট কান্ট্রি'।
এরশাদের স্বৈরশাসনের সমালোচনা করলে ডিজিএফআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদ সেলে নিয়ে ইলেকট্রিক শকসহ নানা রকম নির্যাতন করা ছিল নিয়মিত ঘটনা। এমনকি ষাটের কাছাকাছি বয়সের গোলাম মাজেদ- যশোর প্রেসক্লাবের সভাপতি, দৈনিক রানার পত্রিকার সম্পাদক, তাঁকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
কিন্তু ২০১২ সালের বাংলাদেশে মানুষের জীবন নিয়ে রাজনীতির মহোৎসব চলতে পারে না। সরকারি দল, সরকার, বিরোধী দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এসব দলের অন্তঃকোন্দল কিংবা রাজনৈতিক 'ফায়দা'র কারণে গুম, হত্যা, হরতাল অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাবে নিরীহ ড্রাইভার- আর এই নির্মম খেলার নীরব দর্শক হয়ে থাকবে ১৬ কোটি মানুষ! সাধারণ মানুষ বা 'জনগণ' নানারূপ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খল ও 'শৃঙ্খলার' কারণে নিরুচ্চার বা নীরব থাকে। এই নীরবতাকে সরকার বা বিরোধী দলগুলো যদি মনে করে তাদের রাজনৈতিক চমৎকারিত্বের ফল, তাহলে মারাত্মক ভুল হবে। বরং যত জলদি তারা জনগণের এমন নীরবতাকে আসন্ন বিপদ বলে ভাববেন, ততই মঙ্গল। ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া ও পরবর্তী সাত দিনের বিভিন্ন মহলের বিবৃতি ও ঘটনাবলি ও তিন দিনের হরতাল সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কোনো পক্ষই নিখোঁজ হওয়া মানুষটি নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাচ্ছে না। অপ্রত্যাশিত এ দুর্ঘটনাটাকে কে কিভাবে ব্যবহার করবে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে সেই ভাবনায় অস্থির। সরকারের কোনো সংস্থা (আইনশৃঙ্খলাকারী) খুঁজে পেল না কোনো সূত্র। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রথম দিকে বলেছিলেন, তাঁর স্বামী কখনো আগে তাঁর কোনো বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ করেননি। অথচ ২৪ তারিখ সাংবাদিকদের কাছে বললেন, ইলিয়াস আলী নাকি একবার বলেছিলেন, গোয়েন্দাদের তালিকায় তাঁর নাম আছে। যেকোনো সময় তাঁর বিপদ হতে পারে। এ কথার অর্থ দাঁড়ায় আরো অনেকেই এ তালিকায় রয়েছেন যাঁদের গুম করার দায়িত্ব নিয়েছে গোয়েন্দা বাহিনী। সরকার এ অবস্থায় কী ভাবছে? বিএনপির এখন একমাত্র লক্ষ্য আগামী নির্বাচন, ক্ষমতা পুনরুদ্ধার...। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের লক্ষ্য কী হতে পারে- একাধিক উদ্দেশ্য সাধিত হবে এই নিখোঁজ-দুর্ঘটনা থেকে। এসব তো বাংলাদেশের রাজনীতির প্রাথমিক কথাবার্তা। তাই সরকারের উচিত ছিল প্রথম থেকে সততা ও স্পষ্টতা প্রদর্শন। ইলিয়াস আলী কোন দলের কিংবা রাজনৈতিক বিবেচনায় ঘটনাকে বিচার না করে ইলিয়াস আলীর মানবিক-নাগরিক-সাংবিধানিক অধিকারকে গণ্য করা। তাতেও সরকার ব্যর্থ।
সরকারের তাহলে নাগরিকদের প্রতি দায়িত্বটা কী? সাগর-রুনির হত্যাকারীর কেশ স্পর্শ করা গেল না। সৌদি নাগরিক হত্যার সুরাহা করতে পারল না। রাজপথ থেকে একজন সাবেক সংসদ সদস্য তাঁর ড্রাইভারসহ উধাও। এক সপ্তাহ হলো- কিছুই করতে পারল না সংশ্লিষ্ট বাহিনী। সংসদ সদস্য-সাংবাদিকরা যদি এমন অসহায় হন, সাধারণ মানুষের কী হবে? দেশের মানুষ বিদ্যুৎবিহীন থাকে প্রায় ১৬ ঘণ্টা। রাত ১টার পরও লোডশেডিং হয়। কয়লা-গ্যাস কিছুরই বিহিত হলো না। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার গল্প শেষ হলো না। পদ্মা সেতু প্রকল্প ডুবোচরে আটকে আছে। এডিবির উন্নয়ন ফান্ডের অর্ধেক ফেরত যাচ্ছে। পণ্যসামগ্রী ও ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি করে শিল্পপতিরা জনগণের পকেট কাটছেন। তাহলে সরকার করছে কী? আমরা অতিসাধারণ লিখিয়েরা কী বলতে পারি। তবে এটুকুই বলি, ক্ষমতায় যাঁরা আছেন আর যাঁরা ক্ষমতারোহণের জন্য ব্যাকুল- উভয় পক্ষেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে ক্ষমতাহীন দুরবস্থার। এবার যদি জনগণ বিমুখ হয়, তবে নতুন অভিজ্ঞতা হবে- পায়ের তলায় তলহীনতার।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.