দেশহীন মানুষের কথা-আদিবাসীদের জন্য ওবামার ভাষণ by সঞ্জীব দ্রং
একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল বিশ্বের আদিবাসীদের জীবনে। ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ হোয়াইট হাউসে সকাল নয়টা ৩৯ মিনিটে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা করলেন, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রকে সমর্থন করছে। এ বিষয়ে ১৮ পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্র বা বিবৃতি দিয়েছে আমেরিকা।
আর বারাক ওবামা আদিবাসী নেতাদের উদ্দেশে হোয়াইট হাউসে বক্তব্য দিলেন ১৫ মিনিট। এর আগেও ওবামা হোয়াইট হাউসে আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে সভা করেছিলেন। বক্তৃতায় অনেক কথার পর ওবামা বললেন, ‘আমি আপনাদের কাছে অঙ্গীকার করেছিলাম। আমার মনে আছে, দুই বছর আগে আমি মন্টানাতে ক্রো আদিবাসীদের কাছে গিয়েছিলাম। মনে আছে, অনেক আদিবাসী নেতার সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। নিশ্চয় এসব কথা আপনাদের মনে আছে। আমি দত্তক ক্রো আদিবাসী হয়ে গিয়েছিলাম এবং আমার “ক্রো ইন্ডিয়ান” নামের অর্থ হলো, আমি এমন একজন মানুষ, যে এই ভূমির জনগণকে সাহায্য করে।’ তিনি বলেছেন, ‘আমি আদিবাসী এই নামটি পছন্দ করেছি এবং এর অর্থ ধরে রাখতে খুব কঠিন পরিশ্রম করছি।’
বারাক ওবামা বক্তব্যের শুরুতেই সম্বোধন করে বলেছেন, ‘আমি প্রথম আমেরিকান এবং সব আমেরিকানকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’ এখানে প্রথম আমেরিকানরা হলো আদিবাসীরা, যাদের নেটিভ আমেরিকান বা ইন্ডিয়ান বলা হয়। প্রেসিডেন্ট স্বয়ং আদিবাসীদের প্রথম আমেরিকান সম্বোধন করায় আমেরিকার সব জায়গা-জমি ও সম্পদ আদিবাসীদের হয়ে যাচ্ছে না বা সব সাদা মানুষকে আমেরিকা ছাড়তে হচ্ছে না। কিন্তু ওই কথার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক ভুল ও অন্যায়ের প্রতি বিনম্র স্বীকারোক্তি প্রকাশ পায়, যা রাষ্ট্রকে সম্মানে অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়। বছর যায়, বছর আসে। আমি ভাবি, আমাদের দেশে এ রকম কবে হবে?
এর আগে অস্ট্রেলিয়া সরকার ২০০৯ সালে এবং ২০১০ সালের এপ্রিলে নিউজিল্যান্ড সরকার, নভেম্বর মাসে কানাডা সরকার জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রকে সমর্থন করেছিল। ডিসেম্বরে এসে সমর্থন করল আমেরিকা। এই চার রাষ্ট্রই এই অধিকার ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা করেছিল ২০০৭ সালে। অনেক পরে হলেও ওরা বুঝতে পেরেছে, যাকে আদিবাসীরা স্বাগত জানিয়েছে। এর আগে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া সরকার আদিবাসীদের কাছে অতীতের ভুল আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল। তখন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আজ আমরা এই ভূমির আদিবাসীদের শ্রদ্ধা জানাই, যারা মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক। আমরা আমাদের অতীতের ভুল আচরণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। এখন জাতির জন্য সময় এসেছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের নতুন পাতা খোলার, যেখানে অতীতের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া হবে এবং সবাইকে আস্থায় নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ রচিত হবে।’ আমরা জানি, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর অস্ট্রেলিয়ার ভূমি থেকে আদিবাসীরা উৎখাত হয়ে যায়নি বা তাদের কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। কিন্তু চেতনা ও স্বপ্নের দিক থেকে আদিবাসী ও অস্ট্রেলিয়াবাসীর অতীতের অমর্যাদা ও অপমানের গ্লানির ভার কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি যদি আগামীকালই কাগজে-কলমে দেওয়া হয়, আদিবাসীরা তাদের জায়গা-জমি ফেরত পাবে না বা তাদের জীবনমানও রাতারাতি বদলে যাবে না। কিন্তু এটি তারা উপলব্ধি করতে পারবে যে রাষ্ট্র তাদেরও স্থান দিয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যখন আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়, তখন ১৪৩টি দেশ পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর বিপক্ষে দিয়েছিল ওই চারটি দেশ, যারা সবাই এখন ঘোষণাপত্রকে সমর্থন করল। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ, পুরো ইউরোপ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভারত, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন থেকে শুরু করে এশিয়ার প্রায় সব দেশ পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর আমাদের বাংলাদেশ অন্য ১০টি দেশের সঙ্গে ভোটদানে বিরত থেকেছিল। কয়েকটি দেশ পরে ঘোষণাপত্রকে সমর্থন করেছে।
এখন কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার সমর্থনের পর জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে নিশ্চয় বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র সমর্থন করা। তা ছাড়া ২০০৭ সালে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা কী বুঝে এই ১৪৭টি দেশের সঙ্গে গেল না, তা আমার বোধগম্য নয়। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন বিষয়টি ভেবে দেখবে কি?
আবার বারাক ওবামার বক্তব্যে ফিরে আসি। আমেরিকা ১৮ পৃষ্ঠার এই সমর্থনের বিবৃতিতে বলেছে, যার মূল কথাই হলো আদিবাসী জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নয়ন সাধন। আর রয়েছে আদিবাসী ভূমি রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সমস্যা, স্থায়িত্বশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আদিবাসী সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন ইত্যাদি। ওবামা বলেছেন, ‘ওয়াশিংটন আদিবাসী সমাজ ও মানুষের ওপর কোনো নীতি চাপিয়ে দিতে পারে না, এটি উচিত নয়। আদিবাসী সমাজ অধিকতর ভালো কাজ করতে পারে, যখন তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেছেন, যত দিন আমি হোয়াইট হাউসে আছি, এখানে আপনাদের ঠিকানা আছে, কণ্ঠ শোনার মানুষ আছে। এখানে কেউ আপনাদের অগ্রাহ্য করতে বা ভুলে যেতে পারবে না। ওবামা বলেন, ‘গত বছর আমি সব কেবিনেট এজেন্সিকে নির্দেশ দিয়েছি আদিবাসী সমাজ ও নেতাদের সঙ্গে অধিকতর সংলাপ করার জন্য। আদিবাসী তরুণ যাদের অনুভূতি হয়েছে যে তারা ব্যর্থ, আমরা তাদের কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের জন্যও কাজ করছি।’
বারাক ওবামা আদিবাসীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতা শেষ করেছেন এই বলে, ‘সুতরাং আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এগিয়ে চলার জন্যই আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি। আমি আশাবাদী, একত্রে কাজ করা অব্যাহত রাখলে আমরা “প্রথম আমেরিকান” এবং সব আমেরিকান জনগণের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনা করতে পারব।’
আমাদের রাষ্ট্রনায়কদের মুখেও এমন ভাষণ শোনার অপেক্ষায় ছিলাম বছরজুড়ে।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও আদিবাসী সংগঠক।
sanjeebdrong@gmail.com
বারাক ওবামা বক্তব্যের শুরুতেই সম্বোধন করে বলেছেন, ‘আমি প্রথম আমেরিকান এবং সব আমেরিকানকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’ এখানে প্রথম আমেরিকানরা হলো আদিবাসীরা, যাদের নেটিভ আমেরিকান বা ইন্ডিয়ান বলা হয়। প্রেসিডেন্ট স্বয়ং আদিবাসীদের প্রথম আমেরিকান সম্বোধন করায় আমেরিকার সব জায়গা-জমি ও সম্পদ আদিবাসীদের হয়ে যাচ্ছে না বা সব সাদা মানুষকে আমেরিকা ছাড়তে হচ্ছে না। কিন্তু ওই কথার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক ভুল ও অন্যায়ের প্রতি বিনম্র স্বীকারোক্তি প্রকাশ পায়, যা রাষ্ট্রকে সম্মানে অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়। বছর যায়, বছর আসে। আমি ভাবি, আমাদের দেশে এ রকম কবে হবে?
এর আগে অস্ট্রেলিয়া সরকার ২০০৯ সালে এবং ২০১০ সালের এপ্রিলে নিউজিল্যান্ড সরকার, নভেম্বর মাসে কানাডা সরকার জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রকে সমর্থন করেছিল। ডিসেম্বরে এসে সমর্থন করল আমেরিকা। এই চার রাষ্ট্রই এই অধিকার ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা করেছিল ২০০৭ সালে। অনেক পরে হলেও ওরা বুঝতে পেরেছে, যাকে আদিবাসীরা স্বাগত জানিয়েছে। এর আগে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া সরকার আদিবাসীদের কাছে অতীতের ভুল আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল। তখন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আজ আমরা এই ভূমির আদিবাসীদের শ্রদ্ধা জানাই, যারা মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক। আমরা আমাদের অতীতের ভুল আচরণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। এখন জাতির জন্য সময় এসেছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের নতুন পাতা খোলার, যেখানে অতীতের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া হবে এবং সবাইকে আস্থায় নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ রচিত হবে।’ আমরা জানি, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর অস্ট্রেলিয়ার ভূমি থেকে আদিবাসীরা উৎখাত হয়ে যায়নি বা তাদের কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। কিন্তু চেতনা ও স্বপ্নের দিক থেকে আদিবাসী ও অস্ট্রেলিয়াবাসীর অতীতের অমর্যাদা ও অপমানের গ্লানির ভার কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি যদি আগামীকালই কাগজে-কলমে দেওয়া হয়, আদিবাসীরা তাদের জায়গা-জমি ফেরত পাবে না বা তাদের জীবনমানও রাতারাতি বদলে যাবে না। কিন্তু এটি তারা উপলব্ধি করতে পারবে যে রাষ্ট্র তাদেরও স্থান দিয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যখন আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়, তখন ১৪৩টি দেশ পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর বিপক্ষে দিয়েছিল ওই চারটি দেশ, যারা সবাই এখন ঘোষণাপত্রকে সমর্থন করল। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ, পুরো ইউরোপ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভারত, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন থেকে শুরু করে এশিয়ার প্রায় সব দেশ পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর আমাদের বাংলাদেশ অন্য ১০টি দেশের সঙ্গে ভোটদানে বিরত থেকেছিল। কয়েকটি দেশ পরে ঘোষণাপত্রকে সমর্থন করেছে।
এখন কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার সমর্থনের পর জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে নিশ্চয় বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র সমর্থন করা। তা ছাড়া ২০০৭ সালে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা কী বুঝে এই ১৪৭টি দেশের সঙ্গে গেল না, তা আমার বোধগম্য নয়। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন বিষয়টি ভেবে দেখবে কি?
আবার বারাক ওবামার বক্তব্যে ফিরে আসি। আমেরিকা ১৮ পৃষ্ঠার এই সমর্থনের বিবৃতিতে বলেছে, যার মূল কথাই হলো আদিবাসী জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নয়ন সাধন। আর রয়েছে আদিবাসী ভূমি রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সমস্যা, স্থায়িত্বশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আদিবাসী সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন ইত্যাদি। ওবামা বলেছেন, ‘ওয়াশিংটন আদিবাসী সমাজ ও মানুষের ওপর কোনো নীতি চাপিয়ে দিতে পারে না, এটি উচিত নয়। আদিবাসী সমাজ অধিকতর ভালো কাজ করতে পারে, যখন তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেছেন, যত দিন আমি হোয়াইট হাউসে আছি, এখানে আপনাদের ঠিকানা আছে, কণ্ঠ শোনার মানুষ আছে। এখানে কেউ আপনাদের অগ্রাহ্য করতে বা ভুলে যেতে পারবে না। ওবামা বলেন, ‘গত বছর আমি সব কেবিনেট এজেন্সিকে নির্দেশ দিয়েছি আদিবাসী সমাজ ও নেতাদের সঙ্গে অধিকতর সংলাপ করার জন্য। আদিবাসী তরুণ যাদের অনুভূতি হয়েছে যে তারা ব্যর্থ, আমরা তাদের কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের জন্যও কাজ করছি।’
বারাক ওবামা আদিবাসীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতা শেষ করেছেন এই বলে, ‘সুতরাং আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এগিয়ে চলার জন্যই আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি। আমি আশাবাদী, একত্রে কাজ করা অব্যাহত রাখলে আমরা “প্রথম আমেরিকান” এবং সব আমেরিকান জনগণের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনা করতে পারব।’
আমাদের রাষ্ট্রনায়কদের মুখেও এমন ভাষণ শোনার অপেক্ষায় ছিলাম বছরজুড়ে।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও আদিবাসী সংগঠক।
sanjeebdrong@gmail.com
No comments