নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হোক by অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম সরকার
আমাদের একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, আর তা হলো নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টার ফসল আধুনিক সভ্যতা। উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টার ফলেই পৃথিবী ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছে। কোনো কিছুই কারও একক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠেনি বরং সৃষ্টির প্রথম থেকে আজ অবধি তারা প্রত্যেকে একে অন্যের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
তথাপিও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে নারীরা বিভিন্নভাবে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পুরুষশাসিত এ সমাজে নারীর প্রতি প্রদর্শিত বিদ্বেষ ও বৈষম্য যেন নারী জীবনের নির্মম সত্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষই তৈরি করে বিধান, নিয়ম-কানুন কিংবা আইন অথবা নৈতিকতার ধারালো অস্ত্র। যে অস্ত্রের নিচে বারবার নারীদেরই বলি হতে হয়। প্রায় সব নারী নীরবে নির্যাতন সহ্য করে যান মান-সম্মানের ভয়ে, শব্দ করে কান্না করাও ভুলে গেছেন অনেক নারী। বাংলাদেশে এ জাতীয় বাস্তবতা নতুন নয়, তথাপিও এটি সত্য নয়, অধিকন্তু ঘরেই নারীরা নির্যাতনের শিকার হন যা সত্যি উদ্বেগের বিষয়। জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের সাম্প্রতিক সময়ের তথ্যমতে, নারীরা অপরিচিতজনের হামলাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় না বরং ভয় পায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রেমিকের হাতে প্রতিদিনকার সহিংসতাকে। বাংলাদেশের পরিবার পর্যায়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য ছাড়াই এত নির্যাতন-সহিংসতা নারীরা ধারাবাহিকভাবে সহ্য করে যাচ্ছে একটি অন্ধ বিশ্বাসকে সামনে রেখে। এ জাতীয় প্রশ্নকে ঘিরে যে নীরবতার ষড়যন্ত্র বিদ্যমান তার আংশিক কারণ হচ্ছে, নারীদের অভিযোগ করতে নয়, বরং পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেই নিজেকে তৈরি করা হয়। যদি মানবিক সাধ্যে কুলায় তবে তারা তাদের কাজ চালিয়ে যান এ প্রত্যাশা নিয়ে যে, তাদের যন্ত্রণা এক সময় দূর হয়ে যাবে, শিগগিরই তারা নির্যাতন ও সহিংসতামুক্ত পারিবারিক জীবন উপভোগ করতে পারবেন এবং একদিন তারা তাদের শক্তি-উদ্যম ফিরে পাবেন। বোধকরি সেজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা নীরবে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন। ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোট ১৩ হাজার ৮৫ জন নারী এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫ হাজার ৮৭ জন নারী ও শিশু। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৫২ জন। নির্যাতনের মধ্যে শতকরা ৬৪ ভাগ ধর্ষণের শিকার, ১০ ভাগ এসিড ও ২৬ ভাগ যৌতুক নির্যাতনের শিকার।
নারী নির্যাতন বন্ধে আইন প্রচুর আছে, কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ ও যথাযথ বিচার হয় না বলে নারী নির্যাতন বাড়ছে। বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের প্রতি নির্যাতন বন্ধের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ ও যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ এবং এসিড নিক্ষেপ বন্ধের জন্য এসিড অপরাধ দমন আইন-২০০১ ও এসিড নিক্ষেপ আইন-২০০২ প্রণয়ন করা হলেও পরিবার পর্যায়ে নারীর প্রতি নির্যাতন বন্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শুধু বাংলাদেশ নয় বরং সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যায়, ভারতে প্রতি বছর ৫ হাজারের বেশি নারীকে খুন হতে হয় শ্বশুরপক্ষের লোকজনের কাছে প্রদত্ত যৌতুক অপ্রতুল বিবেচনার ফলে। এসব হত্যাকাণ্ডের খুব সামান্য সংখ্যকের বিচার হয়। পারিবারিক সহিংসতার ধারণা সহজ পদ্ধতিতে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়—পরিবারের মানুষ ও পারিবারিক সম্পর্ক সূত্রে কাছের মানুষজন কর্তৃক শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের চেষ্টা, নিজের মতামত জোর করে চাপিয়ে দেয়া ইত্যাদি। মূলত পারিবারিক সহিংসতা নারী অধিকার বিষয়ে অগ্রগতির পথে তীব্র প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে পরিবার পর্যায়ে সহিংসতা রোধের জন্য ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট বিদ্যমান; কিন্তু আমাদের দেশে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট নেই, ফলে নির্যাতিত নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিকার চাইতে পারে না। বস্তুত দেনমোহরানা, ভরণ-পোষণ এবং অভিভাবকত্বসহ বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক নিয়ে যে বিরোধ সেগুলো মূলত দেওয়ানি মামলার আওতায় পড়লেও এসব বিষয়ে যখন কেউ নির্যাতনের শিকার হয় তখন আর সেটা দেওয়ানি মামলার আওতায় পড়ে না বরং ফৌজদারি হয়ে যায়। এছাড়া যৌতুক, বহুবিবাহ ইত্যাদিও ফৌজদারি মামলার আওতায় পড়ে। সহিংসতার শিকার নারীদের সুরক্ষার জন্য সর্বোপরি পারিবারিক পর্যায়ে নির্যাতিত না হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট এখন সময়ের দাবি।
নির্যাতনের ধরনে এত রকমফের থাকলেও আইনগুলো রয়েছে ‘স্টিরিওটাইপ’, গত্বাঁধা। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ-১৯৭৯, নারী পাচার, দেহব্যবসা ইত্যাদি বন্ধ করা সম্পর্কিত সনদ এবং চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে গৃহীত বেইজিং কর্মপরিকল্পনা গৃহীত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কর্মসূচি-১৯৯৫ ইত্যাদির মতো আন্তর্জাতিক কনভেনশনের পাশাপাশি বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়েও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন থাকার পরও এ কারণে সেগুলো কাজে আসছে না।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ) দমন আইন-২০০০ সংশোধন করা হয় ২০০৩ সালে। এ আইনের মধ্যে বাংলাদেশের নারীদের বিভিন্ন রকমের নির্যাতন যেমন—ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, পাচার, অপহরণ এবং যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধের আইনগত সংজ্ঞা প্রদান করেছে। পাশাপাশি এসব অপরাধ দমনের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান সংযোজন করা হয়েছে। এ আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে। আইনের ৯(১) ধারা মতে, কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং সে এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। ধারা : ৯(৩) মতে, নারীকে যদি দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয় এবং ধর্ষিতার মৃত্যু হয় তবে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা। ৯(৫) ধারা মতে, পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে কোনো নারী ধর্ষিত হলে যাদের হেফাজতে থাকাকালে ওই ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরাই ওই নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরি দায়ী হবেন এবং তাদের প্রত্যেককেই ১০ বছর অথবা অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে পারেন। এখানে উল্লেখ করা উচিত, এরকম হেফাজতকারী যদি এরূপ প্রমাণ করতে পারে যে, তাদের হেফাজত কার্যক্রমে কোনো অনিয়ম বা অসাবধানতা ঘটেনি তবে তারা নির্দোষ বলে গণ্য হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ধারা : ৯(৪) অনুযায়ী, কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে বা জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবেন। কেনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ ১০ বছর কিন্তু সর্বনিম্ন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং এছাড়া আর্থিক দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। উল্লিখিত আইন ছাড়াও যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ ও পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইন-১৯৮৫ ও বাল্যবিবাহ আইন-১৯২৯ বিদ্যমান।
প্রচলিত আইনগুলো অর্থাত্ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত-২০০৩) কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে সহজ হবে যেমন—উল্লিখিত আইনটি বাংলাদেশ দণ্ডবিধি-১৮৬০, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯ এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, কেননা ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন মতে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েরা বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু দণ্ডবিধির ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে, ১৪ বছরের বেশি বয়স্ক স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সহবাসকে ধর্ষণ বলা যাবে না। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনমতে, যদি কোনো পুরুষ বিয়ে ছাড়া ১৬ বছরের বেশি বয়স্ক কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। বয়স নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। কেননা একেক আইনে একেক বয়স বিদ্যমান। পাশাপাশি দণ্ডবিধি আইনের ৫১১টি ধারা বিদ্যমান অথচ নির্যাতিত নারীদের জন্য সরাসরি ইভটিজিং বা পারিবারিক সহিংসতা রোধে কোনো সুনির্দিষ্ট ধারা নেই। তাই এ সমস্যা থেকে রক্ষার জন্য দরকার ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স প্রতিরোধ আইন।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলনে সব রাজনৈতিক সংগঠনকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, পুলিশ প্রশাসন এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে। সমাজের সব স্তর থেকে নারীর বিরুদ্ধে বিরাজমান বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। পরিবার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সব স্তরে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবেই মানবতা ও সমতার নীতির ভিত্তিতে নতুন মানবিক ও সমতাপূর্ণ সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
ই-মেইল : advsagar29@gmail.com
নারী নির্যাতন বন্ধে আইন প্রচুর আছে, কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ ও যথাযথ বিচার হয় না বলে নারী নির্যাতন বাড়ছে। বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের প্রতি নির্যাতন বন্ধের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ ও যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ এবং এসিড নিক্ষেপ বন্ধের জন্য এসিড অপরাধ দমন আইন-২০০১ ও এসিড নিক্ষেপ আইন-২০০২ প্রণয়ন করা হলেও পরিবার পর্যায়ে নারীর প্রতি নির্যাতন বন্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শুধু বাংলাদেশ নয় বরং সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যায়, ভারতে প্রতি বছর ৫ হাজারের বেশি নারীকে খুন হতে হয় শ্বশুরপক্ষের লোকজনের কাছে প্রদত্ত যৌতুক অপ্রতুল বিবেচনার ফলে। এসব হত্যাকাণ্ডের খুব সামান্য সংখ্যকের বিচার হয়। পারিবারিক সহিংসতার ধারণা সহজ পদ্ধতিতে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়—পরিবারের মানুষ ও পারিবারিক সম্পর্ক সূত্রে কাছের মানুষজন কর্তৃক শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের চেষ্টা, নিজের মতামত জোর করে চাপিয়ে দেয়া ইত্যাদি। মূলত পারিবারিক সহিংসতা নারী অধিকার বিষয়ে অগ্রগতির পথে তীব্র প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে পরিবার পর্যায়ে সহিংসতা রোধের জন্য ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট বিদ্যমান; কিন্তু আমাদের দেশে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট নেই, ফলে নির্যাতিত নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিকার চাইতে পারে না। বস্তুত দেনমোহরানা, ভরণ-পোষণ এবং অভিভাবকত্বসহ বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক নিয়ে যে বিরোধ সেগুলো মূলত দেওয়ানি মামলার আওতায় পড়লেও এসব বিষয়ে যখন কেউ নির্যাতনের শিকার হয় তখন আর সেটা দেওয়ানি মামলার আওতায় পড়ে না বরং ফৌজদারি হয়ে যায়। এছাড়া যৌতুক, বহুবিবাহ ইত্যাদিও ফৌজদারি মামলার আওতায় পড়ে। সহিংসতার শিকার নারীদের সুরক্ষার জন্য সর্বোপরি পারিবারিক পর্যায়ে নির্যাতিত না হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট এখন সময়ের দাবি।
নির্যাতনের ধরনে এত রকমফের থাকলেও আইনগুলো রয়েছে ‘স্টিরিওটাইপ’, গত্বাঁধা। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ-১৯৭৯, নারী পাচার, দেহব্যবসা ইত্যাদি বন্ধ করা সম্পর্কিত সনদ এবং চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে গৃহীত বেইজিং কর্মপরিকল্পনা গৃহীত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কর্মসূচি-১৯৯৫ ইত্যাদির মতো আন্তর্জাতিক কনভেনশনের পাশাপাশি বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়েও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন থাকার পরও এ কারণে সেগুলো কাজে আসছে না।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ) দমন আইন-২০০০ সংশোধন করা হয় ২০০৩ সালে। এ আইনের মধ্যে বাংলাদেশের নারীদের বিভিন্ন রকমের নির্যাতন যেমন—ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, পাচার, অপহরণ এবং যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধের আইনগত সংজ্ঞা প্রদান করেছে। পাশাপাশি এসব অপরাধ দমনের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান সংযোজন করা হয়েছে। এ আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে। আইনের ৯(১) ধারা মতে, কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং সে এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। ধারা : ৯(৩) মতে, নারীকে যদি দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয় এবং ধর্ষিতার মৃত্যু হয় তবে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা। ৯(৫) ধারা মতে, পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে কোনো নারী ধর্ষিত হলে যাদের হেফাজতে থাকাকালে ওই ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরাই ওই নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরি দায়ী হবেন এবং তাদের প্রত্যেককেই ১০ বছর অথবা অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে পারেন। এখানে উল্লেখ করা উচিত, এরকম হেফাজতকারী যদি এরূপ প্রমাণ করতে পারে যে, তাদের হেফাজত কার্যক্রমে কোনো অনিয়ম বা অসাবধানতা ঘটেনি তবে তারা নির্দোষ বলে গণ্য হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ধারা : ৯(৪) অনুযায়ী, কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে বা জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবেন। কেনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ ১০ বছর কিন্তু সর্বনিম্ন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং এছাড়া আর্থিক দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। উল্লিখিত আইন ছাড়াও যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ ও পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইন-১৯৮৫ ও বাল্যবিবাহ আইন-১৯২৯ বিদ্যমান।
প্রচলিত আইনগুলো অর্থাত্ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত-২০০৩) কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে সহজ হবে যেমন—উল্লিখিত আইনটি বাংলাদেশ দণ্ডবিধি-১৮৬০, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯ এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, কেননা ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন মতে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েরা বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু দণ্ডবিধির ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে, ১৪ বছরের বেশি বয়স্ক স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সহবাসকে ধর্ষণ বলা যাবে না। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনমতে, যদি কোনো পুরুষ বিয়ে ছাড়া ১৬ বছরের বেশি বয়স্ক কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। বয়স নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। কেননা একেক আইনে একেক বয়স বিদ্যমান। পাশাপাশি দণ্ডবিধি আইনের ৫১১টি ধারা বিদ্যমান অথচ নির্যাতিত নারীদের জন্য সরাসরি ইভটিজিং বা পারিবারিক সহিংসতা রোধে কোনো সুনির্দিষ্ট ধারা নেই। তাই এ সমস্যা থেকে রক্ষার জন্য দরকার ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স প্রতিরোধ আইন।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলনে সব রাজনৈতিক সংগঠনকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, পুলিশ প্রশাসন এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে। সমাজের সব স্তর থেকে নারীর বিরুদ্ধে বিরাজমান বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। পরিবার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সব স্তরে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবেই মানবতা ও সমতার নীতির ভিত্তিতে নতুন মানবিক ও সমতাপূর্ণ সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
ই-মেইল : advsagar29@gmail.com
No comments