ধর্ম-শীতার্ত মানুষকে শীতবস্ত্র দান করুন by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

আল্লাহ তাআলার অপার সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে সর্বপ্রথম ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে ভালোবাসতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে খিদমতে খালক বা সৃষ্টির সেবার প্রাথমিক কাজ হচ্ছে জনকল্যাণ ও মানবসেবা। অন্নহীনকে অন্নদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, গৃহহীনকে আশ্রয়দান, নিরক্ষরকে শিক্ষাদান, অসুস্থকে সেবাদান, অসহায়


বিত্তহীনকে অর্থদান, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বিপদ-আপদে পতিত দুস্থ মানুষকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করা, নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন, সৎকর্ম ও সদ্ব্যবহার শিক্ষা দেওয়া, বিপথগামীকে সত্য ও ন্যায়ের পথনির্দেশনা প্রদান এবং জনসাধারণের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করার সার্বিক প্রচেষ্টাই আর্তমানবতার সেবা। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, রুগ্ণ ব্যক্তির সেবা করো এবং বন্দীকে মুক্ত করো অথবা ঋণের দায়ে আবদ্ধ ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করো।’ (বুখারি)
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইচ্ছায় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ঋতুর পালাবদল ঘটে। কিন্তু প্রকৃতি কখনো কখনো বৈরী আচরণ করায় তা মানুষের অসহায়ত্বকে প্রকট করে তোলে। হিমেল হাওয়া ও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দরিদ্র জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চলে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই শীতার্ত মানুষের প্রতি সমাজের সামর্থ্যবান ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের সাহায্য ও সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করা অতীব প্রয়োজন। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র সরবরাহ করে তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো দরকার। নিঃস্বার্থভাবে শীতার্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করাই মানবসেবা। এই মহৎ ও পুণ্যময় কাজই সর্বোত্তম ইবাদত। অসহায় মানুষের দুর্দিনে সাহায্য, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মন-মানসিকতা যাদের নেই, তাদের ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সব কিতাব ও নবীদের প্রতি ঈমান আনয়ন করলে এবং আল্লাহ-প্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, পর্যটক, সাহায্য প্রার্থীদের এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থদান করলে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করলে ও জাকাত প্রদান করলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে, অর্থসংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে—এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৭৭)
তীব্র শীতের প্রকোপে দুঃসহ অবস্থায় পড়েছে দেশের লাখ লাখ দুস্থ মানুষ। উত্তরাঞ্চলের মানুষজন খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। শৈত্যপ্রবাহ থেকে বাঁচার জন্য অসহায় দরিদ্র মানুষের প্রয়োজন অনেক শীতবস্ত্রের। শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে হলেও প্রয়োজন সুচিকিৎসা ও ওষুধপথ্যাদি এবং শীত মোকাবিলায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ। বিশেষ করে, শিশুরা গণহারে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিলে শীতের দুর্ভোগ যেমন বাড়বে, তেমনি শীতজনিত মৃত্যুর হারও বাড়বে। এ জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে বিত্তবান ব্যক্তিদের সবাইকে শীতার্ত-বস্ত্রহীন মানুষের পাশে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) পরকালীন পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা ঘোষণা করেছেন, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাপড় দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের পোশাক দান করবেন। ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুস্বাদু ফল দান করবেন। কোনো মুসলমানকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি পান করালে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সিলমোহরকৃত পাত্র থেকে পবিত্র পানি পান করাবেন।’ (আবু দাউদ)
সরকারি পর্যায়ে শীতবস্ত্র ও ওষুধপথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারিভাবেও সাহায্য-সহযোগিতায় নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এই মানবিক দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় শীত নিবারণে দুর্গত অঞ্চলে গরম কাপড়, ওষুধপথ্য সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। দুর্যোগময় মুহূর্তে করণীয় হলো মনপ্রাণ খুলে আর্তমানবতার সেবায় সাহায্যের হাত বাড়ানো; খাদ্য, ওষুধ, পথ্য, শীতবস্ত্র এবং জরুরি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বিপদগ্রস্ত দুর্গত মানুষের পাশে যাওয়া এবং দুস্থ মানবতার সেবায় অগ্রসর হওয়া।
গরম কাপড়ের অভাবে যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে শীতার্ত মানুষের দিন কাটছে—এ অবস্থার শিগগিরই অবসান ঘটাতে হবে। শীতের প্রভাবে নিউমোনিয়াসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। যারা শীতজনিত রোগব্যাধিতে ভুগছে, তাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ওষুধপথ্য ও সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা একান্ত প্রয়োজন। যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাদের দুরবস্থা সর্বাধিক। হাড়কাঁপানো শীতে যে বিপুল জনগোষ্ঠী বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্টে দিনযাপন করছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো ধর্মপ্রাণ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব একটি মুসিবত দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার মুসিবতসমূহ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবী মানুষকে সচ্ছল করে দেবে, আল্লাহ তাকে ইহকাল ও পরকালে সচ্ছল করে দেবেন এবং আল্লাহ বান্দার সাহায্য করবেন, যদি বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।’ (মুসলিম)
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে শীতার্ত লোকজন না পারে পেট ভরে ভাত খেতে, না পারে অসুখ হলে চিকিৎসা করাতে। শহরেও শীতবস্ত্রহীন মানুষ কোনো বাড়ির বা অফিসের বা দোকানের পাশে বা কোনো স্টেশনে খালি গায়ে বাঁকা হয়ে ঘুমায়। তাদের নেই কোনো শীত নিবারণ করার সম্বল। তাই সমাজের বিত্তশালীরা যদি ইচ্ছা করেন, তাঁদের নিজ নিজ জেলার শীতার্ত অসহায় গরিব-দুঃখী মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করতে পারেন। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়ায় মানুষকে খাদ্য দান করেছে, সেদিন (রোজ কিয়ামতের দিন) তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’
প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষেরই পারস্পরিক মানবতাবোধ ও উদার মানসিকতা থাকা অপরিহার্য। একজন মানুষ বিপদে পড়লে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অসহায় হলে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করা সমাজের বিত্তবান প্রতিবেশীদের ঈমানি দায়িত্ব ও মানবিক কর্তব্য। সব মানুষের উচিত সমগ্র সৃষ্টির প্রতি দয়া-মায়া, অকৃত্রিম ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতি বজায় রাখা। তাই দেশের বিত্তবান ব্যক্তি যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা এই শীতের মৌসুমে শীতার্ত, গরিব, অসহায়, দুঃখী মানুষকে যাঁর যাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন বা পুরাতন কিছু শীতবস্ত্র দিয়ে অকাতরে সাহায্য করুন। কোনো ধর্ম, জাত, কুল বা বংশ নয়—মানুষ নামের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে যেন হূদয় ও মনপ্রাণ দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা ও আর্তমানবতার সেবায় পরম সহানুভূতিতে এগিয়ে আসতে সমর্থ হই, আল্লাহ তাআলা আমাদের এ তাওফিক দান করুন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.