মিডিয়া মোগল by মাহবুব মোর্শেদ

প্রতিশব্দ থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় ভাষার কিছু শব্দ ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত হয়। যেমন পণ্ডিত। বিদ্বান ব্যক্তিকে পণ্ডিত বলে আখ্যায়িত করার রেওয়াজ আছে। তেমনি মোগল আরেক ভারতীয় শব্দ। মিডিয়া মোগল কথাটা বেশ পরিচিত। মিডিয়া সম্রাট অর্থে মিডিয়া মোগল কথাটার ব্যবহার। সম্রাট শব্দটা আমাদের মিডিয়ায়ও আকসার ব্যবহৃত হয়।


ব্যক্তি নাম হিসেবেও সম্রাট জনপ্রিয়। কিন্তু মোগল বলে সাধারণত কাউকে আখ্যায়িত করা হয়। এখানে মোগল বলতে মোগল সম্রাটদেরই বোঝানো হয়। একটা প্রবাদ অবশ্য ব্যতিক্রম_ 'পড়েছি মোগলের হাতে_ খানা খেতে হবে সাথে।' এই প্রবাদে সাধারণ অথচ খাদ্যরসিক ব্যক্তিকে মোগল বলতে দেখা যায়। এর বাইরে সাধারণত কাউকে মোগল বলা হয় না। সম্প্রতি মিডিয়া মোগল কথাটা বেশ আলোচিত হচ্ছে একজন মোগলের সূত্রে। রুপার্ট মারডককে অবশ্য শুধু মোগল নয়_ ব্যারন, টাইকুন, বস নানা অভিধায় ডাকা হয়। রুপার্ট মারডক কেমন মোগল তা আমাদের সম্রাটের ধারণা থেকে বোঝা একটু কঠিন। তিনি যে কোম্পানিটির সিইও সেই নিউজ করপোরেশন বিশাল প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় কনগ্গ্নোমারেট। নানা ধরনের, নানা কাজের, নানা কিসিমের প্রতিষ্ঠানের যৌথ রূপ হলো কনগ্গ্নোমারেট। এই প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশ করে, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল চালায়, টিভির জন্য অনুষ্ঠান বানায়, সিনেমা প্রযোজন করে, অ্যালবাম প্রকাশ করে, স্টুডিও পরিচালনা করে, ইন্টারনেটভিত্তিক বাণিজ্যিক উদ্যোগ নেয়। মোটকথা, মিডিয়া বলতে যা বোঝায় তার সব শাখাতেই এর বিস্তার। সহজভাবে বললে, এক নিউজ করপোরেশনের অধীনে কাজ করে শত শত প্রতিষ্ঠান। তারা একজোট হয়ে বিশ্বের মিডিয়া সাম্রাজ্যের বড় একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। রুপার্ট মারডক যে ধরনের ব্যবসায়ী তেমন ব্যবসা বুঝে ওঠাই আমাদের জন্য কঠিন। কেননা এমন ব্যবসার উদাহরণ আমাদের দেশে নেই। মিডিয়া ব্যবসায় করপোরেট উদ্যোগ এ দেশে আছে, কিন্তু কোনো শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী শুধু মিডিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করেছেন এমন উদাহরণ দেওয়া কষ্টকর হবে। ফলে রুপার্ট মারডক আমাদের দেশে খানিকটা ইতিহাসের মোগলদের মতোই। যার কর্মকাণ্ড আমরা আঁচ করতে পারি, কিন্তু পুরো বুঝে ওঠা কঠিন। শত শত পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের কর্ণধার সম্প্রতি ব্রিটেনে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েডের কারণে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। নানা প্রশ্নের মুখে রীতিমতো নাকাল হতে হয়েছে তাকে। অভিযোগটা সবার জানা। তার 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড' পত্রিকাটি রসাল ও কৌতূহলোদ্দীপক খবরের জন্য পুলিশের সাহায্যে বহু মানুষের ফোন হ্যাক করেছে। অর্থমন্ত্রী, রাজপরিবারের সদস্য, যুদ্ধে নিহত সৈন্য, হত্যার শিকার ব্যক্তি কেউই তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা থেকে বাদ পড়েনি। বহুদিন ধরে চলছিল এই অপকর্ম। পত্রিকাও রসাল আইটেম সমৃদ্ধ হয়ে বাজার মাত করছিল। কিন্তু সহসা ফাঁস হয়ে গেলে পুরনো কাসুন্দি সবার চোখের সামনেই ঘাঁটা হচ্ছে। পুরনো সাংবাদিক, পুলিশ অফিসার, রাজনীতিক থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বহু মানুষ প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড অপরাধ করেছে, অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নাম ইতিমধ্যে বেরিয়ে এসেছে। কারা অপরাধী সে প্রশ্ন নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো_ এত বড় ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মধ্যে নৈতিকতার অবস্থান কোথায়? শুধু ব্যবসা এবং মুনাফার জন্য যেনতেন প্রকারে সংবাদ সংগ্রহের প্রবণতার মধ্যে দায়িত্ববোধের অবস্থান কোথায়? এ প্রশ্নগুলো আরও কিছু প্রশ্নকে উস্কে দিচ্ছে। সেগুলো হলো মুক্ত সংবাদপত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি প্রশ্নহীন বা পর্যবেক্ষণহীন থাকা উচিত? আরও একটি প্রশ্ন অবশ্য বাতাসে ঘুরছে। তা হলো, ট্যাবলয়েডের যুগ কি শেষ হয়ে এলো? নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে এ প্রশ্ন উঠছে যে, এমন সংবাদপত্রগুলো ভবিষ্যতে কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? লোকে রসাল খবর পছন্দ করে বটে, কিন্তু রসাল খবরের উৎস যদি বন্ধ হয় তবে পত্রিকা সেগুলো ছাপবে কীভাবে আর মানুষই-বা পড়বে কীভাবে?
 

No comments

Powered by Blogger.