রমজানের পাঠ by কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক

কালের বিবেচনায় ধর্মীয় উপলক্ষের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট, সম্মানের বিবেচনায় সর্বশ্রেষ্ঠ, প্রভাবের বিবেচনায় সুদূর বিস্তৃত উপলক্ষ হলো মহিমান্বিত মাহে রমজান। এ মাসের পুরো সময় অনেকটা বিদ্যালয়ের মতো, যে সময়ে শেখার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।


কোনো কারণে নামাজ ছুটে গেলে আমরা তা পরবর্তী সময়ে আদায় করে নিতে পারি, কিংবা রোজাও পরবর্তী সময়ে রাখতে পারি। কিন্তু রমজানের সময়টি সে রকম নয়। এ সময় যদি পার হয়ে যায় এমন অবস্থায় যে, আমরা রমজানের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলো নিতে পারলাম না, তবে তা বিরাট ক্ষতি।
আক্ষেপের বিষয়, বর্তমান মুসলিম সংস্কৃতিতে রোজা ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা এবং সংযমের পরিবর্তে পরিণত হয়েছে উৎসবের মাসে! রমজানের রাতগুলো পরিণত হয় পার্টি ও ভোজের রাতে, যা কিনা কোনো কোনো দেশে ভোর পর্যন্ত চলে। সেখানে রাত পরিবর্তিত হয় দিনে, দিন পরিবর্তিত হয় রাতে (বহু মানুষই রোজার সময়টুকু ঘুমিয়ে কাটায়)। সাধারণত সেহরিতে মানুষ হালকা খাবারের বদলে পেট ভরে খায়। ফলে রোজা অবস্থায় খুব কম মানুষই প্রকৃত ক্ষুধার তাড়না বোধ করে। আবার ইফতারের সময় আরেক দফা ভরপেট খাওয়া চলে। সেই সঙ্গে রয়েছে রকমারি খাবারের আয়োজন। ফলে অনেকেই রমজান শেষে ওজন বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ করে! অথচ আল্লাহতায়ালা বড় বড় উপলক্ষ রেখেছেন, যা হৃদয়ে ইমানকে শাণিত করে, অন্তরাত্মায় আন্দোলিত করে উচ্ছ্বসিত অনুভূতি। অতঃপর বাড়িয়ে দেয় এবাদত-আরাধনার অনুঘটনা, সংকুচিত করে দেয় সমাজে পাপ ও অন্যায়ের ক্ষেত্রগুলো। রমজান মুসলমানদের দেয় ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, স্বচ্ছতা, সহমর্মিতা, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা, পবিত্রতা, উত্তমতা ও শৌর্য-বীর্যের দীক্ষা। এটি একটি সুমিষ্ট পানীয়র প্রস্রবণ। এটি এবাদতকারীদের জন্য একটি নিরাপদ ভূমি, আনুগত্যকারীদের জন্য দুর্বার দুর্গ। যারা পাপী তাদের জন্য এটি একটি সুযোগ, যাতে তারা তাদের গুনাহ থেকে তওবা করতে পারে। তাদের জীবন-ইতিহাসে স্বচ্ছ কিছু অধ্যায় রচিত করতে পারে। তাদের জীবনকে ভরে দিতে পারে উত্তম আমলে, উৎকৃষ্ট চরিত্রে। জাতির জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়া জরুরি, যখন আত্মার পরিশুদ্ধি ও তৃপ্তি সম্পন্ন হবে। যখন ইমানের মাইলফলকগুলো নবায়ন করা হবে। যা কিছু নষ্ট হয়েছে তা সংস্কার করা হবে। যেসব রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে তা সারিয়ে তোলা হবে। রমজান সেই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত যেখানে মুসলিম উম্মাহ তাদের বিভিন্ন অবস্থা সংস্কার করার সুযোগ পায়, তাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ পায়। তাদের অতীতকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ পায়। এটা আত্মিক ও চারিত্রিক বল ফিরিয়ে আনার একটি মাস। আর এ আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক শক্তি ফিরিয়ে আনা প্রতিটি জাতিরই কর্তব্য। মুসলমানরা এ মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে অধীর আগ্রহে। এটা ইমান নবায়নের একটা বিদ্যাপীঠ। চরিত্র মাধুর্যমণ্ডিত করার সময়, আত্মাকে শাণিত করার সময়, নফ্সকে ইসলাহ করার সময়, প্রবৃত্তিকে কন্ট্রোল করার সময়, কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার সময়।
রমজানে অর্জন হয় তাকওয়া। রমজানে বাস্তবায়িত হয় আল্লাহর নির্দেশমালা। শাণিত হয় ইচ্ছা। রমজানে একজন মুসলিম প্রশিক্ষণ নেয় আত্মদানের। রমজানে অর্জিত হয় ঐক্য, মহব্বত, ভ্রাতৃত্ব। এ মাসে মুসলমানরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়ার অনুভূতি অর্জন করে। অনুভব করে ক্ষুধার্তের ক্ষুধা। রোজা ত্যাগ, বদান্যতা ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার সময়। এটা সত্যিই চরিত্রের জন্য সহায়ক।
বিভিন্ন ধরনের এবাদত প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সঙ্গে আমাদের বন্ধন প্রতিষ্ঠার উপায়। রমজানে এই এবাদতগুলো পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, যেন আমরা এই মাস শেষে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের উচ্চতর স্তরে অবস্থান করতে পারি। খাদ্য ও পানীয় দেহের পুষ্টির উৎস। মনের খাদ্য হচ্ছে জ্ঞান, আর অন্তরের প্রয়োজন হচ্ছে ইমান এবং আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা। রমজানে অধিক ইবাদতের দ্বারা আমরা এবাদতকে আমাদের জীবনের মৌলিক কাঠামো হিসেবে গ্রহণের শিক্ষা পাই। কোরআনে যেমনটি বলা হচ্ছে, 'নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার ত্যাগ, আমার জীবন-মরণ, জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।' (সূরা আল আনআম, ৬ :১৬২)
kalamidea@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.