সংকট ও অপরাধের আবর্তে রাজনীতি by ডা. এম এ হাসান
নানা সংকট ও সমস্যার মধ্যে দেশের মানুষ জীবন ও সময় অতিবাহিত করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিরোধী দলের হরতাল এবং নেতিবাচক রাজনীতি। এর মধ্যে রাষ্ট্র কিভাবে পূর্বমুখী বাণিজ্য বিকাশ করবে বা জনগণকে শান্তি, স্বস্তি ও উন্নয়নের ছোঁয়া দেবে তা ভাবার বিষয়।
তবে রাষ্ট্রপক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে খতিয়ানই দিক না কেন, ভোক্তাপক্ষ বা নাগরিকরা বিদ্যুতের লুকোচুরি এবং তথাকথিত লোডশেডিংয়ের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্বল্প সময় চলমান থাকার কথা থাকলেও এখনো তা চলমান থাকতে বাধ্য হচ্ছে বা চলমান থাকছে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতার কারণে। এ কারণে রাষ্ট্রপক্ষ রুষ্ট হয়ে জনগণকে আরো আঁধারে নিমজ্জিত করার ভীতি প্রদর্শন করছে। অর্থাৎ ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাফল্যসংক্রান্ত উপলব্ধি জনগণের বোধের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভেবে দেখা প্রয়োজন যে এ ধরনের সহনশীলতার অভাব বা জনগণকে শিক্ষা দেওয়ার প্রবণতা বাঙালিকে কোথায় নিতে পারে, তা পাকিস্তানি বা ব্রিটিশরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে। হয়তো বাঙালি শাসকের বোধোদয় হতে বিলম্ব হচ্ছে। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠায় তিন বছরের বেশি সময় লাগবে সেটা সহজবোধ্য কথা। কিন্তু তিন বছরে কত দূর এগোলাম তারও একটা পরিমাপ হওয়া প্রয়োজন এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন নীতি, অগ্রগতি এবং বর্তমান অবস্থা জানানোর অধিকার দেশের সব জনগণের। এ বিষয়ে ব্যর্থতার দায় কে নেবে সেটাও পরিষ্কার হতে হবে। বিদ্যুৎ বিতরণের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সিস্টেমলস পরিমাপ ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা কেন নেওয়া হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়।
যা হোক, বিকল্প বিদ্যুৎ কিংবা পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুতের ব্যাপারে কত দূর এগোলাম এবং আগামী ১০ বছরে কত দূর এগোতে পারব, সে বিষয় বছরভিত্তিক একটি প্রজেকশন দেখতে চায় দেশের বিশেষজ্ঞরা, তথা বুদ্ধিজীবীরা। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জনগণ কতটা লাভবান হলো তা হিসাব-নিকাশের বিষয়। কুইক রেন্টালের ঘোষিত উৎপাদন কতটা বাস্তব তা ভাবার বিষয়। এ বিষয়ে সুধী সমাজের পক্ষ থেকে একটা সমীক্ষা হতে পারে। পচনশীল দাহ্য পদার্থ বা বায়োগ্যাস এবং ওয়েস্টভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো কী অবস্থায় রয়েছে এবং কত দূর যেতে পারে তাও জানা প্রয়োজন। দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যারা বাধা প্রদান করছে তারা জ্বালানি সমস্যা নিরসনে বা বিদ্যুৎ উৎপাদনে কী বিকল্প ব্যবস্থা ভাবছে বা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, সেটাও পরিষ্কার হতে হবে। না হলে এসব মানুষকে জনগণ গণশত্রু বা প্রতিপক্ষ ভাবতে বাধ্য হবে।
কয়েক মাইল এলাকার জনগণকে স্থানান্তর করে কাভার্ড পদ্ধতিতে দূষণমুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি কয়লা উত্তোলন করা হয় এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করা যায়, তাহলেই দেশের বহুমুখী সমস্যার সমাধান হতে পারে। নতুন নগরায়ণ বন্ধ করেই এসব করতে হবে। আইন করে হলেও চাষযোগ্য ভূমিতে শিল্প বা নতুন স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করতে হবে। পাহাড় ও গাঁয়ের জমি বহিরাগত বা তথাকথিত রিহ্যাবের কাছে বিক্রি অথবা হস্তান্তর আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে- যেমনটা ভারত করেছে উত্তরাঞ্চল ও হিমাচল প্রদেশে। এমন আইন প্রযোজ্য হতে হবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুয়াকাটাসহ দক্ষিণের দ্বীপাঞ্চল এবং নতুন সমুদ্রসীমায়।
পানি সমস্যা মেটানোর জন্য হাজারটা পথ রয়েছে। কিন্তু সরকার বিপথে হাঁটছে অথবা কথার কথা বলছে। পানি সরবরাহ লাইনের খোল-নলচেসহ পানির আধার ও উৎস নির্মাণ সময়ের প্রয়োজন।
রাস্তাঘাট ও যানজটের মতো যে বিষয়গুলো নিয়ে জন-অসন্তোষের সূত্রপাত, তা কেন হলো এবং প্রথম তিন বছরে তার সমাধান হলো না কেন, তার একটা উত্তর জনগণ প্রত্যাশা করে। আবুল হোসেনের মতো অপ্রিয় মন্ত্রীকে আঁকড়ে থাকার রহস্যটা কোথায়, তা দেশ-বিদেশে অনেকের কাছে গবেষণার বিষয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যর্থ ফারুক খানকে কেন এতটা দীর্ঘ সময় রাখা হলো এবং সামিট গ্রুপকে কেন বেশির ভাগ কুইক রেন্টালের কাজ দেওয়া হলো, সেটা জনগণের মনের প্রশ্ন। এসব বিষয়ে কথা বলায় মিডিয়ার ওপর সরকার কেন খৰহস্ত এবং অসহিষ্ণু হলো সেটাও একটি যৌক্তিক জিজ্ঞাসা।
সম-অধিকার চর্চা, মানবমর্যাদা, আইনের শাসন, পরমতসহিষ্ণুতা এবং সার্বিক সহমর্মিতাই হলো গণতন্ত্রের মূল কথা। এ ক্ষেত্রে একক শাসন বা Authoritarian ব্যক্তিশাসনের কোনো স্থান নেই। এক অর্থে গণতন্ত্র অর্থ এমন যৌথ শাসন, যেখানে শাসিত শাসকের সমান মর্যাদা ভোগ করবে।
সরকার ও বিরোধী দল কেন গণতন্ত্রের ব্যাকরণ মানছে না, সেটা নানা কারণে বিশ্লেষণের বিষয়। অথচ সরকার তো গণতন্ত্রের ঝাণ্ডা উড়িয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জিতে এসেছে। আর বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকতে সন্ত্রাসকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে হাওয়া ভবনকে ক্ষমতা ও দুর্নীতির লালকেল্লা বানিয়েছিল। এরপর আহসানউল্লাহ মাস্টার ও কিবরিয়া হত্যায় হাত পাকিয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে বিরোধী দলকে সমূলে বিনাশ করার চেষ্টা করে। এর আগে ২০০২ সালে নির্বাচনোত্তর সময়ে দেশকে তো সহিংসতার নরক বানানো হয়েছিল- জনগণ এসব ভোলেনি।
বর্তমান সরকারের অনেক ইতিবাচক অর্জন রয়েছে। সেই অর্জনের কথাগুলো গুছিয়ে বলতে হবে। অর্থনীতির হালটা শক্ত করে ধরতে হবে। সহনশীলতা ও ধীশক্তির সফল প্রয়োগ করতে হবে। চালবাজি দিয়ে যেমন সব চলে না, তেমনি শুধু কথায় চিঁড়ে ভেজে না। যে বিরোধী দল শূন্য থেকে উঠে এলো তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড যেমন গুছিয়ে বলার লোক নেই, তেমনি অপকর্মের দ্রুত বিচার বা প্রতিকারও দৃশ্যমান নয়। এর মধ্যে একের পর এক নষ্ট কাজে লিপ্ত হয়ে ভাবমূর্তিকে কেবল মসিলিপ্ত নয়, শুভ অর্জনগুলোও মলিন করছে সরকার নিজেই। এ যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল প্রয়োগ।
রুনি ও সাগর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডয়ের মতো গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নিলে সরকারের নাক কাটা যেত না। মিডিয়ার বিরোধিতার মুখে আবুল সাহেবকে সমর্থন না দিলে অনেক বন্ধু শত্রুরূপে অবতীর্ণ হতো না। ওবায়দুল কাদের, তোফায়েল সাহেব, মেনন সাহেব এবং মান্নাকে শুরুতেই কাজে লাগালে সরকারই উপকৃত হতো। একজন কর্মক্ষম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া যেত শুরুতেই। সেটা মেজর রফিক কিংবা জেনারেল সালাম হতে পারতেন। সোহেল তাজের প্রতি এবং প্রয়াত তাজউদ্দীনের প্রতি সুবিচার না করাটা জনগণ ভালো চোখে দেখেনি। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতো অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সাধারণ বোধ, বিবেচনা ও বুদ্ধিই যথেষ্ট। ইউনূস অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ল্যাসকির 'গ্রামার অব পলিটিকস'-এর পাঠ অপরিহার্য নয়।
রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এবং সার্বিক শৃঙ্খলা আনার জন্য প্রয়োজনীয় পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঠিক ব্যবহার নিদারুণভাবে অনুপস্থিত। অবকাঠামোগত দুর্বলতা তো রয়েছেই। কয়েক হাজার গাড়ির চালকের প্রশিক্ষণ, চলাচলের সময় লেন নিয়ন্ত্রণ, হাইওয়ে পুলিশের সঠিক ব্যবহার আহামরি কোনো কঠিন কাজ নয়। আজ পর্যন্ত হাইওয়ে পুলিশকে কার্যকর ও কর্মক্ষম অবস্থায় দেখা যায়নি। স্পিডগান ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার তো পরের কথা।
ব্যবসা-বাণিজ্যে দলবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্য পরিহার করতে না পারলে নখদন্তহীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিপালন যে লোকদেখানো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জনগণকে অংশীদার করে নিয়ে ভূমি দখল, নদী দখল রোধসহ, অফিস-আদালতে ব্যাপক দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং প্রশাসনিক নানা সংস্কার কার্যকর করা যেত। নিষ্ঠা ও সততাভিত্তিক কাজ করলে সেবা খাতেরও ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হতো। চটকদার কাজগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব স্তরে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র সুসংহত করা যেত। সদিচ্ছা থাকলে আইন করে সংসদকে অর্থবহ করা যেত। এতে বিরোধী দল জনগণের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা করে সংসদ সদস্য হিসেবে যেমন বহাল থাকতে পারত না, তেমনি অপরাধীর পক্ষ নিয়ে কোনো পক্ষেরই রাজনীতি করার সুযোগ থাকত না।
যারা যুগে যুগে ন্যায়ের কথা বলে অন্যায় কর্মে লিপ্ত হয়, জনগণকে জিম্মি করে অপরাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়, সমগ্র জাতিকে নেতিবাচক রাজনীতিতে আবদ্ধ রাখে, তাদের রুখতে জনগণ জেগে উঠবে- এটাই প্রত্যাশা। হত্যা, গুম ও অপরাজনীতিতে দেশ যখন লাতিন আমেরিকান দেশগুলোকে অনুসরণ করছে, তখন সর্বজনসম্মত একটি তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য। এটা হতে পারে বহু আলোচিত সেই নিরাপত্তা কাউন্সিল। এরাই নানা দলমতের মধ্যে সমন্বয় সাধনসহ নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য সমতল ক্ষেত্র নির্মাণ করবে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে হত্যা-গুমের রাজনীতি বিকশিত হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে। বাম ঘরানার মানুষগুলো নির্মূল করা থেকে এ কাজের শুরু। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। এখন তা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া বা অপ্রতিরোধ্য ভাইরাস হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। লুটেরা শক্তি ও সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এ সুযোগ গ্রহণ করছে এবং নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে। লুটেরা শক্তির নানা অপকর্মের বিষয় আড়াল করার জন্য নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ইলিয়াস আলী ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা গভীরভাবে ভাবার বিষয়। কার্যকারণ যা-ই হোক না কেন, Enforced Disappearance বা Involuntary Disappearance-এর বিষয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। এ বিষয়ে গুম হওয়া মানুষের পরিবারের মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন সমস্যার সমাধান বেগবান করার জন্য। এ ক্ষেত্রে দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে। আইন বা সার্বভৌমত্বের কথা বলে মানবতাবিরোধী অপরাধ আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি
এই প্রেক্ষাপটে ভেবে দেখা প্রয়োজন যে এ ধরনের সহনশীলতার অভাব বা জনগণকে শিক্ষা দেওয়ার প্রবণতা বাঙালিকে কোথায় নিতে পারে, তা পাকিস্তানি বা ব্রিটিশরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে। হয়তো বাঙালি শাসকের বোধোদয় হতে বিলম্ব হচ্ছে। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠায় তিন বছরের বেশি সময় লাগবে সেটা সহজবোধ্য কথা। কিন্তু তিন বছরে কত দূর এগোলাম তারও একটা পরিমাপ হওয়া প্রয়োজন এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন নীতি, অগ্রগতি এবং বর্তমান অবস্থা জানানোর অধিকার দেশের সব জনগণের। এ বিষয়ে ব্যর্থতার দায় কে নেবে সেটাও পরিষ্কার হতে হবে। বিদ্যুৎ বিতরণের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সিস্টেমলস পরিমাপ ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা কেন নেওয়া হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়।
যা হোক, বিকল্প বিদ্যুৎ কিংবা পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুতের ব্যাপারে কত দূর এগোলাম এবং আগামী ১০ বছরে কত দূর এগোতে পারব, সে বিষয় বছরভিত্তিক একটি প্রজেকশন দেখতে চায় দেশের বিশেষজ্ঞরা, তথা বুদ্ধিজীবীরা। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জনগণ কতটা লাভবান হলো তা হিসাব-নিকাশের বিষয়। কুইক রেন্টালের ঘোষিত উৎপাদন কতটা বাস্তব তা ভাবার বিষয়। এ বিষয়ে সুধী সমাজের পক্ষ থেকে একটা সমীক্ষা হতে পারে। পচনশীল দাহ্য পদার্থ বা বায়োগ্যাস এবং ওয়েস্টভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো কী অবস্থায় রয়েছে এবং কত দূর যেতে পারে তাও জানা প্রয়োজন। দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যারা বাধা প্রদান করছে তারা জ্বালানি সমস্যা নিরসনে বা বিদ্যুৎ উৎপাদনে কী বিকল্প ব্যবস্থা ভাবছে বা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, সেটাও পরিষ্কার হতে হবে। না হলে এসব মানুষকে জনগণ গণশত্রু বা প্রতিপক্ষ ভাবতে বাধ্য হবে।
কয়েক মাইল এলাকার জনগণকে স্থানান্তর করে কাভার্ড পদ্ধতিতে দূষণমুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি কয়লা উত্তোলন করা হয় এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করা যায়, তাহলেই দেশের বহুমুখী সমস্যার সমাধান হতে পারে। নতুন নগরায়ণ বন্ধ করেই এসব করতে হবে। আইন করে হলেও চাষযোগ্য ভূমিতে শিল্প বা নতুন স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করতে হবে। পাহাড় ও গাঁয়ের জমি বহিরাগত বা তথাকথিত রিহ্যাবের কাছে বিক্রি অথবা হস্তান্তর আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে- যেমনটা ভারত করেছে উত্তরাঞ্চল ও হিমাচল প্রদেশে। এমন আইন প্রযোজ্য হতে হবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুয়াকাটাসহ দক্ষিণের দ্বীপাঞ্চল এবং নতুন সমুদ্রসীমায়।
পানি সমস্যা মেটানোর জন্য হাজারটা পথ রয়েছে। কিন্তু সরকার বিপথে হাঁটছে অথবা কথার কথা বলছে। পানি সরবরাহ লাইনের খোল-নলচেসহ পানির আধার ও উৎস নির্মাণ সময়ের প্রয়োজন।
রাস্তাঘাট ও যানজটের মতো যে বিষয়গুলো নিয়ে জন-অসন্তোষের সূত্রপাত, তা কেন হলো এবং প্রথম তিন বছরে তার সমাধান হলো না কেন, তার একটা উত্তর জনগণ প্রত্যাশা করে। আবুল হোসেনের মতো অপ্রিয় মন্ত্রীকে আঁকড়ে থাকার রহস্যটা কোথায়, তা দেশ-বিদেশে অনেকের কাছে গবেষণার বিষয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যর্থ ফারুক খানকে কেন এতটা দীর্ঘ সময় রাখা হলো এবং সামিট গ্রুপকে কেন বেশির ভাগ কুইক রেন্টালের কাজ দেওয়া হলো, সেটা জনগণের মনের প্রশ্ন। এসব বিষয়ে কথা বলায় মিডিয়ার ওপর সরকার কেন খৰহস্ত এবং অসহিষ্ণু হলো সেটাও একটি যৌক্তিক জিজ্ঞাসা।
সম-অধিকার চর্চা, মানবমর্যাদা, আইনের শাসন, পরমতসহিষ্ণুতা এবং সার্বিক সহমর্মিতাই হলো গণতন্ত্রের মূল কথা। এ ক্ষেত্রে একক শাসন বা Authoritarian ব্যক্তিশাসনের কোনো স্থান নেই। এক অর্থে গণতন্ত্র অর্থ এমন যৌথ শাসন, যেখানে শাসিত শাসকের সমান মর্যাদা ভোগ করবে।
সরকার ও বিরোধী দল কেন গণতন্ত্রের ব্যাকরণ মানছে না, সেটা নানা কারণে বিশ্লেষণের বিষয়। অথচ সরকার তো গণতন্ত্রের ঝাণ্ডা উড়িয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জিতে এসেছে। আর বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকতে সন্ত্রাসকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে হাওয়া ভবনকে ক্ষমতা ও দুর্নীতির লালকেল্লা বানিয়েছিল। এরপর আহসানউল্লাহ মাস্টার ও কিবরিয়া হত্যায় হাত পাকিয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে বিরোধী দলকে সমূলে বিনাশ করার চেষ্টা করে। এর আগে ২০০২ সালে নির্বাচনোত্তর সময়ে দেশকে তো সহিংসতার নরক বানানো হয়েছিল- জনগণ এসব ভোলেনি।
বর্তমান সরকারের অনেক ইতিবাচক অর্জন রয়েছে। সেই অর্জনের কথাগুলো গুছিয়ে বলতে হবে। অর্থনীতির হালটা শক্ত করে ধরতে হবে। সহনশীলতা ও ধীশক্তির সফল প্রয়োগ করতে হবে। চালবাজি দিয়ে যেমন সব চলে না, তেমনি শুধু কথায় চিঁড়ে ভেজে না। যে বিরোধী দল শূন্য থেকে উঠে এলো তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড যেমন গুছিয়ে বলার লোক নেই, তেমনি অপকর্মের দ্রুত বিচার বা প্রতিকারও দৃশ্যমান নয়। এর মধ্যে একের পর এক নষ্ট কাজে লিপ্ত হয়ে ভাবমূর্তিকে কেবল মসিলিপ্ত নয়, শুভ অর্জনগুলোও মলিন করছে সরকার নিজেই। এ যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল প্রয়োগ।
রুনি ও সাগর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডয়ের মতো গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নিলে সরকারের নাক কাটা যেত না। মিডিয়ার বিরোধিতার মুখে আবুল সাহেবকে সমর্থন না দিলে অনেক বন্ধু শত্রুরূপে অবতীর্ণ হতো না। ওবায়দুল কাদের, তোফায়েল সাহেব, মেনন সাহেব এবং মান্নাকে শুরুতেই কাজে লাগালে সরকারই উপকৃত হতো। একজন কর্মক্ষম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া যেত শুরুতেই। সেটা মেজর রফিক কিংবা জেনারেল সালাম হতে পারতেন। সোহেল তাজের প্রতি এবং প্রয়াত তাজউদ্দীনের প্রতি সুবিচার না করাটা জনগণ ভালো চোখে দেখেনি। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতো অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সাধারণ বোধ, বিবেচনা ও বুদ্ধিই যথেষ্ট। ইউনূস অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ল্যাসকির 'গ্রামার অব পলিটিকস'-এর পাঠ অপরিহার্য নয়।
রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এবং সার্বিক শৃঙ্খলা আনার জন্য প্রয়োজনীয় পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঠিক ব্যবহার নিদারুণভাবে অনুপস্থিত। অবকাঠামোগত দুর্বলতা তো রয়েছেই। কয়েক হাজার গাড়ির চালকের প্রশিক্ষণ, চলাচলের সময় লেন নিয়ন্ত্রণ, হাইওয়ে পুলিশের সঠিক ব্যবহার আহামরি কোনো কঠিন কাজ নয়। আজ পর্যন্ত হাইওয়ে পুলিশকে কার্যকর ও কর্মক্ষম অবস্থায় দেখা যায়নি। স্পিডগান ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার তো পরের কথা।
ব্যবসা-বাণিজ্যে দলবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্য পরিহার করতে না পারলে নখদন্তহীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিপালন যে লোকদেখানো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জনগণকে অংশীদার করে নিয়ে ভূমি দখল, নদী দখল রোধসহ, অফিস-আদালতে ব্যাপক দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং প্রশাসনিক নানা সংস্কার কার্যকর করা যেত। নিষ্ঠা ও সততাভিত্তিক কাজ করলে সেবা খাতেরও ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হতো। চটকদার কাজগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব স্তরে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র সুসংহত করা যেত। সদিচ্ছা থাকলে আইন করে সংসদকে অর্থবহ করা যেত। এতে বিরোধী দল জনগণের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা করে সংসদ সদস্য হিসেবে যেমন বহাল থাকতে পারত না, তেমনি অপরাধীর পক্ষ নিয়ে কোনো পক্ষেরই রাজনীতি করার সুযোগ থাকত না।
যারা যুগে যুগে ন্যায়ের কথা বলে অন্যায় কর্মে লিপ্ত হয়, জনগণকে জিম্মি করে অপরাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়, সমগ্র জাতিকে নেতিবাচক রাজনীতিতে আবদ্ধ রাখে, তাদের রুখতে জনগণ জেগে উঠবে- এটাই প্রত্যাশা। হত্যা, গুম ও অপরাজনীতিতে দেশ যখন লাতিন আমেরিকান দেশগুলোকে অনুসরণ করছে, তখন সর্বজনসম্মত একটি তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য। এটা হতে পারে বহু আলোচিত সেই নিরাপত্তা কাউন্সিল। এরাই নানা দলমতের মধ্যে সমন্বয় সাধনসহ নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য সমতল ক্ষেত্র নির্মাণ করবে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে হত্যা-গুমের রাজনীতি বিকশিত হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে। বাম ঘরানার মানুষগুলো নির্মূল করা থেকে এ কাজের শুরু। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। এখন তা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া বা অপ্রতিরোধ্য ভাইরাস হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। লুটেরা শক্তি ও সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এ সুযোগ গ্রহণ করছে এবং নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে। লুটেরা শক্তির নানা অপকর্মের বিষয় আড়াল করার জন্য নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ইলিয়াস আলী ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা গভীরভাবে ভাবার বিষয়। কার্যকারণ যা-ই হোক না কেন, Enforced Disappearance বা Involuntary Disappearance-এর বিষয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। এ বিষয়ে গুম হওয়া মানুষের পরিবারের মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন সমস্যার সমাধান বেগবান করার জন্য। এ ক্ষেত্রে দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে। আইন বা সার্বভৌমত্বের কথা বলে মানবতাবিরোধী অপরাধ আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি
No comments