এ কে চ্যাটার্জি-পশ্চিমবঙ্গ : সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা
পশ্চিমবঙ্গের ১৪তম সংসদ নির্বাচন শুরু হয়েছে ১৭ এপ্রিল। অনুষ্ঠিত হবে পাঁচ দফায়। পশ্চিমবঙ্গে ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত অন্য সব নির্বাচন থেকে এ নির্বাচন ভিন্নতর। লোকসভা ও রাজ্যসভার যেকোনো নির্বাচন থেকেই এটি আলাদা। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নির্বাচন সরাসরি এবং সর্বময় নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে,
যেখানে রাজ্য সরকারের ভূমিকা হবে নীরব দর্শকের মতো। কোন কারণে এবং কিভাবে এই পরিবর্তন ঘটল? আমার আগের লেখায় বর্ণনা করেছিলাম, চবি্বশ পরগনার জেলা প্রশাসন কিভাবে ১৯৭৭ সালে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর। ১৯৭৭ সালের সেই অ্যাসেম্বলি নির্বাচন ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। কিছু সৎ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তার কারণে সেই নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছিল। এমনকি সরকার পরিবর্তিত হওয়ার পরও কোনো পক্ষ থেকে পক্ষপাতমূলক আচরণের কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
এই ৩০ বছরে কী হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে? বিহারের কথাই ধরা যাক। সেখানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোকে গণতন্ত্রের নামে প্রহসন বলে মনে করলেও ভুল হবে না। আমি আমার আগের লেখায় জানিয়েছিলাম, গত ৩০ বছরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে মূলত চারটি ত্রুটি কিংবা অস্বাভাবিক অবস্থা ছিল। প্রথমত, এই নির্বাচনগুলোতে বিপুলসংখ্যক ভোটার ছিল ভুয়া। আর প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় প্রকৃত ভোটারের অনেকেই তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। রাজ্যে ভুয়া ভোটারের সংখ্যা যদি গণনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, এর সংখ্যা কমপক্ষে এক কোটি হবে, যা রাজ্যের মোট ভোটারের ২০ শতাংশ। এই ভুয়া ভোটাররা শাসক দলের হয়ে কাজ করেছে এবং তারাই নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। আমি আরো উল্লেখ করেছিলাম, নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে ঠাসাঠাসি বুথ দেওয়াও নির্বাচনের নেতিবাচক একটি দিক বলে গণ্য হয়েছে। শাসক দলের ক্যাডারদের সেখানে প্রভাব খাটাতে দেখা গেছে। কোনো কোনো নির্বাচন কেন্দ্রে বিরোধী পক্ষের নির্বাচনী এজেন্টদেরও থাকতে দেওয়া হয়নি। ফলে কোনো দুর্নীতি কিংবা অনাচার হলেও এর প্রতিবাদ করার মতো কেউ ছিল না।
অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীরা, এর মধ্যে পুলিশও রয়েছে, তারা কিন্তু বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। তাদের বিষয়ও আলোচনায় আসতে পারে। তাদের কর্মকর্তারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেও নিরপেক্ষ আচরণ প্রত্যাশা করা ভুল ছিল। তাদের কারণেই কোথাও কোথাও হয়তো নির্বাচন কেন্দ্র দখল হয়ে গেছে কিংবা কোথাও কোথাও হয়তো জাল ভোট দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় কোনো নির্বাচনকর্মী ওপরে রিপোর্ট করেনি। নিজেরাও এসব দেখে না দেখার ভান করেছে। এই যে নির্বাচনী দুরবস্থা তা কিন্তু গত পাঁচ দশকে শুধু বেড়েই গেছে। ১৯৭৭ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫৮ থেকে সর্বোচ্চ ৬৯ শতাংশ। কিন্তু ১৯৭৭ সালের পর থেকে এই হার বেড়ে গিয়ে ৮০.৬৪ শতাংশ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। সর্বোচ্চ হার দেখা গেছে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে। ২০০৪ সালের নির্বাচনে লক্ষণীয় কিছু দিক আছে। পার্লামেন্টারি নির্বাচনে হঠাৎ বুথের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত ভোটারের উপস্থিতি এ সময় দেখা যায়। ৪৫২টি বুথে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া ৯৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। কংগ্রেস ১১টি বুথে ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আটটি বুথে তৃণমূল কংগ্রেস ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। পাঁচ হাজার ২৬৯টি বুথে সিপিএম ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের ধন্যবাদ না জানিয়ে পারা যায় না। কারণ গণতান্ত্রিক দুনিয়ার কোনো দেশেই এত বেশি সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে যায় না।
২০০৪ সালের পার্লামেন্টারি নির্বাচনকালে আরামবাগ নির্বাচনী এলাকা আমার দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন এবং বিএম মোদকের মধ্যে নির্বাচনী লড়াই হয়েছিল। ৪১ হাজার ভোটের ব্যবধানে সেন সে সময় পরাজিত হয়েছিলেন। আমি নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি। তবে কোথাও বড় ধরনের কোনো অনিয়ম হয়েছে_এমন অভিযোগ পাইনি। আর আমাকে অবাক করে দিয়েছিল ২০০৪ সালের নির্বাচন। কারণ একই নির্বাচনী এলাকা থেকে অনীল বসু ছয় লাখ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। এই অবস্থা দেখার পর কি আমরা বলতে পারি, আমাদের এলাকায় নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে? তারা কি সত্যিই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পেরেছে? নির্বাচন কমিশন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য একজন করে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছিল। পুলিশ কোনো বুথের কাছে আসতে পারেনি। তাদের কাজ ছিল শুধু ভোটারদের লাইন ঠিক রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এদিকে নির্বাচন কমিশন মাত্র ১১ লাখ ভোটারকে ভুয়া বলে চিহ্নিত করে তাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে পেরেছে। এই প্রক্রিয়া বাকুড়া, মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ায় নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। ১৪তম অ্যাসেম্বলি নির্বাচনটি আসলে একটি পরীক্ষামূলক নির্বাচন বলে গণ্য হতে পারে। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই মানুষ নির্বাচন কমিশনকে যাচাই করে নিতে পারবে। তারা বুঝতে পারবে আদৌ এখানে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে কি না।
লেখক : ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক। দ্য টেলিগ্রাফ থেকে
ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
এই ৩০ বছরে কী হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে? বিহারের কথাই ধরা যাক। সেখানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোকে গণতন্ত্রের নামে প্রহসন বলে মনে করলেও ভুল হবে না। আমি আমার আগের লেখায় জানিয়েছিলাম, গত ৩০ বছরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে মূলত চারটি ত্রুটি কিংবা অস্বাভাবিক অবস্থা ছিল। প্রথমত, এই নির্বাচনগুলোতে বিপুলসংখ্যক ভোটার ছিল ভুয়া। আর প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় প্রকৃত ভোটারের অনেকেই তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। রাজ্যে ভুয়া ভোটারের সংখ্যা যদি গণনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, এর সংখ্যা কমপক্ষে এক কোটি হবে, যা রাজ্যের মোট ভোটারের ২০ শতাংশ। এই ভুয়া ভোটাররা শাসক দলের হয়ে কাজ করেছে এবং তারাই নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। আমি আরো উল্লেখ করেছিলাম, নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে ঠাসাঠাসি বুথ দেওয়াও নির্বাচনের নেতিবাচক একটি দিক বলে গণ্য হয়েছে। শাসক দলের ক্যাডারদের সেখানে প্রভাব খাটাতে দেখা গেছে। কোনো কোনো নির্বাচন কেন্দ্রে বিরোধী পক্ষের নির্বাচনী এজেন্টদেরও থাকতে দেওয়া হয়নি। ফলে কোনো দুর্নীতি কিংবা অনাচার হলেও এর প্রতিবাদ করার মতো কেউ ছিল না।
অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীরা, এর মধ্যে পুলিশও রয়েছে, তারা কিন্তু বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। তাদের বিষয়ও আলোচনায় আসতে পারে। তাদের কর্মকর্তারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেও নিরপেক্ষ আচরণ প্রত্যাশা করা ভুল ছিল। তাদের কারণেই কোথাও কোথাও হয়তো নির্বাচন কেন্দ্র দখল হয়ে গেছে কিংবা কোথাও কোথাও হয়তো জাল ভোট দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় কোনো নির্বাচনকর্মী ওপরে রিপোর্ট করেনি। নিজেরাও এসব দেখে না দেখার ভান করেছে। এই যে নির্বাচনী দুরবস্থা তা কিন্তু গত পাঁচ দশকে শুধু বেড়েই গেছে। ১৯৭৭ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫৮ থেকে সর্বোচ্চ ৬৯ শতাংশ। কিন্তু ১৯৭৭ সালের পর থেকে এই হার বেড়ে গিয়ে ৮০.৬৪ শতাংশ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। সর্বোচ্চ হার দেখা গেছে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে। ২০০৪ সালের নির্বাচনে লক্ষণীয় কিছু দিক আছে। পার্লামেন্টারি নির্বাচনে হঠাৎ বুথের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত ভোটারের উপস্থিতি এ সময় দেখা যায়। ৪৫২টি বুথে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া ৯৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। কংগ্রেস ১১টি বুথে ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আটটি বুথে তৃণমূল কংগ্রেস ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। পাঁচ হাজার ২৬৯টি বুথে সিপিএম ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের ধন্যবাদ না জানিয়ে পারা যায় না। কারণ গণতান্ত্রিক দুনিয়ার কোনো দেশেই এত বেশি সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে যায় না।
২০০৪ সালের পার্লামেন্টারি নির্বাচনকালে আরামবাগ নির্বাচনী এলাকা আমার দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন এবং বিএম মোদকের মধ্যে নির্বাচনী লড়াই হয়েছিল। ৪১ হাজার ভোটের ব্যবধানে সেন সে সময় পরাজিত হয়েছিলেন। আমি নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি। তবে কোথাও বড় ধরনের কোনো অনিয়ম হয়েছে_এমন অভিযোগ পাইনি। আর আমাকে অবাক করে দিয়েছিল ২০০৪ সালের নির্বাচন। কারণ একই নির্বাচনী এলাকা থেকে অনীল বসু ছয় লাখ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। এই অবস্থা দেখার পর কি আমরা বলতে পারি, আমাদের এলাকায় নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে? তারা কি সত্যিই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পেরেছে? নির্বাচন কমিশন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য একজন করে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছিল। পুলিশ কোনো বুথের কাছে আসতে পারেনি। তাদের কাজ ছিল শুধু ভোটারদের লাইন ঠিক রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এদিকে নির্বাচন কমিশন মাত্র ১১ লাখ ভোটারকে ভুয়া বলে চিহ্নিত করে তাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে পেরেছে। এই প্রক্রিয়া বাকুড়া, মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ায় নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। ১৪তম অ্যাসেম্বলি নির্বাচনটি আসলে একটি পরীক্ষামূলক নির্বাচন বলে গণ্য হতে পারে। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই মানুষ নির্বাচন কমিশনকে যাচাই করে নিতে পারবে। তারা বুঝতে পারবে আদৌ এখানে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে কি না।
লেখক : ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক। দ্য টেলিগ্রাফ থেকে
ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
No comments