স্মৃতিভারে পড়ে আছি by দ্বিজেন শর্মা
শুনেছি, ক্রুদ্ধ পিতৃদেব তাঁর সর্বগুণান্বিত অতিসজ্জন ভ্রাতুষ্পুত্রের অকালমৃত্যুতে কুলদেবতা শিবঠাকুরের শিলামূর্তি গোময়গর্তে নিক্ষেপ করে ঈশ্বরের অবিচারের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সহজবোধ্য কারণেই অভিন্ন গুণধর অনুজতুল্য গোলাম মহিউদ্দিনের মৃত্যুর জন্য
আমি কোনো দেবতাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারি না, বরং ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হতে পারি বিজ্ঞানের ওপর_যা আজও ক্যান্সারের মতো একটি প্রাচীন ব্যাধির নির্ভরযোগ্য নিরাময় আবিষ্কার করতে পারেনি। ১৮ এপ্রিল, ২০০৪ এই ব্যাধি তাঁকে আমাদের মাঝ থেকে কেড়ে নেয়। দেখতে দেখতেই চলে গেল ছয়টি বছর।
মানব সম্পর্কের ব্যাপারে আত্মীয়তার বদলে আমি বন্ধুত্বে বিশ্বাসী আর বন্ধুত্ব অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ার মতোই এক রহস্য। প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই মহিউদ্দিন (১৯৪৮-২০০৪) অনুক্ষণ আমার মনোসঙ্গী। যদিও তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে কম, একসঙ্গে কাজও করিনি কোনো দিন। পরিচয় তাঁর সহধর্মিণী এ এন রাশেদার মাধ্যমে, যিনি নটর ডেম কলেজে তখন উদ্ভিদবিদ্যা পড়াতেন; যেখানে আমি কর্মরত ছিলাম অনেক বছর। রাশেদা অক্লান্তকর্মী। অধ্যাপনার দায়দায়িত্ব পালন করেও 'শিক্ষাবার্তা' নামের একটি মাসিক পত্রিকা চালান। বইপত্র প্রকাশ করেন, লেখালেখিও বাদ পড়ে না; যাকে অসাধ্য সাধন বললে কমই বলা হয়। আর মহিউদ্দিন খাদ্য বিভাগের উচ্চপদ ছেড়ে যোগ দেন বুয়েটে শিক্ষকতায়, বিদেশে বৃত্তিলাভের বয়স অতিক্রান্ত হওয়ায় স্বদেশেই ডক্টরেট করেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রকৌশলীদের নানা সংস্থায় এবং সেই সঙ্গে লিখেছেন নিজ বিষয়বহির্ভূত নানা নিবন্ধ ও বইপত্র। তার ওপর ছিল সংসারধর্ম পালন, সন্তান লালন, বন্ধুবান্ধব আপ্যায়ন। তাই মহিউদ্দিন-রাশেদার মিলনকে মণিকাঞ্চনযোগ ছাড়া আর কী-ই বা বলা চলে!
আমাদের দেশে জনকল্যাণব্রতী বা আপন কর্মপরিধির বাইরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানকর্মীর সিংহভাগই কেন মার্কসবাদী_এই প্রসঙ্গ আমাকে দ্বন্দ্বে ফেলে। এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, ড. আ. মু. জহুরুল হককেও বহিঃস্থ ভাবতে পারি না। এটা কি মার্কসবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের নিবিড় সম্পৃক্ততা ও সেইসঙ্গে তার মানবমুক্তির যুক্তিগ্রাহ্য কর্মসূচির ফল? মহিউদ্দিন কিভাবে মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন, তা জানার আমার সুযোগ ঘটেনি। অনুমান করি, অন্যদের মতো তিনিও ছাত্রজীবনে মার্কসবাদকে মানবকল্যাণের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী হয়ে উঠলে তাঁর মনে পাকাপোক্ত আসন গেড়েছিল আর সেটা তাঁর লেখা 'বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশি-বিদেশি থাবা', 'গ্যাস রপ্তানিতে প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট ও বিশ্বায়ন' এবং 'শিক্ষা ও প্রতিবছর বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ' বিষয়ক প্রবন্ধাবলিতে সুস্পষ্ট। মহিউদ্দিনকে ছাত্র হিসেবে পাওয়ার একটি অপূর্ণ বাসনা আমাকে মাঝেমধ্যে আলোড়িত করত এবং তা তিনি চৌকস ও করিৎকর্মা বলে নয়, একজন অসাধারণ ভালো মানুষ বলেই। আমি তাঁকে অল্পই দেখেছি, কিন্তু আমার ধারণা যে অভ্রান্ত সেই প্রমাণ মেলে তাঁর শিক্ষক ও বন্ধুদের লেখায় যাঁরা তাঁকে দীর্ঘদিন নানাভাবে, নানা পরিবেশে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না এমনটি একদিনও ঘটেনি, যখন মহিউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং তিনি তাঁর ছোট্ট গাড়িতে আমাকে বাড়ি পেঁৗছে দেননি। একাধারে নিরহংকার, পরম পরোপকারী, নিঃস্বার্থ এবং সেই সঙ্গে মেধাবী ও শ্রমিষ্ঠ এমন একজন বহুমাত্রিক মানুষ যেকোনো দেশের ও সমাজের এক বড় সম্পদ।
কিন্তু মহিউদ্দিনকে কি আমরা মনে রাখব? বিস্মৃতির যে নজির এ দেশে সৃষ্টি হয়েছে তাতে ইতিবাচক উত্তর মেলা কঠিন। এ ক্ষেত্রে আমার একটি স্বতন্ত্র ভাবনা আছে_দেশ-কাল নির্বিশেষে সব সুকৃতিই জাতির যৌথ স্মৃতির ছাঁকনিতে মণিখণ্ডের মতো ধৃত থাকে, চুইয়ে হারিয়ে যায় যাবতীয় মিথ্যা-আবর্জনা। তবে হ্যাঁ, খুশির খবর হলো_এ বছর মহিউদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে 'অধ্যাপক গোলাম মহিউদ্দিন স্মৃতি ফাউন্ডেশন' গঠন করা হয়েছে; লাইব্রেরি গড়ে তোলাসহ নানা কর্মকাণ্ড এবং মহিউদ্দিনের আদর্শের পথ ধরে চলা সাথিদের মাঝে প্রয়োজন বিবেচনায় তিনজনকে প্রতিমাসে 'স্মৃতি-বৃত্তি' দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মহিউদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার প্রজন্মের প্রিয় চিন্তক ঔপন্যাসিক রমাঁ রঁলার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি, যাতে অংশত হলেও আমার প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে।
'আপনি আমার দেশের একজন খাঁটি মানুষও দেখেননি। ভ্রষ্ট-আরামসর্বস্ব কিছু লোক, রাজনৈতিক ধুরন্ধর, সমাজের ওপর ভাসমান উপকণ্ঠ শ্রেণীবিশেষ, সুফলা মাঠের ঐশ্বর্যে প্রলুব্ধ পঙ্গপাল-ভিমরুলের দল আমার জাতির প্রতিনিধি নয়। আর আমাদের সাহিত্যিক? বিজ্ঞানের এ যুগে সাহিত্য তো চিন্তাকে ঘুম পাড়ানোর শয্যা। আর থিয়েটার? এ তো এক আন্তর্জাতিক হেঁসেল, ধনীদের জন্য ফরমায়েশি রান্না পরিবেশন যার লক্ষ্য। আমাদের মেহনতি মানুষের ওখানে প্রবেশাধিকার নেই। আমাদের জীবনে থিয়েটারের ভূমিকা নগণ্য। জানেন, লুই পাস্তুর সারা জীবনে ১০ বারও থিয়েটার দেখেননি। যেকোনো বিদেশির মতো আপনিও আমাদের উপন্যাস, নাটক, রাজনীতি সম্পর্কে অত্যুৎসাহী। ইচ্ছা হলে আপনি এমন সব নর-নারীর সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন, যাঁরা আমাদের দেশের ভাবমূর্তির প্রতীক অথচ কেউই গোটা জীবনে একখানা উপন্যাস পড়েননি। কোনো দিন থিয়েটারে যাননি কিংবা রাজনীতি নিয়েও মাথা ঘামাননি। আপনি আমাদের বিজ্ঞানী ও তরুণ কবিদের দেখেননি, দেখেননি আমাদের নিঃসঙ্গ নীরব শিল্পীদের, আমাদের বিপ্লবের অনির্বাণ শিখাকে। আমাদের মহৎ নাস্তিক কিংবা খাঁটি কোনো ধার্মিকের সঙ্গেও আপনার সাক্ষাৎ ঘটেনি। এখানে যে দরিদ্র মহিলাটি আপনার সেবা করেন তাঁর সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? নিচতলার অন্ধকারে আমাদের জনতার যে অংশ প্রচ্ছন্ন, তাদের কখনো দেখেছেন? তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় না জানলে এ দেশ দেখা সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। আমাদের শহরের অলিগলি দূরতর গ্রামাঞ্চলে স্বল্পসংখ্যক যেসব দুঃসাহসী নর-নারী আছেন তাঁদের সম্পর্কেও আপনি কিছুই জানেন না। তাঁদের জীবন অবশ্যই বর্ণাঢ্য নয়, তাঁরা দুশ্চিন্তাজর্জর ও বিমর্ষ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, তাঁরা অবসাদগ্রস্ত নিস্তেজ নিষ্প্রাণ, কিন্তু আসলে তাঁদের সুপ্ত প্রাণশক্তি অপরিসীম। এই নীরব অসীম সহনশীল জনগোষ্ঠী প্রতিটি সংকটকালে যখন অবক্ষয়ে উবে যায়, তখন আমরা এদের মধ্যে থেকে প্রাণশক্তি আহরণ করে বেঁচে উঠি। অথচ এ দেশে এমন লোক আছেন, যাঁরা কেবল সুখের জন্য কিংবা যেকোনো মূল্যে সুখ আহরণের জন্য বেঁচে থাকেন না, বাঁচেন একটি বিশ্বাসের জন্য। আমার চেয়ে সহস্রগুণ ধার্মিক ও বিনয়ী মানুষ এ দেশে আছেন, যাঁরা আমৃত্যু নিজ আদর্শে নীরবে অটল থাকেন। আমাদের মিতব্যয়ী, নিয়মনিষ্ঠ, পরিশ্রমী ও শান্ত মধ্যবিত্তদের সম্পর্কেও আপনি জ্ঞাত নন_যাঁরা হৃদয়ের গভীরে এক অনির্বাণ দীপশিখাকে যুগ যুগ ধরে প্রজ্বলিত রেখেছেন, যাঁরা দুর্দিনে আমার দেশকে স্বার্থপর ক্ষমতালোভীদের গ্রাস থেকে বারবার রক্ষা করেছেন। আত্মশক্তিতে প্রোজ্জ্বল, সূর্যের মতো দীপ্তিমান আমার এমন কোনো স্বদেশবাসীকে কি আপনি কখনো দেখেছেন, যাঁর বিকীর্ণ আভায় সব হীনতা, সব ভণ্ডামি নিমিষে বিলীন হয়? আপনি শুধু আমাদের জীবনসত্তার ছায়াটুকু দেখছেন, তার আত্মার অবয়ব প্রত্যক্ষ করেননি। আমরা হাজার হাজার বছর ধরে কর্ম ও সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে আছি।'
লেখক : নিসর্গী ও শিক্ষাবিদ
মানব সম্পর্কের ব্যাপারে আত্মীয়তার বদলে আমি বন্ধুত্বে বিশ্বাসী আর বন্ধুত্ব অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ার মতোই এক রহস্য। প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই মহিউদ্দিন (১৯৪৮-২০০৪) অনুক্ষণ আমার মনোসঙ্গী। যদিও তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে কম, একসঙ্গে কাজও করিনি কোনো দিন। পরিচয় তাঁর সহধর্মিণী এ এন রাশেদার মাধ্যমে, যিনি নটর ডেম কলেজে তখন উদ্ভিদবিদ্যা পড়াতেন; যেখানে আমি কর্মরত ছিলাম অনেক বছর। রাশেদা অক্লান্তকর্মী। অধ্যাপনার দায়দায়িত্ব পালন করেও 'শিক্ষাবার্তা' নামের একটি মাসিক পত্রিকা চালান। বইপত্র প্রকাশ করেন, লেখালেখিও বাদ পড়ে না; যাকে অসাধ্য সাধন বললে কমই বলা হয়। আর মহিউদ্দিন খাদ্য বিভাগের উচ্চপদ ছেড়ে যোগ দেন বুয়েটে শিক্ষকতায়, বিদেশে বৃত্তিলাভের বয়স অতিক্রান্ত হওয়ায় স্বদেশেই ডক্টরেট করেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রকৌশলীদের নানা সংস্থায় এবং সেই সঙ্গে লিখেছেন নিজ বিষয়বহির্ভূত নানা নিবন্ধ ও বইপত্র। তার ওপর ছিল সংসারধর্ম পালন, সন্তান লালন, বন্ধুবান্ধব আপ্যায়ন। তাই মহিউদ্দিন-রাশেদার মিলনকে মণিকাঞ্চনযোগ ছাড়া আর কী-ই বা বলা চলে!
আমাদের দেশে জনকল্যাণব্রতী বা আপন কর্মপরিধির বাইরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানকর্মীর সিংহভাগই কেন মার্কসবাদী_এই প্রসঙ্গ আমাকে দ্বন্দ্বে ফেলে। এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, ড. আ. মু. জহুরুল হককেও বহিঃস্থ ভাবতে পারি না। এটা কি মার্কসবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের নিবিড় সম্পৃক্ততা ও সেইসঙ্গে তার মানবমুক্তির যুক্তিগ্রাহ্য কর্মসূচির ফল? মহিউদ্দিন কিভাবে মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন, তা জানার আমার সুযোগ ঘটেনি। অনুমান করি, অন্যদের মতো তিনিও ছাত্রজীবনে মার্কসবাদকে মানবকল্যাণের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী হয়ে উঠলে তাঁর মনে পাকাপোক্ত আসন গেড়েছিল আর সেটা তাঁর লেখা 'বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশি-বিদেশি থাবা', 'গ্যাস রপ্তানিতে প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট ও বিশ্বায়ন' এবং 'শিক্ষা ও প্রতিবছর বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ' বিষয়ক প্রবন্ধাবলিতে সুস্পষ্ট। মহিউদ্দিনকে ছাত্র হিসেবে পাওয়ার একটি অপূর্ণ বাসনা আমাকে মাঝেমধ্যে আলোড়িত করত এবং তা তিনি চৌকস ও করিৎকর্মা বলে নয়, একজন অসাধারণ ভালো মানুষ বলেই। আমি তাঁকে অল্পই দেখেছি, কিন্তু আমার ধারণা যে অভ্রান্ত সেই প্রমাণ মেলে তাঁর শিক্ষক ও বন্ধুদের লেখায় যাঁরা তাঁকে দীর্ঘদিন নানাভাবে, নানা পরিবেশে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না এমনটি একদিনও ঘটেনি, যখন মহিউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং তিনি তাঁর ছোট্ট গাড়িতে আমাকে বাড়ি পেঁৗছে দেননি। একাধারে নিরহংকার, পরম পরোপকারী, নিঃস্বার্থ এবং সেই সঙ্গে মেধাবী ও শ্রমিষ্ঠ এমন একজন বহুমাত্রিক মানুষ যেকোনো দেশের ও সমাজের এক বড় সম্পদ।
কিন্তু মহিউদ্দিনকে কি আমরা মনে রাখব? বিস্মৃতির যে নজির এ দেশে সৃষ্টি হয়েছে তাতে ইতিবাচক উত্তর মেলা কঠিন। এ ক্ষেত্রে আমার একটি স্বতন্ত্র ভাবনা আছে_দেশ-কাল নির্বিশেষে সব সুকৃতিই জাতির যৌথ স্মৃতির ছাঁকনিতে মণিখণ্ডের মতো ধৃত থাকে, চুইয়ে হারিয়ে যায় যাবতীয় মিথ্যা-আবর্জনা। তবে হ্যাঁ, খুশির খবর হলো_এ বছর মহিউদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে 'অধ্যাপক গোলাম মহিউদ্দিন স্মৃতি ফাউন্ডেশন' গঠন করা হয়েছে; লাইব্রেরি গড়ে তোলাসহ নানা কর্মকাণ্ড এবং মহিউদ্দিনের আদর্শের পথ ধরে চলা সাথিদের মাঝে প্রয়োজন বিবেচনায় তিনজনকে প্রতিমাসে 'স্মৃতি-বৃত্তি' দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মহিউদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার প্রজন্মের প্রিয় চিন্তক ঔপন্যাসিক রমাঁ রঁলার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি, যাতে অংশত হলেও আমার প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে।
'আপনি আমার দেশের একজন খাঁটি মানুষও দেখেননি। ভ্রষ্ট-আরামসর্বস্ব কিছু লোক, রাজনৈতিক ধুরন্ধর, সমাজের ওপর ভাসমান উপকণ্ঠ শ্রেণীবিশেষ, সুফলা মাঠের ঐশ্বর্যে প্রলুব্ধ পঙ্গপাল-ভিমরুলের দল আমার জাতির প্রতিনিধি নয়। আর আমাদের সাহিত্যিক? বিজ্ঞানের এ যুগে সাহিত্য তো চিন্তাকে ঘুম পাড়ানোর শয্যা। আর থিয়েটার? এ তো এক আন্তর্জাতিক হেঁসেল, ধনীদের জন্য ফরমায়েশি রান্না পরিবেশন যার লক্ষ্য। আমাদের মেহনতি মানুষের ওখানে প্রবেশাধিকার নেই। আমাদের জীবনে থিয়েটারের ভূমিকা নগণ্য। জানেন, লুই পাস্তুর সারা জীবনে ১০ বারও থিয়েটার দেখেননি। যেকোনো বিদেশির মতো আপনিও আমাদের উপন্যাস, নাটক, রাজনীতি সম্পর্কে অত্যুৎসাহী। ইচ্ছা হলে আপনি এমন সব নর-নারীর সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন, যাঁরা আমাদের দেশের ভাবমূর্তির প্রতীক অথচ কেউই গোটা জীবনে একখানা উপন্যাস পড়েননি। কোনো দিন থিয়েটারে যাননি কিংবা রাজনীতি নিয়েও মাথা ঘামাননি। আপনি আমাদের বিজ্ঞানী ও তরুণ কবিদের দেখেননি, দেখেননি আমাদের নিঃসঙ্গ নীরব শিল্পীদের, আমাদের বিপ্লবের অনির্বাণ শিখাকে। আমাদের মহৎ নাস্তিক কিংবা খাঁটি কোনো ধার্মিকের সঙ্গেও আপনার সাক্ষাৎ ঘটেনি। এখানে যে দরিদ্র মহিলাটি আপনার সেবা করেন তাঁর সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? নিচতলার অন্ধকারে আমাদের জনতার যে অংশ প্রচ্ছন্ন, তাদের কখনো দেখেছেন? তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় না জানলে এ দেশ দেখা সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। আমাদের শহরের অলিগলি দূরতর গ্রামাঞ্চলে স্বল্পসংখ্যক যেসব দুঃসাহসী নর-নারী আছেন তাঁদের সম্পর্কেও আপনি কিছুই জানেন না। তাঁদের জীবন অবশ্যই বর্ণাঢ্য নয়, তাঁরা দুশ্চিন্তাজর্জর ও বিমর্ষ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, তাঁরা অবসাদগ্রস্ত নিস্তেজ নিষ্প্রাণ, কিন্তু আসলে তাঁদের সুপ্ত প্রাণশক্তি অপরিসীম। এই নীরব অসীম সহনশীল জনগোষ্ঠী প্রতিটি সংকটকালে যখন অবক্ষয়ে উবে যায়, তখন আমরা এদের মধ্যে থেকে প্রাণশক্তি আহরণ করে বেঁচে উঠি। অথচ এ দেশে এমন লোক আছেন, যাঁরা কেবল সুখের জন্য কিংবা যেকোনো মূল্যে সুখ আহরণের জন্য বেঁচে থাকেন না, বাঁচেন একটি বিশ্বাসের জন্য। আমার চেয়ে সহস্রগুণ ধার্মিক ও বিনয়ী মানুষ এ দেশে আছেন, যাঁরা আমৃত্যু নিজ আদর্শে নীরবে অটল থাকেন। আমাদের মিতব্যয়ী, নিয়মনিষ্ঠ, পরিশ্রমী ও শান্ত মধ্যবিত্তদের সম্পর্কেও আপনি জ্ঞাত নন_যাঁরা হৃদয়ের গভীরে এক অনির্বাণ দীপশিখাকে যুগ যুগ ধরে প্রজ্বলিত রেখেছেন, যাঁরা দুর্দিনে আমার দেশকে স্বার্থপর ক্ষমতালোভীদের গ্রাস থেকে বারবার রক্ষা করেছেন। আত্মশক্তিতে প্রোজ্জ্বল, সূর্যের মতো দীপ্তিমান আমার এমন কোনো স্বদেশবাসীকে কি আপনি কখনো দেখেছেন, যাঁর বিকীর্ণ আভায় সব হীনতা, সব ভণ্ডামি নিমিষে বিলীন হয়? আপনি শুধু আমাদের জীবনসত্তার ছায়াটুকু দেখছেন, তার আত্মার অবয়ব প্রত্যক্ষ করেননি। আমরা হাজার হাজার বছর ধরে কর্ম ও সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে আছি।'
লেখক : নিসর্গী ও শিক্ষাবিদ
No comments