বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন হাইকোর্ট by আশরাফ-উল-আলম

একটি মামলায় এখতিয়ারবহির্ভূত আদেশ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ঢাকার একটি আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে। তাঁর এই আদেশ পর্যালোচনা করে হাইকোর্টও বলেছেন, সংশ্লিষ্ট ওই বিচারকের এ ধরনের আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার নেই।


'গত বছর ১১ আগস্ট হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম জেলা জজ মোহাম্মদ শরীফ হোসেন হায়দারের এখতিয়ারবহির্ভূত আদেশের বিষয়টি খতিয়ে দেখে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয় ও ঢাকার জেলা জজকে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে বিষয়টি সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।'
ঢাকার আদালত সূত্রে জানা গেছে, উচ্চ আদালতের এমন একটি আদেশ হওয়ার পরও ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম জেলা জজ মোহাম্মদ শরীফ হোসেন হায়দার এখনো বহালতবিয়তে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হাইকোর্ট আদেশে এও বলেছেন, বিচারক মোহাম্মদ শরীফ হোসেন অন্য মামলায়ও একই ধরনের আদেশ দেন কি না, তাঁর মূল্যায়ন করতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে। বিচারিক কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর কর্মদক্ষতা কেমন, তাও যাচাই করে দেখতে হবে। মামলার বিবরণে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে অবস্থিত মেসার্স কম্বাইন্ড ফুড কোল্ড স্টোরেজ লিমিডেট একটি প্রাইভেট কম্পানি। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার আমিনুল ইসলাম টুকু, চেয়ারম্যান মো. রেজাউল ইসলাম ও পরিচালক মুক্তা বেগম। এই কম্পানিটি একটি আধুনিক হিমাগার প্রতিষ্ঠার জন্য সোনালী ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা চায়। ১৯৯৭ সালের ১৩ আগস্ট সোনালী ব্যাংক মেসার্স কম্বাইন্ড ফুড কোল্ড স্টোরেজ লিমিডেট কম্পানির অনুকূলে তিন কোটি ৯৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা প্রকল্প ঋণ মঞ্জুর করেন। কম্পানিটি ওই পরিমাণ ঋণ গ্রহণও করে। ওই ঋণের জামানতস্বরূপ হিমাগার ও হিমাগারের প্রকল্প জমিসহ মোট ১ দশমিক ৫৭ একর সম্পত্তি সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে রেজিস্ট্রিমূলে বন্ধক রাখে। পরবর্তী সময়ে সোনালী ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন ঋণ নেয়। ওই ঋণ নিয়ে বেআইনি কাজ করার জন্য কম্পানির মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে মুন্সীগঞ্জে ফৌজদারি মামলাও করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এদিকে মূল ঋণ না দেওয়ায় মেসার্স কম্বাইন্ড ফুড কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড কম্পানির কাছে ব্যাংকের পাওনা হয় আট কোটি ২১ লাখ ১৯ হাজার ৭২০ টাকা। ওই টাকা ২০০৩ সাল পর্যন্ত মেসার্স কম্বাইন্ড ফুড কোল্ড স্টোরেজ লিমিডেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার আমিনুল ইসলাম টুকু, চেয়ারম্যান মো. রেজাউল ইসলাম ও পরিচালক মুক্তা বেগম পরিশোধ না করায় তা আদায়ের জন্য সোনালী ব্যাংক বাদী হয়ে ঢাকার অর্থঋণ আদালত-১-এ অর্থঋণ মামলা দায়ের করে (মামলা নং ৩১০/২০০৩)। দীর্ঘদিন শুনানি শেষে অর্থঋণ আদালত ২০০৫ সালের ২১ এপ্রিল ওই মামলার রায় দেন। রায়ে কম্পানিকে সোনালী ব্যাংকের দাবিকৃত টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেন। কিন্তু ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করায় ব্যাংক ২০০৫ সালেই একই আদালতে অর্থজারি মামলা দায়ের করে (মামলা নং ৫৭৪/২০০৫)। এই অর্থজারি মামলার শুনানিশেষে আদালত ব্যাংকের টাকা আদায়ের জন্য কম্পানির বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির জন্য তা দুবার নিলামে বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দেন। কিন্তু নিলামে ওঠানোর পরও সম্পত্তি বিক্রি করতে না পারায় অর্থঋণ আদালত আইনের ৩৩(৫) ধারামতে কম্পানির বন্ধকী সম্পত্তি ভোগ-দখল ও বিক্রির ক্ষমতা দিয়ে সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে সনদপত্র ইস্যু করেন আদালত। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষও সম্পত্তি বিক্রিতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে মেসার্স কম্বাইন্ড ফুড কোল্ড স্টোরেজ লিমিডেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার আমিনুল ইসলাম টুকু, চেয়ারম্যান মো. রেজাউল ইসলাম ও পরিচালক মুক্তা বেগমের বিরুদ্ধে আবারও অর্থজারি মামলা করে সোনালী ব্যাংক। এটি দ্বিতীয় অর্থজারি মামলা নামে পরিচিত (মামলা নং ৯৯/২০১০)। এই মামলায় কম্পানির মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এদিকে কম্পানির তিন মালিক চতুরতার আশ্রয় নিয়ে ভূমিসহ কোল্ডস্টোরেজের মালিকানা শওকত হোসেন নামে তৃতীয় এক ব্যক্তিকে দিয়ে দেন।
এই শওকত হোসেন কোল্ড স্টোরেজের মালিকানা দাবি করে ঢাকার পঞ্চম জেলা যুগ্ম জজ শরীফ হোসেন হায়দারের আদালতে দেওয়ানি মামলা (৩১/২০১১) করেন। মামলায় সোনালী ব্যাংককেও বিবাদী করা হয়। ওই মামলায় সোনালী ব্যাংক ভূমিসহ হিমাগারটি যাতে দখল করতে না পারে, সেই মর্মে নিষেধাজ্ঞা চান শওকত হোসেন। সোনালী ব্যাংক লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়ে নিষেধাজ্ঞা না দেওয়ার প্রার্থনা করেন। সংশ্লিষ্ট আইনের ব্যাখ্যাও দেন। কিন্তু যুগ্ম জেলা জজ শরীফ হোসেন হায়দার ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল সোনালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে নালিশি সম্পত্তি যাতে দখল বা বিক্রি করতে না পারে তার ওপর ছয় মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক হাইকোর্টে আপিল করলে বিচারপতি এম এ হাই ও বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান যুগ্ম জেলা জজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
হাইকোর্টের রায়ে পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হিমাগারটিসহ ওই ভূমি একটি বন্ধকী সম্পত্তি। ব্যাংকের কাছে ওই সম্পত্তি বন্ধক থাকায় এটি ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিক্রি করার এখতিয়ার বা আইনগত অধিকার মেসার্স কম্বাইন্ড ফুড কোল্ড স্টোরেজ লিমিডেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার আমিনুল ইসলাম টুকু, চেয়ারম্যান মো. রেজাউল ইসলাম ও পরিচালক মুক্তা বেগমের নেই। এঁরা তৃতীয় ব্যক্তি শওকত হোসেনের সঙ্গে যোগসাজশ করে সম্পত্তি হস্তান্তর দেখিয়ে তা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে।
হাইকোর্ট রায়ে আরো বলেছেন, অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী অর্থঋণ আদালত থেকে সনদ ইস্যু করা হলে ওই সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে ওই আদালত ছাড়া অন্য কোনো আদালতে মামলা করা যাবে না। কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তি শওকত হোসেন পঞ্চম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেছেন। আর যুগ্ম জেলা জজ সম্পূর্ণ এখতিয়ারবিহীন মামলাটি গ্রহণ করে ব্যাংকের অর্জিত বন্ধকী সম্পত্তির ওপর স্থিতাবস্থা জরি করেছেন।
হাইকোর্ট রায়ে বলেন, যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিচারক অর্থঋণ আদালত আইন, ১৯৯১ সালের ব্যাংক কম্পানি আইন ও ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন অনুসরণ না করেই আদেশ দিয়েছেন; যা শুধু বেআইনি নয়, আইন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আছে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ হয়। হাইকোর্টের এই রায়ের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, ঢাকার জেলা জজ ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের এমন নির্দেশ পাওয়ার আট মাস পরও পঞ্চম যুগ্ম জেলা জজের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে ঢাকা জেলা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) নুরুল আমিন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসা করলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, হাইকোর্টের এ ধরনের আদেশ সম্পর্কে তাঁর কিছু জানা নেই।
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো বিচারক সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেওয়ার পর তা পালন বাধ্যতামূলক। অবশ্যই আইন মন্ত্রণালয় ও ঢাকা জেলা জজকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, হাইকোর্ট কোনো বিচারকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে ও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বা তদন্ত করার নির্দেশ দিলে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে গড়িমসির কোনো সুযোগ নেই।
আইনজীবীরা মনে করেন, বিপুল অঙ্কের বিনিময়ে সোনালী ব্যাংকের বন্ধকি সম্পত্তির ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে কোনো আইনের তোয়াক্কাই করা হয়নি। ওই আদালতের বিচারক সম্পর্কে অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান বলেন, সেখানে অনৈতিকভাবে প্রভাবিত করতে না পারলে মামলা করা যায় না।
উল্লেখ্য, হাইকোর্টের এই রায়টি আইনবিষয়ক সাময়িকী ঢাকা ল রিপোর্টস-এর (ডিএলআর) জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। আইনজীবীরা বলেন, ডিএলআরের রিপোর্ট দেখে আইন মন্ত্রণালয়ও ব্যবস্থা নিতে পারত। আর একজন বিচারক সম্পর্কে এমন রায় প্রকাশিত হওয়ায় আইন আদালতের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.