মানুষ মানুষের জন্য by মতিউল হাসান
রাষ্ট্রদূত মাসুম আহমেদ চৌধুরী ১৮ মার্চ আমেরিকাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাকে কবরস্থ করা হয়। তার দোয়া মাহফিলে আমার শরিক হওয়ার সুযোগ হয়। সেখানে তার অনেক গুণগ্রাহীর বড় সমাবেশ হয়। তার একজন খুব কাছের বন্ধু বললেন, তার নামের সঙ্গে যুক্ত ছিল 'মাসুম', যার অর্থ_ নিরীহ, নিষ্পাপ।
আসলেই তিনি ব্যক্তিজীবনে ও আচার-আচরণে তাই-ই ছিলেন। ২০০০ সালের দিকে তার সঙ্গে পরিচয়। তিনি তখন পাকিস্তানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর আমি তখন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের লাহোর শাখার চিফ ম্যানেজার। এই ব্যাংকের বৈদেশিক শাখা ছিল করাচি ও লাহোরে। তিনি পেশাগত কারণে লাহোরে এসেছিলেন। ওই শহরে বসবাসরত বাঙালি হওয়ার সুবাদে লাহোরে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলারের দাওয়াতে আমার সঙ্গে তার
পরিচয় হয়।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার একমাত্র বোনের স্বামী যশোর ক্যান্টনমেন্টে কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এপ্রিলের শেষে যশোর ক্যান্টনমেন্টে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে এক পাঞ্জাবি মেজর হঠাৎ পিস্তল বের করে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় অন্যান্য বাঙালি সেনা অফিসার হতবাক হয়ে যান। তখনকার ক্যাপ্টেন পরে কর্নেল সুলতান সারারাত একা সেই লাশ পাহারা দেন। পরদিন সামরিক বিমানে, যা ঢাকা থেকে যশোরে আর্মস সাপ্লাই করত এবং ফেরার পথে খালি হয়ে ফিরত, তাতে অনেক আকুতি-মিনতি করে তার লাশ এবং পরিবারের সদস্যদের ঢাকায় পাঠান। রাষ্ট্রদূতের বোন বিধবা হন এবং তার ছোট বাচ্চারা বাবাকে হারায় কিছু বোঝার আগেই এক পাঞ্জাবি সেনা অফিসারের উদ্ধত আচরণে। তিনি বললেন, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আমাকে সেই পাকিস্তানেই রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
আর একটি ঘটনা বলতেই হয়। আমি পরিবারসহ মারী যাওয়ার পথে রাওয়ালপিন্ডি অবস্থান করছিলাম। তিনি ইসলামাবাদে ডিপ্লোম্যাটিক জোনে থাকতেন। ইসলামাবাদ খুব পরিকল্পিত সুন্দর শহর। তিনি আমাকে আগেই বলে রেখেছিলেন রাতে তার সঙ্গে ডিনার করার জন্য। আমরা ইসলামাবাদ পেঁৗছে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছতে পারছিলাম না আমার পাঠান ড্রাইভারের ভুলের কারণে। ড্রাইভার এক ঘণ্টা ধরে আমার স্ত্রী ও ছোট্ট দুটি কন্যা সন্তানসহ আমাদের পুরো ইসলামাবাদ ঘোরায়। রাত গভীর হওয়ায় আমি একটি মার্কেট থেকে তার বাসায় ফোন করলাম। তিনি বললেন, তোমরা মুভ করো না, আমি আসছি। সেদিন সরকারি ছুটির দিন ছিল। রাষ্ট্রদূত নিজে ড্রাইভ করে সেই মার্কেটে উপস্থিত হলেন_ 'তোমার ড্রাইভারকে বলো আমার গাড়ি ফলো করতে।' ছুটির দিন হওয়ায় তিনি এমনকি হাইকমিশনের কোনো গাড়িও ব্যবহার করেননি। জানতে চাইলে তিনি বললেন, ছুটির দিনে ওদেরও বিশ্রামের দরকার আছে। এমনকি ডিনার শেষ হবার পরে বললেন, তোমার পাঠান ড্রাইভারের ভরসা নাই। তাই নিজে ড্রাইভ করে পথ চিনিয়ে গভীর রাতে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন।
আমরা অভিভূত হয়েছিলাম, আমার মতো একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাঝারি সারির এক কর্মকর্তা ও তার পরিবারের প্রতি তার সহমর্মিতা দেখে।
গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনি আমাদের পরিবারকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। পাঞ্জাবের লাহোরে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলার হুমায়ুন ফরিদের ঢাকা আগমন উপলক্ষে এ দাওয়াত। ডিনার শেষে বিদায় জানানোর সময় বললেন, আমি আমেরিকাতে যাচ্ছি। একটা ভয়াবহ অসুখ বাঁধিয়েছি, দোয়া করো। তোমাদের সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না। আমি নিজেও বুঝিনি তিনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। তার নিষ্পাপ চেহারা চোখে ভাসলে আর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। তিনি আসলে আদৌ মরেননি। তিনি কর্ম, উদারতা ও মহানুভবতার কারণে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন ।
ৎ মতিউল হাসান : একটি বেসরকারি ব্যাংকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত
পরিচয় হয়।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার একমাত্র বোনের স্বামী যশোর ক্যান্টনমেন্টে কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এপ্রিলের শেষে যশোর ক্যান্টনমেন্টে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে এক পাঞ্জাবি মেজর হঠাৎ পিস্তল বের করে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় অন্যান্য বাঙালি সেনা অফিসার হতবাক হয়ে যান। তখনকার ক্যাপ্টেন পরে কর্নেল সুলতান সারারাত একা সেই লাশ পাহারা দেন। পরদিন সামরিক বিমানে, যা ঢাকা থেকে যশোরে আর্মস সাপ্লাই করত এবং ফেরার পথে খালি হয়ে ফিরত, তাতে অনেক আকুতি-মিনতি করে তার লাশ এবং পরিবারের সদস্যদের ঢাকায় পাঠান। রাষ্ট্রদূতের বোন বিধবা হন এবং তার ছোট বাচ্চারা বাবাকে হারায় কিছু বোঝার আগেই এক পাঞ্জাবি সেনা অফিসারের উদ্ধত আচরণে। তিনি বললেন, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আমাকে সেই পাকিস্তানেই রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
আর একটি ঘটনা বলতেই হয়। আমি পরিবারসহ মারী যাওয়ার পথে রাওয়ালপিন্ডি অবস্থান করছিলাম। তিনি ইসলামাবাদে ডিপ্লোম্যাটিক জোনে থাকতেন। ইসলামাবাদ খুব পরিকল্পিত সুন্দর শহর। তিনি আমাকে আগেই বলে রেখেছিলেন রাতে তার সঙ্গে ডিনার করার জন্য। আমরা ইসলামাবাদ পেঁৗছে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছতে পারছিলাম না আমার পাঠান ড্রাইভারের ভুলের কারণে। ড্রাইভার এক ঘণ্টা ধরে আমার স্ত্রী ও ছোট্ট দুটি কন্যা সন্তানসহ আমাদের পুরো ইসলামাবাদ ঘোরায়। রাত গভীর হওয়ায় আমি একটি মার্কেট থেকে তার বাসায় ফোন করলাম। তিনি বললেন, তোমরা মুভ করো না, আমি আসছি। সেদিন সরকারি ছুটির দিন ছিল। রাষ্ট্রদূত নিজে ড্রাইভ করে সেই মার্কেটে উপস্থিত হলেন_ 'তোমার ড্রাইভারকে বলো আমার গাড়ি ফলো করতে।' ছুটির দিন হওয়ায় তিনি এমনকি হাইকমিশনের কোনো গাড়িও ব্যবহার করেননি। জানতে চাইলে তিনি বললেন, ছুটির দিনে ওদেরও বিশ্রামের দরকার আছে। এমনকি ডিনার শেষ হবার পরে বললেন, তোমার পাঠান ড্রাইভারের ভরসা নাই। তাই নিজে ড্রাইভ করে পথ চিনিয়ে গভীর রাতে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন।
আমরা অভিভূত হয়েছিলাম, আমার মতো একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাঝারি সারির এক কর্মকর্তা ও তার পরিবারের প্রতি তার সহমর্মিতা দেখে।
গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনি আমাদের পরিবারকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। পাঞ্জাবের লাহোরে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলার হুমায়ুন ফরিদের ঢাকা আগমন উপলক্ষে এ দাওয়াত। ডিনার শেষে বিদায় জানানোর সময় বললেন, আমি আমেরিকাতে যাচ্ছি। একটা ভয়াবহ অসুখ বাঁধিয়েছি, দোয়া করো। তোমাদের সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না। আমি নিজেও বুঝিনি তিনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। তার নিষ্পাপ চেহারা চোখে ভাসলে আর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। তিনি আসলে আদৌ মরেননি। তিনি কর্ম, উদারতা ও মহানুভবতার কারণে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন ।
ৎ মতিউল হাসান : একটি বেসরকারি ব্যাংকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত
No comments