৫ মে হিলারি আসছেন by মেহেদী হাসান

সব অনিশ্চয়তাকে পেছনে ফেলে অবশেষে বাংলাদেশ সফরে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো তাঁর সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও সুস্পষ্ট কোনো তারিখ জানায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট অন্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগামী ৫ মে হিলারির বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে।


এমন এক সময়ে তিনি এ সফরে আসছেন যখন দেশে গুম-নিখোঁজের প্রতিবাদে প্রধান বিরোধী দল আন্দোলন করছে এবং চিঠি পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। আবার আগামী জাতীয় নির্বাচন কার অধীনে হবে, তা নিয়েও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ চলছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করাসহ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) স্বাক্ষরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ। দেশটি বাংলাদেশের সঙ্গে বৃহৎ পরিসরে কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তিও করতে চায়। এদিকে হিলারির সফরের দিন (৫ মে) ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও ঢাকায় আসছেন বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির সফরের প্রত্যাশায় ছিল বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ওই প্রত্যাশা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার কাছে গতকাল বুধবার শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কারো সফরের সম্ভাবনার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি ইতিবাচক উত্তর দেন। শীর্ষ পর্যায়ের সেই ব্যক্তি হিলারি ক্লিনটন কি না জানতে চাইলেও তিনি ইতিবাচক উত্তর দেন। পরে সফরের তারিখ জানতে চাইলে তিনি তা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।
তবে আরেকটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, ৫ মে বাংলাদেশে আসছেন হিলারি। ৬ মে তিনি ফিরে যাবেন। তবে তিনি প্রতিবেশী আর কোনো দেশ সফর করবেন কি না সে ব্যাপারে জানা যায়নি।
গত অক্টোবরে ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরে বৈঠকে হিলারি ক্লিনটনকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। হিলারি এ বছর ঢাকা সফরের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন।
চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শারম্যান। কূটনৈতিক সূত্রগুলো ওই সফরের আগেই বলেছিল, হিলারির সফরের উপযোগিতা যাচাই করাই (রেকি) তাঁর ওই সফরের মূল লক্ষ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সম্ভাবনার কথা ২০১০ সালে কূটনীতিক মহলে আলোচিত হয়েছিল। ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে তাঁর আবাসন পরিকল্পনার ব্যাপারেও সে সময় খোঁজ নিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু ওই বছর শেষ পর্যন্ত হিলারি আসেননি।
উপরন্তু গত বছরের শুরুর দিকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ ইস্যুতে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে দৃশ্যত টানাপড়েন দেখা দেয় এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ে হিলারির সফর। সে সময় বাংলাদেশ সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও'ব্লেক জুনিয়র গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূস ইস্যুর সম্মানজনক সমাধানের তাগিদ দিয়ে বলেছিলেন, এটি হলে হিলারিকে ঢাকা সফরে আসতে তিনি উৎসাহিত করবেন। কিন্তু বাংলাদেশ জানিয়ে দেয়, গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আর এ ব্যাংকের কার্যকারিতা বজায় রাখতে সরকার প্রয়োজনীয় সব কিছুই করবে।
হিলারি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সফর করলে গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুটি উঠতে পারে কি না জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে ব্যক্তিবিশেষের সখ্যের কারণে বিষয়টি নিয়ে অনেক জল ঘোলা করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখনো জোর দিয়ে বলছে, গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাংকের গুরুত্ব বজায় রাখতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই তাগিদ রয়েছে।
সূত্র জানায়, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়াসহ ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর হরতালসহ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নিখোঁজ-গুম হওয়ার অভিযোগ, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে হত্যাসহ সার্বিক পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, গত ১৯ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র প্রথম সামরিক সংলাপ দুই দেশের সম্পর্কে একটি বড় অগ্রগতি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা ও সামরিক সহযোগিতা জোরদার করতে চায়। ওই লক্ষ্য থেকেই ঢাকায় রুদ্ধদ্বার সংলাপ অনুষ্ঠিত হলেও এর ফলাফল স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনার ব্যাপারেও কূটনৈতিক সূত্রগুলো সুস্পষ্টভাবে কিছু জানায়নি। তবে মিত্র দেশ হিসেবে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারেও দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ চলছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, টিকফা চুক্তির শ্রমিক ইস্যু নিয়ে জটিলতা কেটেছে। মেধাস্বত্ব ইস্যু নিয়েও জটিলতা কাটবে বলে আশা করা হচ্ছে। শিগগিরই এ চুক্তি হতে পারে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলোর বেশির ভাগই গতকাল জানায়, হিলারির সফরের সম্ভাবনার ব্যাপারে তারা জানে না। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি সফর করলে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ও সাক্ষাতে এ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো ইস্যু যেমন উঠে আসতে পারে, তেমনি আসতে পারে সামরিক-বেসামরিক সহযোগিতাসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব ইস্যু। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও'ব্লেক জুনিয়র দুই নেত্রীকে সংকীর্ণ রাজনীতির ঊধর্ে্ব উঠে দেশের জন্য একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি আগামী নির্বাচন কিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং সব দলের অংশগ্রহণ উপযোগী হবে- এর কাঠামো (ফর্মুলা) প্রধান দুই দলকে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র এ বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পূর্তি পালন করেছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। বিল ক্লিনটন ২০০০ সালে প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে ইংরেজি বর্ণের তিনটি 'ডি'র কথা বলেন। এগুলো হলো 'ডেমোক্রেসি' (গণতন্ত্র), 'ডেভেলপমেন্ট' (উন্নয়ন) ও 'ডিনায়াল অব স্পেস ফর টেররিজম' (সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান)।
গত ১ ডিসেম্বর ঢাকায় আমেরিকান রিক্রিয়েশন সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদ, খাদ্যনিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খাতে বৃহৎ পরিসরে বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সম্ভাব্য সফরেই ওই চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস কাজ করবে।
হিলারি কবে আসছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রদূত অবশ্য বলেছিলেন, হিলারির সফর ও চুক্তি তাঁর স্বপ্ন ও লক্ষ্য। রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাঁকে ওই সফর ও চুক্তির ব্যাপারে অনেক কাজ করতে হবে এবং তা করতে তিনি পিছপা হবেন না। এর আগে গত ১৯ নভেম্বর রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকায় এসেই তিনি তাঁর অগ্রাধিকারমূলক কাজ হিসেবে গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ায় সহযোগিতার কথা বলেন। বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার বৈশ্বিক চার উদ্যোগের সব কটি থেকেই সুবিধা পেয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.