সাদা-কথাঃ চাই স্বস্তি এবং আস্থার সংস্কৃতি by মুহম্মদ নূরুল হুদা
একুশের চেতনা যে চিরনবায়নযোগ্য চেতনা, আজ বায়ান্নর আটান্ন বছর পরে তা আরো স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম কালক্রমে বাঙালি জাতিসত্তার সংজ্ঞায়নে যেমন নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি বাঙালির বিবর্তনের ইতিহাসে তা একটি ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে যৌক্তিক করে তুলেছে।
ভাষাবাহিত জাতীয়তাবাদই বাঙালির মূল জাতীয়তাবাদ, যার ভিত্তিতেই সম্পন্ন হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু তারপর? স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে একুশের যুগসম্মত কাম্যতা ও তাত্পর্য কী? মনীষী আবুল ফজলের উচ্চারণকে শিরোধার্য করে বলা যাক, একুশ মানে মাথা নত না করা। তারই পাশাপাশি একুশের আরেকটি প্রণোদনা হচ্ছে অধিক থেকে অধিকতর মাত্রায় সৃষ্টিশীল হওয়া। আমরা দেখেছি, আমাদের সব গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক সঙ্কটে ও সংগ্রামে একুশের চেতনা নতুন তাত্পর্যে ঋদ্ধ হয়েছে। সংবছর বাঙালির মন ও মননে এই চেতনার প্রত্যক্ষ বিকাশ নবায়িত ও চর্চিত হয় কিনা জানি না, তবে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলে এই চেতনা সর্বস্তরের গণমানুষকে পুনরুজ্জীবিত করে। রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে তৃণমূলীয় লোকবাঙালি পর্যন্ত সবাই নিজ নিজ অবস্থানে একুশকে নিয়ে পর্যালোচনায় মেতে ওঠেন।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, সাতচল্লিশের দেশবিভাগের পর থেকে এই ভাষাচেতনাই সেই অনন্য ও ব্যতিক্রমী ইস্যু, যা সব মত ও বিশ্বাসের ধারকদের কাছে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ইস্যুতেই যতই মতানৈক্য দেখাক, এই একটি বিষয়ে তারা ’৪৭ থেকে ’৫২ হয়ে আমাদের স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ আদায়ের সংগ্রামী মিছিলে ও কর্মযজ্ঞে সহযোদ্ধা। তাই স্বীকার করতেই হয়, একুশের চেতনা প্রকারান্তরে আমাদের জাতীয় ঐক্যের চেতনা। এ কারণে যতদ্রুত সম্ভব এই চেতনা গণমানুষের মধ্যে নিবিড়ভাবে চারিয়ে দেয়া অত্যাবশ্যক। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় বা নগর-শহরকেন্দ্রিক সভা-শোভাযাত্রা-অনুষ্ঠানাদি নয়, এই ডিজিটাল যুগে একুশের ব্যক্তিজাগরণবাদী গণতান্ত্রিক চেতনা লোকবাঙালির মনলোকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে গ্রহণযোগ্য করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে হবে। এটি প্রাথমিকভাবে সরকারি দায়িত্ব বটে, তবে এর সঙ্গে দলমত নির্বিশেষে সব সচেতন নাগরিকের একাত্মতা ও কর্মপ্রক্রিয়া কাম্য। একুশ আমাদের যে স্বেচ্ছাশৃঙ্খলার পাঠ দিয়েছে, তারই আলোকে একটি সরল পরিকল্পনার মাধ্যমে সংস্কৃতিসেবীরাই এই সম্প্রসারণের কাজটি শুরু করতে পারেন।
দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা বাংলা একাডেমী কর্তৃক এবারে আয়োজিত মেলার পরিকল্পনা ও ব্যাপ্তির কথা বলতে পারি। বাংলা একাডেমী ক্যাম্পাসে নতুন ভবনের কাজ শুরু হওয়ায় স্থান-সঙ্কোচনের ফলেই এই আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছিল। আমরা গোড়া থেকেই বইমেলাকে একাডেমীর সম্মুখস্থ রাস্তা, এমনকি তত্সন্নিহিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত করার পক্ষে মত প্রকাশ করে আসছি। কর্তৃপক্ষ কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাই করল এবং মেলা চলাকালে টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ রেখে সুবুদ্ধির পরিচয় দিল। ফলে জনগণের নির্বিরোধ হাঁটাচলার পরিবেশ নিশ্চিত হলো। আজ একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে এই রচনাটি প্রস্তুতির সময় পর্যন্ত তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই মেলা চলছে। ফলে বাংলা একাডেমীর ভেতর-ক্যাম্পাসে মেলাটিকে সীমিত রাখার যে রক্ষণাত্মক ধারণা, তার অসারত্ব প্রমাণিত হয়েছে। যারা ভেবেছিলেন মেলার পরিধি বাড়ানোয় প্রকাশকরা ক্ষুব্ধ হবেন স্টল বরাদ্দ নিয়ে তাদের ধারণা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়নি। তবে আজই সংবাদে শঙ্কিত হওয়ার মতো একাধিক ঘটনার কথা প্রকাশিত হয়েছে। এটা যে কাউকে চিন্তাগ্রস্ত করাটাই স্বাভাবিক। দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলার এই অবনতি ভাষার মাসে আমাদের সাংস্কৃতিক স্বস্তিকে শঙ্কাগ্রস্ত করে তুলেছে। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে পুলিশি ও সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন জনগণের নির্ভীক প্রতিরোধ। তার চেয়েও বড় কথা, যারা এই সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য দায়ী, তাদের ভেতর ইতিবাচক আত্মোপলব্ধির জন্ম দিতে হবে। যারা জেনেশুনে জ্ঞানপাপী তাদের সমাজ থেকে সক্ষম হাতে উত্খাত করতে হবে। কেবল নৈয়ায়িক ও মঙ্গলময় সমাজেই এই ইতিবাচকতা স্বেচ্ছা-শৃঙ্খলার পথে বিকশিত হতে পারে। এই সমাজবিকাশের পূর্বশর্ত নিশ্চিত করার প্রাথমিক দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের, যারা দলমত নির্বিশেষে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে অটল থাকবে। এই মানসিক পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো পথে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা দিবাস্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে। আবারো বলব, পাঠ গ্রহণ করা যেতে পারে একুশের মেলার স্বেচ্ছাশৃঙ্খলা থেকেই। এই মেলা স্বেচ্ছাশৃঙ্খলাপরায়ণ সব মত ও পথের মানুষের মিলনমেলা। যারা বিরুদ্ধপক্ষ, তাদের ব্যত্যয়হীন প্রতিশ্রুতি ও যুক্তিবাদিতায় আস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এর ফলে বিকশিত হবে পারস্পরিক আস্থা ও স্বস্তির সংস্কৃতি। কেবল সভা-মেলা-অনুষ্ঠান-পুরস্কার নয়, এবারের একুশ হয়ে উঠুক দেশব্যাপী এই স্বস্তির সংস্কৃতির প্রথম সোপান। এটিই হোক একুশের নবায়িত চেতনার সাম্প্রতিকতম পাঠ।
লেখক : কবি, প্রফেসর ও সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব১
স্মরণ করা যেতে পারে যে, সাতচল্লিশের দেশবিভাগের পর থেকে এই ভাষাচেতনাই সেই অনন্য ও ব্যতিক্রমী ইস্যু, যা সব মত ও বিশ্বাসের ধারকদের কাছে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ইস্যুতেই যতই মতানৈক্য দেখাক, এই একটি বিষয়ে তারা ’৪৭ থেকে ’৫২ হয়ে আমাদের স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ আদায়ের সংগ্রামী মিছিলে ও কর্মযজ্ঞে সহযোদ্ধা। তাই স্বীকার করতেই হয়, একুশের চেতনা প্রকারান্তরে আমাদের জাতীয় ঐক্যের চেতনা। এ কারণে যতদ্রুত সম্ভব এই চেতনা গণমানুষের মধ্যে নিবিড়ভাবে চারিয়ে দেয়া অত্যাবশ্যক। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় বা নগর-শহরকেন্দ্রিক সভা-শোভাযাত্রা-অনুষ্ঠানাদি নয়, এই ডিজিটাল যুগে একুশের ব্যক্তিজাগরণবাদী গণতান্ত্রিক চেতনা লোকবাঙালির মনলোকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে গ্রহণযোগ্য করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে হবে। এটি প্রাথমিকভাবে সরকারি দায়িত্ব বটে, তবে এর সঙ্গে দলমত নির্বিশেষে সব সচেতন নাগরিকের একাত্মতা ও কর্মপ্রক্রিয়া কাম্য। একুশ আমাদের যে স্বেচ্ছাশৃঙ্খলার পাঠ দিয়েছে, তারই আলোকে একটি সরল পরিকল্পনার মাধ্যমে সংস্কৃতিসেবীরাই এই সম্প্রসারণের কাজটি শুরু করতে পারেন।
দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা বাংলা একাডেমী কর্তৃক এবারে আয়োজিত মেলার পরিকল্পনা ও ব্যাপ্তির কথা বলতে পারি। বাংলা একাডেমী ক্যাম্পাসে নতুন ভবনের কাজ শুরু হওয়ায় স্থান-সঙ্কোচনের ফলেই এই আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছিল। আমরা গোড়া থেকেই বইমেলাকে একাডেমীর সম্মুখস্থ রাস্তা, এমনকি তত্সন্নিহিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত করার পক্ষে মত প্রকাশ করে আসছি। কর্তৃপক্ষ কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাই করল এবং মেলা চলাকালে টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ রেখে সুবুদ্ধির পরিচয় দিল। ফলে জনগণের নির্বিরোধ হাঁটাচলার পরিবেশ নিশ্চিত হলো। আজ একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে এই রচনাটি প্রস্তুতির সময় পর্যন্ত তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই মেলা চলছে। ফলে বাংলা একাডেমীর ভেতর-ক্যাম্পাসে মেলাটিকে সীমিত রাখার যে রক্ষণাত্মক ধারণা, তার অসারত্ব প্রমাণিত হয়েছে। যারা ভেবেছিলেন মেলার পরিধি বাড়ানোয় প্রকাশকরা ক্ষুব্ধ হবেন স্টল বরাদ্দ নিয়ে তাদের ধারণা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়নি। তবে আজই সংবাদে শঙ্কিত হওয়ার মতো একাধিক ঘটনার কথা প্রকাশিত হয়েছে। এটা যে কাউকে চিন্তাগ্রস্ত করাটাই স্বাভাবিক। দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলার এই অবনতি ভাষার মাসে আমাদের সাংস্কৃতিক স্বস্তিকে শঙ্কাগ্রস্ত করে তুলেছে। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে পুলিশি ও সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন জনগণের নির্ভীক প্রতিরোধ। তার চেয়েও বড় কথা, যারা এই সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য দায়ী, তাদের ভেতর ইতিবাচক আত্মোপলব্ধির জন্ম দিতে হবে। যারা জেনেশুনে জ্ঞানপাপী তাদের সমাজ থেকে সক্ষম হাতে উত্খাত করতে হবে। কেবল নৈয়ায়িক ও মঙ্গলময় সমাজেই এই ইতিবাচকতা স্বেচ্ছা-শৃঙ্খলার পথে বিকশিত হতে পারে। এই সমাজবিকাশের পূর্বশর্ত নিশ্চিত করার প্রাথমিক দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের, যারা দলমত নির্বিশেষে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে অটল থাকবে। এই মানসিক পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো পথে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা দিবাস্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে। আবারো বলব, পাঠ গ্রহণ করা যেতে পারে একুশের মেলার স্বেচ্ছাশৃঙ্খলা থেকেই। এই মেলা স্বেচ্ছাশৃঙ্খলাপরায়ণ সব মত ও পথের মানুষের মিলনমেলা। যারা বিরুদ্ধপক্ষ, তাদের ব্যত্যয়হীন প্রতিশ্রুতি ও যুক্তিবাদিতায় আস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এর ফলে বিকশিত হবে পারস্পরিক আস্থা ও স্বস্তির সংস্কৃতি। কেবল সভা-মেলা-অনুষ্ঠান-পুরস্কার নয়, এবারের একুশ হয়ে উঠুক দেশব্যাপী এই স্বস্তির সংস্কৃতির প্রথম সোপান। এটিই হোক একুশের নবায়িত চেতনার সাম্প্রতিকতম পাঠ।
লেখক : কবি, প্রফেসর ও সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব১
No comments