দূষিত পরিবেশ এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা by ধরিত্রী সরকার সবুজ

পরিবেশদূষণকারী হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত আমরা দেখে আসছি। ঢাকার মানুষের জীবন হয়ে পড়ছে হুমকির সম্মুখীন। ঢাকার পরিবেশদূষণের নানা কারণের মধ্যে গাড়ির কালো ধোঁয়া সচেতন ব্যক্তিদের ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।


সিএনজিতে রূপান্তর করা কিছু যানবাহন ছাড়া রাস্তায় যেসব বাস, ট্রাক, মোটরকার চলে, তার সবই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে পেট্রল বা ডিজেল। পেট্রল ও ডিজেল মূলত হাইড্রোকার্বন অর্থাৎ হাইড্রোজেন ও কার্বনের মিশ্রণ। ফলে ইঞ্জিন সিলিন্ডারে বাতাসসহ পেট্রল বা ডিজেলের দহন শেষে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অঙ্েিজনের যেকোনো দুটি বা তিনটির সহযোগে কার্বন ডাই-অঙ্াইড (ঈঙ২), কার্বন মনোঙ্াইড (ঈঙ), হাইড্রোকার্বন (ঐঈ), নাইট্রোজেনের অঙ্াইড (ঘঙ) এবং কিছু ঝুল-জাতীয় বর্জ্য পদার্থ নিঃসরণ করে। ইঞ্জিন সিলিন্ডারে জ্বালানির পরিপূর্ণ দহন হলে শুধু কার্বন ডাই-অঙ্াইডই উৎপন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু যখন পরিপূর্ণ দহন হয় না, তখন কার্বন মনোঙ্াইড উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া দহনে একেবারেই অংশ না নেওয়ার কারণে জ্বালানির একটা অংশ হাইড্রোকার্বন আকারেই সরাসরি বের হয়ে আসে।
ভালোভাবে জীবনযাপনের জন্য নির্মল ও বিশুদ্ধ বাতাসের প্রয়োজনীয়তা আমরা বুঝি। বাতাসের উপাদানের মধ্যে রয়েছে অঙ্েিজন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই-অঙ্াইড ও জলীয় বাষ্প। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত কার্বন ডাই-অঙ্াইড সরাসরি দূষণ পদার্থ নয়। কিন্তু মাত্রা যখন নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বৃদ্ধি পায়, তখনই কার্বন ডাই-অঙ্াইড তার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। এ ছাড়া কার্বন মনোঙ্াইড, হাইড্রোকার্বন, ঝুল-জাতীয় পদার্থ_সবই আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর। আবার জ্বালানি তেলের কারণে বর্জ্য গ্যাসের মধ্যে মিশ্রিত থাকে স্বল্প পরিমাণ সিসা, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তা ছাড়া যানবাহন নিঃসৃত এসব গ্যাসের আস্তরণের কারণে ভূপৃষ্ঠ পরিণত হচ্ছে গ্রিন হাউসে। সূর্য থেকে আসা তাপ পুরোপুরি বিকিরিত হতে বাধা পাচ্ছে। ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বরফ গলা পানিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল এবং মালদ্বীপসহ পৃথিবীর বেশ কিছু নিম্নাঞ্চলের পানির নিচে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসব বর্জ্য গ্যাস ক্ষতি করে ওজোন স্তরের। ওজোন স্তর সূর্য থেকে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয়। কিন্তু ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ছিদ্রের সৃষ্টি হলে অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে মানুষসহ সব জীবের ওপরই একটা ভয়ংকর হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে রাস্তায় যত মোটরকার দেখা যায়, তার বড় অংশই বিদেশ থেকে আসা রিকন্ডিশন্ড। দু-তিন বছর চালানোর পর এসব গাড়িকে যখন তারা বাতিল ঘোষণা করে, তখন কিছুটা ঘষামাজা এবং কিছু খুচরা যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করার পর বাংলাদেশে আসে। এসব পুরনো পরিত্যক্ত গাড়ি যে বায়ুদূষণকারী গ্যাস নিঃসরণ করবে, তা অনেকটা স্বাভাবিক বলেই মনে হওয়ার কথা। বিশ্বের উন্নত কোনো দেশেই রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ঢুকতে পারে না। যানবাহন থেকে পরিবেশদূষণ বন্ধের চিন্তা করলে আমাদেরও প্রয়োজন রিকন্ডিশন্ড কার আমদানি বন্ধ করা। সরকারিভাবে অবশ্য নিয়ম আছে যে পাঁচ বছরের বেশি পুরনো গাড়ি আমদানি করা যাবে না। তবে এ নিয়মও সঠিকভাবে পালন করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষীয় উদাসীনতার চিত্রটি বড় বেশি প্রকট এবং এর দায় বহন করতে হচ্ছে দেশের সব মানুষকে।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কী করতে পারি? যানবাহনের উপস্থিতিকে স্বীকার করে নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে, সেগুলোকে কতটা পরিবেশ উপযোগী করা যায়। হয়তো অনেক উন্নত দেশ যানবাহনের ফিটনেসের জন্য যত কঠোর নীতিমালা নির্ধারণ করছে, এ দেশের জন্য তা সম্ভব নয়। এমনকি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করাও সম্ভব নয়। কারণ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশকে যানবাহনের জন্য কোনো আইনকানুন করতে গেলে তা করতে হবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানুষের জীবনযাত্রার মান, ভৌগোলিক অবস্থান প্রভৃতির দিকে দৃষ্টি রেখেই। কিন্তু এ মুহূর্তে যেটা করা সবচেয়ে জরুরি, তা হলো আস্তে আস্তে পরিপূর্ণ ত্রুটিমুক্ততার দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এখনই কাজ শুরু করা। এর জন্য বাস, ট্রাক, মোটরকার, অটোটেম্পো বা মোটরসাইকেলের মধ্যে কোন ধরনের যানবাহন আমাদের পরিবেশদূষণে কতটুকু দায়ী, তা নির্ধারণ করা দরকার এবং সে তথ্য থেকেই বুঝতে হবে, কোন ধরনের যানবাহনের নিয়ন্ত্রণের ওপর কতটুকু জোর দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা এর আগে বুঝতে পেরেছিলাম দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বেবিট্যাঙ্ িপরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে এবং সে হিসেবে ঢাকা নগরীতে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বেবিট্যাঙ্ িচলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন আমাদের আবার নির্ধারণ করতে হবে, বর্তমানে রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনগুলোর মধ্যে কোনগুলো পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা নগরীর বায়ুকে পেট্রল ইঞ্জিনচালিত গাড়ির চেয়ে ডিজেল ইঞ্জিনচালিত গাড়িগুলো দূষিত করছে অনেক বেশি। যদিও পেট্রল ইঞ্জিনচালিত গাড়ির দূষণও একেবারে কম নয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রথমেই ঢাকার যানবাহনগুলোকে, বিশেষ করে বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলারসহ অন্যান্য গাড়িকে সিএনজিতে রূপান্তরের দিকে নজর দিতে হবে। ইতিমধ্যে অনেক গাড়ি সিএনজিতে রূপান্তর হলেও এখনো অনেক যানবাহনে তা করা হয়নি। রূপান্তরের খরচ একটু বেশি হওয়ায় ডিজেলচালিত গাড়ির মালিকরা সিএনজিতে রূপান্তর করেছেন কম। ডিজেলচালিত বাস-ট্রাকের মালিককে বেশি উদ্বুদ্ধকরণসহ পেট্রল ও ডিজেলচালিত গাড়িকে সিএনজিতে রূপান্তরের জোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে ব্যক্তিগত মোটরকারের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। প্রতিদিন যে হারে রাজধানীতে নতুন গাড়ি নামছে তা নিয়ে আজ অনেকেই শঙ্কিত। সে শঙ্কা আসছে মূলত রাজধানীতে তীব্র যানজট সৃষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে। সে কারণে বিশেষজ্ঞ এবং কর্তৃপক্ষও চিন্তা করছে ঢাকার রাস্তায় প্রাইভেট কারের সংখ্যা কমিয়ে বড় বাসের মতো গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানোর। এ কাজটি যদি করা যেত, তাহলে যানজট কমানোর পাশাপাশি বায়ুদূষণও কমানো যেত অনেকখানি। কারণ যানজটে যানবাহনগুলো যত বেশি সময় আটকে থাকে, যানবাহন থেকে ধোঁয়া নিঃসরণও তত বেশি হয়, বাড়ে বায়ুদূষণ।
আমাদের রাস্তায় রিকন্ডিশন্ড গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। নতুন গাড়ির চেয়ে দাম অনেক কম হওয়ায় মানুষ রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনার দিকেই ঝুঁকছেন। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি তুলনামূলকভাবে বেশি বায়ুদূষণ করে। সরকার নতুন গাড়ির ওপর ট্যাঙ্ কমিয়ে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির সঙ্গে দামের পার্থক্য কমিয়ে মানুষকে নতুন গাড়ি কিনতে উৎসাহী করতে পারে।
ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য তীব্র যানজটও অনেকাংশে দায়ী। যানজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলে গাড়ির ধোঁয়া থেকে পরিবেশদূষণও অনেকখানি কমে যাবে। বেশি প্রয়োজন মানুষকে গাড়ির ধোঁয়া থেকে পরিবেশদূষণ এবং তার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি করা। বিশেষ করে যানবাহনের মালিক ও চালকরা যখন বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হবে, তখনই আমাদের উপকার হবে সবচেয়ে বেশি। তবে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষীয় যে উদাসীনতা রয়েছে এরও অবসান জরুরি।

লেখক : প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

No comments

Powered by Blogger.