শ্রদ্ধাঞ্জলি-‘খুব সাবধানে পা ফেলো’ by মনিরুল ইসলাম

আজ ৩ জানুয়ারি। একজন একান্ত আপন মানুষের চিরপ্রস্থানের দিন। কাঁচাপাকা চুলের সদা হাস্যোজ্জ্বল সেই মানুষটার চিরবিদায়ে ব্যথিত আমরা। শোকাহত তাঁর সহযোদ্ধা-সঙ্গীরা। সবার প্রিয় হয়ে ওঠা একজন মানুষ, কোনো লোভ-মোহ যাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তিনি আমাদের অশোক দা, যিনি আমার অগ্রজ।


একান্ত অভিভাবক। পথনির্দেশক। যাঁর অনুপ্রেরণায় আমার এত দূরে আসা। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
২০০৪ সাল। বাংলা সাহিত্যে অনার্স পড়তে যশোর শহরে আসা। সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে অধ্যয়নের নতুন পাঠ শুরু। নাটকের প্রতি ভালোবাসার কারণে নাট্য সংগঠন বিবর্তন যশোরে নিয়মিত নাটকের মহড়ার সঙ্গে যুক্ত হলাম। হয়ে উঠলাম পুরোদস্তুর নাট্যকর্মী। বিবর্তনই হলো আমার ভাত-বাটি। সঙ্গে ‘ওঠা-বসা’ শুরু করলাম যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক যশোর (এখন প্রকাশনা বন্ধ) পত্রিকার অফিসে। কয়েক মাস পরে বিবর্তনের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ আর তুহিন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন আনন্দ দাদার (অশোক দার মতো আরেকজন কাছের মানুষ) সঙ্গে। আনন্দ দার সানুগ্রহে দৈনিক কল্যাণ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করলাম। প্রথম আলো যশোর অফিসের নিচতলায় অফিস। অশোক দা ওই কল্যাণ পত্রিকাতেই একসময় উপসম্পাদকীয় লিখতেন। অশোক দার সঙ্গে পরিচয় হলো। কেশবপুরের ছেলে হওয়ায় আমার প্রতি অশোক দার আন্তরিকতা বোধ হয় একটু বেশিই ছিল। কারণ অশোক দার বাড়িও কেশবপুরে। অশোক দা অত্যন্ত সাবলীলভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতেন। আমি তাঁর ছেলের বয়সী, তবু বন্ধুর মতো কথা হতো।
২০০৬ সালে অশোক দার পরামর্শে দৈনিক রানার (যশোর থেকে প্রকাশিত) পত্রিকায় যোগদান করলাম। মালিকানার জটিলতায় তিন মাস পরে রানার বন্ধ হয়ে গেল। বেকার হলাম। ঠিকানা হয়ে গেল প্রথম আলো অফিস। দিনের একটি বড় সময় এ অফিসেই কাটত। অশোক দা, আনন্দ দা তখন আমার পুরোপুরি অভিভাবক। আমার একটি চাকরির জন্য তাঁরা খুবই চিন্তিত। এরই মধ্যে যশোর থেকে নতুন একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। সাংবাদিকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা। সেখানে আমার যোগ দেওয়া নিয়ে কথাবার্তা চলছে।
কিন্তু অশোক দার ভিন্ন পরামর্শ। তিনি বললেন, নতুন পত্রিকায় না গিয়ে বরং পেশাদার মালিকানার কোনো পত্রিকায় যাওয়া ভালো। আর যা-ই হোক, পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার ভয় থাকবে না। স্বচ্ছন্দে কাজও করা যাবে। আনন্দ দাও তাঁর কথায় উৎসাহ দিলেন।
উল্লেখ্য, তখন দৈনিক গ্রামের কাগজ ( যশোর থেকে প্রকাশিত) থেকে কয়েকজন সাংবাদিক নতুন ওই পত্রিকায় চলে যাচ্ছেন। আমি অশোক দার কথায় সম্মতি দিতেই তিনি আমার সামনেই গ্রামের কাগজ-এর সম্পাদক মবিনুল ইসলামের কাছে ফোন করে বললেন, ‘মবিন, তোমাকে একটি ভালো ছেলে দিচ্ছি। দেখো কাজে লাগাতে পার কি না।’
ওই বছরের ১৪ নভেম্বর মবিন ভাইয়ের কাছে গেলাম। অশোক দা পাঠিয়েছেন বলতেই মবিন ভাই বললেন, ‘ইচ্ছা করলে আজ থেকেই তুমি কাজ শুরু করতে পার।’ পিছু না তাকিয়ে ওই দিন থেকেই কাজ শুরু করলাম। সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য অশোক দার সঙ্গে যোগাযোগটা আরও নিবিড় হলো। বছর দেড়েক পরে গ্রামের কাগজ ছেড়ে দিলাম। আবার বেকার। গ্রামের কাগজ ছাড়ার আগে অশোক দার সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। মবিন ভাইয়ের ওপর অভিমান করে কাগজ ছেড়ে এলাম। অশোক দা বললেন, এত অভিমান থাকা ভালো না। পরক্ষণে আবার বললেন, ‘জব স্যাটিসফেকশন বলে একটি কথা আছে। সেটি না থাকলেও কাজ করা যায় না।’ সংবাদ সংগ্রহের জন্য দাদা বিভিন্ন সময় আমাকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন।
খুবই খারাপ সময় যেতে লাগল। পকেটে টাকা নেই। সময় কাটে না। আমাকে নিয়ে দাদা আবার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য বেসরকারি একটি সংস্থা তিন মাসের একটি প্রকল্প শুরু করল। দাদা কাকে যেন ফোন করে দিলেন, আমি পর্যবেক্ষক হিসেবে তিন মাসের জন্য কাজ পেলাম। সে নির্বাচন আবার পণ্ড হয়ে গেল। দুর্ভাগ্য, আমার সে কাজটিও আর করা হলো না।
শেষ দিকে এসে দাদা প্রায়ই বলতেন, তাঁর কোমরে ব্যথা। ভালো চিকিৎসক দেখাতে বলতাম। দাদা গুরুত্ব দিতেন না। তাঁর একসময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ডাক্তার কাজী রবিউল হক ছিলেন তাঁর চিকিৎসক। কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর জন্য তিনি পরামর্শ দিলেন। তাঁর পরামর্শ অশোক দা শোনেননি। পরে অশোক দার এক ভাই (লন্ডনে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন) রোগের প্রাথমিক লক্ষণ শুনে ক্যানসারের আশঙ্কা করলেন। ভারতে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর অশোক দার দেহে সত্যিই ক্যানসার ধরা পড়ল। চিকিৎসকেরা তাঁকে দেশে ফিরিয়ে দিলেন। শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি।
২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর। প্রথম আলো ঢাকা অফিস থেকে ফোন করে আমাকে যশোর অফিসের দায়িত্ব নিতে বলা হলো। শুনে প্রথমেই অশোক দার বাসায় গেলাম তাঁর আশীর্বাদ নিতে। দাদার মাথার কাছে বসে বিষয়টি জানালাম। দাদা আস্তে আস্তে বললেন, ‘চোখ কান খোলা রেখে খুব সাবধানে পা ফেলো।’ ২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারি দাদা পরপারে পাড়ি দিলেন। আজও সেই কথাটি কানে বাজে, ‘খুব সাবধানে পা ফেলো।’

No comments

Powered by Blogger.