এ অশ্লীলতার শেষ কোথায় by মাহফুজ উল্লাহ
বিষয়টি অনেক পুরনো। এ সম্পর্কে লেখালেখি, আলাপ-আলোচনা অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হবে, এটাও মনে করার কোনো কারণ নেই। ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে—‘পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদারকে সংবর্ধনা জানাতে বরগুনা জেলার দুটি উপজেলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থীকে গত শনিবার প্রখর রোদের ভেতর পৌনে চার ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
এজন্য বামনা ও বেতাগী উপজেলার চারটি স্কুলে আগেভাগেই দিয়ে দেয়া হয় ছুটি। শিক্ষকদের দাবি, সরকারি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে প্রতিমন্ত্রীকে সংবর্ধিত করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছাত্রছাত্রীদের স্কুল থেকে নিয়ে এসে রাস্তার দু’পাশে দাঁড় করিয়ে রাখেন। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় এ কাজ করেছে। প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেছেন, অনুষ্ঠানস্থলের আশপাশে তিনি কোনো শিক্ষার্থীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেননি। জেলা প্রশাসক স্বপন কুমার সরকার কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, তিনি বেলা ১১টার দিকে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বেতাগী উপজেলা সম্মেলন কক্ষে পৃথক এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। এসময় তিনি স্থানীয় গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। পরে তাদের সেখান থেকে বাসায় চলে যেতে নির্দেশ দেন তিনি। নদীভাঙন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস রোধ এবং কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওইদিন বরগুনার বামনা উপজেলার রামনা ইউনিয়নের খোলপটুয়া আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে উপজেলা আওয়ামী লীগ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার। দুপুরে এ সভা শুরু হওয়ার কথা ছিল। প্রতিমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য রামনা শেরেবাংলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হোগলপাতি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং খোলপটুয়া আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় আগেভাগে ছুটি দেয়া হয়। দুপুর ১২টা থেকে এ তিনটি স্কুলের প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীকে বামনা-রামনা সড়কের দু’পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। খোলপটুয়া আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী জিন্নাতুন নেছা। দুপুর ১২টা থেকে বিকাল পৌনে ৪টা পর্যন্ত সে প্রতিমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে রাস্তার একপাশে অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। জিন্নাতুন নেছা আঞ্চলিক উচ্চারণে কালের কণ্ঠকে বলে, ‘হেই সহালে আইছি না খাইয়া, লেইজারে খামু। কিন্তু রাস্তায় ছ্যারেরা দাঁড়াইতে কইছে। হেই লইগ্যা খাইতে বাড়ি যাইতে পারি নাই।’ সরকারি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা এবং ছাত্রছাত্রীদের পাঠ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করে কেন তাদের কড়া রোদের ভেতর রাস্তার দু’পাশে এনে দাঁড় করানো হয়েছিল, তা জানতে চাইলে খোলপটুয়া আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ কামাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী এই এলাকার গর্ব। তাকে সংবর্ধনা জানানো আমাদের কর্তব্য।’
প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে, কিন্তু তার সবক’টি পত্রিকায় আসে না। ক্ষমতার দম্ভে বলীয়ান মানুষেরা এ কাজগুলো করেন। যেহেতু শিক্ষার্থীদের কোনো বিকল্প থাকে না তাই বাধ্য হয়ে তারা শিক্ষকদের নির্দেশ মেনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থাকে। শিক্ষক বেচারাই-বা কী করবেন? এর সঙ্গে জড়িত থাকে তার বদলি, পদোন্নতি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে এমপিওভুক্তি। প্রখর রোদে দণ্ডায়মান শিক্ষার্থীদের একাই শুধু দুর্ভোগ পোহাতে হয় না, একই সঙ্গে দুর্ভোগ নেমে আসে শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা ও স্থানীয় জনগণের ওপর। কারণ ওই ক্ষমতাধর ব্যক্তির আগমনকে কেন্দ্র করে যত সব তোরণ বানানো হয় তা যান ও মানুষ চলাচল ব্যাহত করে। এ অবস্থা থেকে ঢাকা শহরও মুক্ত নয়। যে কোনো জায়গায়ই তোরণ বসানো হোক না কেন, প্রাকৃতিক নিয়মে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ওইসব তোরণ ছোঁয়ার সাহস কারও থাকে না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসবের নির্মাতা থাকে সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকরা।
এছাড়াও রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা অথবা মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার কষ্ট শিকার করতে হয় বয়েজ গাইড ও গার্লস গাইডদের। সরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর বেশকিছু দিবস পালিত হয়। এই দিবস উদযাপনের পূর্বশর্ত মিছিল ও সেমিনারে উপস্থিতি দেখানোর জন্য বয়েজ গাইড ও গার্লস গাইডদের প্রয়োজন হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলটি সরকারকে ব্যবহার করলেও এক্ষেত্রে খুবই অসহায় বোধ করেন। কারণ পয়সা দিয়ে জনসভার লোক আনা গেলেও দিবস উদযাপনের মিছিলে যোগ দেয়ার জন্য লোক আনা যায় না। এক্ষেত্রে বিপদে পড়েন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তা, ব্যক্তি ও কর্মচারীরা। যেমন করেই হোক মিছিলে লোক আনতে হবে এবং প্রধান অতিথিকে খুশি করতে হবে। এই একদিনের দুই বা তিন ঘণ্টার জমায়েত দিয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি কী প্রমাণ করতে চান তা স্পষ্ট নয়। কারণ তারা তো ক্ষমতার অধিকারী হয়েই আছেন। এই জমায়েতের আরেকটি উপসর্গ লোক জড়ো করে স্বদেশ প্রত্যাগত নেতা বা নেত্রীকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংবর্ধনা জ্ঞাপন। এর ফলে ওই নেতা বা নেত্রী এবং দেশের কোনো ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় কিনা তা তারা ভেবে দেখেন না। অর্থ ও হুকুম দিয়ে জড়ো করা জনতার ভক্তি ও স্লোগানে তারা মনে করেন দেবতার আসনে বসে গেছেন। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ এসব কর্মকাণ্ডকে অভিসম্পাত দেয়, তা তারা জানেন না।
একই তারিখে অর্থাত্ ১৪ ফেব্রুয়ারি আরেকটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়—‘একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনারে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, পৌর চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীরা ফুল দিচ্ছে—এমন একটি ভিডিও চিত্র (ডামি) গত ৮ ফেব্রুয়ারি ধারণ করা হয়েছে। মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এ চিত্র ধারণ করা হয়। এসময় শহর ও আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস বন্ধ করে রোদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জড়ো করা হয় সেখানে। ক্লাস বন্ধ করে রোদের মধ্যে সেখানে শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেক অভিভাবক। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বাংলার পৌরকথা’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। ওই অনুষ্ঠানের ভিডিও চিত্র ধারণের জন্য পৌর মেয়র রমজান আলী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীদের মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বলেন। তার কথামত গত ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম জরিনা ডিগ্রি কলেজ, দোয়াত আলী দাখিল মাদ্রাসা, মানিকগঞ্জ শিশু মঞ্জুরি স্কুল, মানিকগঞ্জ ৮৮ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রমজান আলী কলেজ, আফরোজা রমজান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নাবারুণ শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পয়রা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয় শতাধিক শিক্ষার্থীসহ ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অভিভাকেরা সেখানে উপস্থিত হন। এরপর সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত রোদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। বেলা পৌনে ১২টায় সেখানে উপস্থিত হন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ মালেক সালেহ উদ্দিন। পৌর মেয়র রমজান আলী আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কর্মস্থল রেখে সেখানে অংশ নেন। দুপুর ১২টার দিকে সাংসদ ও জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দেয়া হয়। এসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ক্যামেরা না থাকলেও স্থানীয়ভাবে এসব দৃশ্য ধারণ করা হয়। এসব দৃশ্য ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ধারণ করা বলে বিটিভির ওই অনুষ্ঠানে সম্প্রচারিত হওয়ার কথা রয়েছে। শহরতলির নয়াকান্দি এলাকায় দোয়াত আলী দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মনিরুজ্জামান তার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে সকাল ১০টায় সেখানে উপস্থিত হন। তিনি জানান, পৌর মেয়র রামজান আলীর নির্দেশে ক্লাস বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। ৮৮ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ মতিউর রহমান বলেন, পৌর মেয়র রমজান আলীর নির্দেশেই তিনি তার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। মানিকগঞ্জ শিশু মঞ্জুরি স্কুলের প্রথম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর মা প্রতিমা সরকার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ক্লাস বন্ধ করে রোদের মধ্যে শিশুদের দাঁড় করিয়ে রাখা অত্যন্ত অমানবিক। মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক জিএম সালেহ্ উদ্দিন বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি ১১টার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বাংলার পৌরকথা’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে। সোমবার তারই ডামি চিত্র ধারণ করা হয়। স্কুল ছুটি দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত করা এবং রোদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের দাঁড় করিয়ে রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষই তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসে। এজন্য কাউকে চাপ প্রয়োগ করা হয়নি।’ এ ধরনের কর্মকাণ্ডের নিন্দা বা সমালোচনা করে কোনো সংশোধনের পথ বের করা যাবে না। কারণ বর্তমান সরকারও ক্ষমতায় আসার পর এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল। অতীতেও এ ধরনের হুশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ ও শিক্ষার্থীকে সময় নষ্ট করে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে আত্মতৃপ্তি বোধের নগ্নতা ও অশ্লীলতার কোনো সমাধান হয়নি। অমার্জিত ক্ষমতা, বিত্ত ও প্রভাবের বিনিময়ে এই ক্ষমতাধরেরা যে মানসিকতার পরিচয় দেন তার কোনো সমর্থন নেই।
এদেশের অনেক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সময়ে ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য দেশবাসীকে উপদেশ দেন। সেই ভারতই অতিসম্প্রতি মহাসড়কে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও সোনিয়া গান্ধীর প্রতিকৃতি সংবলিত বিলবোর্ড লাগানোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই একটি ব্যাপারে তারা তো ভারতের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। মনে রাখা প্রয়োজন, আত্মতুষ্টি কখনোই সাফল্যের চাবিকাঠি হয় না। এবং যারা রোদে দাঁড়িয়ে রোদে দগ্ধ হয়, তারা ওই কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ দেয় না, মনে মনে অভিসম্পাত দেয়।
প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে, কিন্তু তার সবক’টি পত্রিকায় আসে না। ক্ষমতার দম্ভে বলীয়ান মানুষেরা এ কাজগুলো করেন। যেহেতু শিক্ষার্থীদের কোনো বিকল্প থাকে না তাই বাধ্য হয়ে তারা শিক্ষকদের নির্দেশ মেনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থাকে। শিক্ষক বেচারাই-বা কী করবেন? এর সঙ্গে জড়িত থাকে তার বদলি, পদোন্নতি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে এমপিওভুক্তি। প্রখর রোদে দণ্ডায়মান শিক্ষার্থীদের একাই শুধু দুর্ভোগ পোহাতে হয় না, একই সঙ্গে দুর্ভোগ নেমে আসে শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা ও স্থানীয় জনগণের ওপর। কারণ ওই ক্ষমতাধর ব্যক্তির আগমনকে কেন্দ্র করে যত সব তোরণ বানানো হয় তা যান ও মানুষ চলাচল ব্যাহত করে। এ অবস্থা থেকে ঢাকা শহরও মুক্ত নয়। যে কোনো জায়গায়ই তোরণ বসানো হোক না কেন, প্রাকৃতিক নিয়মে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ওইসব তোরণ ছোঁয়ার সাহস কারও থাকে না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসবের নির্মাতা থাকে সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকরা।
এছাড়াও রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা অথবা মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার কষ্ট শিকার করতে হয় বয়েজ গাইড ও গার্লস গাইডদের। সরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর বেশকিছু দিবস পালিত হয়। এই দিবস উদযাপনের পূর্বশর্ত মিছিল ও সেমিনারে উপস্থিতি দেখানোর জন্য বয়েজ গাইড ও গার্লস গাইডদের প্রয়োজন হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলটি সরকারকে ব্যবহার করলেও এক্ষেত্রে খুবই অসহায় বোধ করেন। কারণ পয়সা দিয়ে জনসভার লোক আনা গেলেও দিবস উদযাপনের মিছিলে যোগ দেয়ার জন্য লোক আনা যায় না। এক্ষেত্রে বিপদে পড়েন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তা, ব্যক্তি ও কর্মচারীরা। যেমন করেই হোক মিছিলে লোক আনতে হবে এবং প্রধান অতিথিকে খুশি করতে হবে। এই একদিনের দুই বা তিন ঘণ্টার জমায়েত দিয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি কী প্রমাণ করতে চান তা স্পষ্ট নয়। কারণ তারা তো ক্ষমতার অধিকারী হয়েই আছেন। এই জমায়েতের আরেকটি উপসর্গ লোক জড়ো করে স্বদেশ প্রত্যাগত নেতা বা নেত্রীকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংবর্ধনা জ্ঞাপন। এর ফলে ওই নেতা বা নেত্রী এবং দেশের কোনো ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় কিনা তা তারা ভেবে দেখেন না। অর্থ ও হুকুম দিয়ে জড়ো করা জনতার ভক্তি ও স্লোগানে তারা মনে করেন দেবতার আসনে বসে গেছেন। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ এসব কর্মকাণ্ডকে অভিসম্পাত দেয়, তা তারা জানেন না।
একই তারিখে অর্থাত্ ১৪ ফেব্রুয়ারি আরেকটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়—‘একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনারে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, পৌর চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীরা ফুল দিচ্ছে—এমন একটি ভিডিও চিত্র (ডামি) গত ৮ ফেব্রুয়ারি ধারণ করা হয়েছে। মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এ চিত্র ধারণ করা হয়। এসময় শহর ও আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস বন্ধ করে রোদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জড়ো করা হয় সেখানে। ক্লাস বন্ধ করে রোদের মধ্যে সেখানে শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেক অভিভাবক। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বাংলার পৌরকথা’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। ওই অনুষ্ঠানের ভিডিও চিত্র ধারণের জন্য পৌর মেয়র রমজান আলী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীদের মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বলেন। তার কথামত গত ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম জরিনা ডিগ্রি কলেজ, দোয়াত আলী দাখিল মাদ্রাসা, মানিকগঞ্জ শিশু মঞ্জুরি স্কুল, মানিকগঞ্জ ৮৮ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রমজান আলী কলেজ, আফরোজা রমজান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নাবারুণ শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পয়রা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয় শতাধিক শিক্ষার্থীসহ ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অভিভাকেরা সেখানে উপস্থিত হন। এরপর সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত রোদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। বেলা পৌনে ১২টায় সেখানে উপস্থিত হন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ মালেক সালেহ উদ্দিন। পৌর মেয়র রমজান আলী আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কর্মস্থল রেখে সেখানে অংশ নেন। দুপুর ১২টার দিকে সাংসদ ও জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দেয়া হয়। এসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ক্যামেরা না থাকলেও স্থানীয়ভাবে এসব দৃশ্য ধারণ করা হয়। এসব দৃশ্য ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ধারণ করা বলে বিটিভির ওই অনুষ্ঠানে সম্প্রচারিত হওয়ার কথা রয়েছে। শহরতলির নয়াকান্দি এলাকায় দোয়াত আলী দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মনিরুজ্জামান তার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে সকাল ১০টায় সেখানে উপস্থিত হন। তিনি জানান, পৌর মেয়র রামজান আলীর নির্দেশে ক্লাস বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। ৮৮ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ মতিউর রহমান বলেন, পৌর মেয়র রমজান আলীর নির্দেশেই তিনি তার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। মানিকগঞ্জ শিশু মঞ্জুরি স্কুলের প্রথম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর মা প্রতিমা সরকার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ক্লাস বন্ধ করে রোদের মধ্যে শিশুদের দাঁড় করিয়ে রাখা অত্যন্ত অমানবিক। মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক জিএম সালেহ্ উদ্দিন বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি ১১টার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বাংলার পৌরকথা’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে। সোমবার তারই ডামি চিত্র ধারণ করা হয়। স্কুল ছুটি দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত করা এবং রোদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের দাঁড় করিয়ে রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষই তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসে। এজন্য কাউকে চাপ প্রয়োগ করা হয়নি।’ এ ধরনের কর্মকাণ্ডের নিন্দা বা সমালোচনা করে কোনো সংশোধনের পথ বের করা যাবে না। কারণ বর্তমান সরকারও ক্ষমতায় আসার পর এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল। অতীতেও এ ধরনের হুশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ ও শিক্ষার্থীকে সময় নষ্ট করে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে আত্মতৃপ্তি বোধের নগ্নতা ও অশ্লীলতার কোনো সমাধান হয়নি। অমার্জিত ক্ষমতা, বিত্ত ও প্রভাবের বিনিময়ে এই ক্ষমতাধরেরা যে মানসিকতার পরিচয় দেন তার কোনো সমর্থন নেই।
এদেশের অনেক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সময়ে ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য দেশবাসীকে উপদেশ দেন। সেই ভারতই অতিসম্প্রতি মহাসড়কে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও সোনিয়া গান্ধীর প্রতিকৃতি সংবলিত বিলবোর্ড লাগানোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই একটি ব্যাপারে তারা তো ভারতের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। মনে রাখা প্রয়োজন, আত্মতুষ্টি কখনোই সাফল্যের চাবিকাঠি হয় না। এবং যারা রোদে দাঁড়িয়ে রোদে দগ্ধ হয়, তারা ওই কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ দেয় না, মনে মনে অভিসম্পাত দেয়।
No comments