বাঘা তেঁতুল-বিপ্লবীদের ঝাপসা স্মৃতি by সৈয়দ আবুল মকসুদ
সিরাজ শিকদার কবিতা লিখতেন, আমিও কবিতা লিখতাম। তিনি যে ছাত্র সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন, আমি সেই সংগঠনের একজন নগণ্য কর্মী ছিলাম। তিনি শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে বিপ্লব ঘটাতে চাইতেন, আমি নিরাপদ দূরত্বে থেকে বিপ্লবকে স্বাগত জানাতাম।
তাঁর সাহস ছিল, আমার ছিল সাহসের অভাব। তিনি তাঁর আদর্শের জন্য জীবন দিয়েছেন, আমি আপস-টাপস করে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি।
আমি অল্প কয়েকজন অত্যন্ত সৎ, আধা-সৎ এবং অসংখ্য অসৎ খ্যাতিমান মানুষ দেখেছি। তার মধ্যে বাম ঘরানার তিনজনকে আবার মনে হয়েছে সৎ। তাঁরা হলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, সিরাজ শিকদার ও কর্নেল আবু তাহের। তাঁরা ছিলেন বিপ্লবপন্থী। সৌভাগ্যক্রমে এই তিনজনের সঙ্গেই জানাশোনা ছিল। তাঁদের কর্মকৌশল সর্বদা বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সম্মান ও সমর্থন না করে পারিনি।
সেকালের বাম নেতাদের মধ্যে মোহাম্মদ তোয়াহার সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল একটু বেশি। যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে ব্যক্তিগত। কারণ, তিনি ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সানাউল হক, এ কে নাজমুল করিম ও সৈয়দ নূরুদ্দীনের সহপাঠী ও বন্ধু। তাঁরা স্নেহ করতেন বলে কমরেড তোয়াহাও স্নেহ করতেন।
সিরাজ শিকদারের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৬ সালে, পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনের সময়। কিন্তু পরিচয় হলেও তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা সামান্যই হয়েছে। ঘনিষ্ঠভাবে বার দুয়েকের বেশি নয়। তাও স্বাধীনতার আগে। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে বছর চারেকের বড়। লারমা ও তাহের ছিলেন আরও কয়েক বছরের বড়। কিন্তু শেষ দুই বিপ্লবপন্থীর সঙ্গেই বরং ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি এবং সেটা স্বাধীনতার পরে। তখন সিরাজ শিকদার অনেক দূরে চলে গেছেন।
১৯৬৭ সালে সিরাজ শিকদার ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) একজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁর মতো নেতা অনেকেই ছিলেন। তাঁকে অসাধারণ বলে মনে হতো না। কিন্তু ১৯৬৮ সালে তিনি যখন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন, তখন দেখলাম যে তিনি অনেকের একজন নন। অন্য রকম মানুষ। সংকল্পে কঠিন। তারপর ‘মাও সে-তুং গবেষণাকেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার পর বোঝা গেল, তিনি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিছু সহযোগীও তৈরি করছেন। আমি যাইনি, আমার অনেক বন্ধু তাঁর কেন্দ্রে যেতেন। ওই সময়ই বকশীবাজারের এক সস্তা রেস্তোরাঁয় তাঁর সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ কথা হয়। তাঁর একটি কথাই আমার মনে আছে। বলেছিলেন, মওদুদীর জামায়াতে ইসলামী আমাদের পেছনে লেগেছে। তার কয়েক দিন পরেই মোনায়েম খানের পুলিশ মাও সে-তুং কেন্দ্র তালা লাগিয়ে দেয়। সিরাজ শিকদার প্রথমেই শিকার হন ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর।
১৯৭০-৭১ সাল নাগাদ পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে। কয়েকটি শিল্প-অঞ্চল ও গ্রামে কৃষকের মধ্যেই বেশি কাজ শুরু করে। তিনি গঠন করেন বিপ্লবী পরিষদ। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মে-জুনের দিকে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী বললেন, সিরাজ শিকদার বরিশালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। জানা গেল, তিনি পূর্ব বাংলা সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী গঠন করেছেন। স্বরূপকাঠির পেয়ারাবাগানে তাঁর মূল ঘাঁটি। তবে একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গেও তাঁর বিরোধ ছিল।
সিরাজ শিকদারের লক্ষ্য ছিল শুধু পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করা নয়, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। তিনি গঠন করেন শ্রমিক-কৃষকদের রাজনৈতিক সংগঠন ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’। বায়াত্তরে সর্বহারা পার্টির প্রথম কংগ্রেসে দলের রণকৌশল গ্রহণ করেন। নতুন মার্ক্সবাদী তত্ত্ব দাঁড় করান। সশস্ত্র বিপ্লবই লক্ষ্য। বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের পরে গঠন করেন ‘পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’। তিনি ছিলেন তার প্রধান। ১৯৭৪ সালে তিনি আত্মগোপনে যান।
১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হালিশহরে গোয়েন্দা সদস্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। ওই দিনই তাঁকে বিমানে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন শেরেবাংলা নগর থেকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন। তখন তাঁর পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা ছিল। সুতরাং ক্রসফায়ার বলা যাবে না।
শিকদারকে হত্যা করেন রাষ্ট্রের আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন তাঁরই সহকর্মী বন্ধু এবং লারমাকে হত্যা করেন তাঁর সংগঠনের লোকেরা। তাঁদের স্মৃতি কখনো হানা দেয়। বিপ্লববাদীদের ব্যর্থতা বলে কিছু নেই, বরং দৈবাৎ সফল হলেই তা বিস্ময়কর।
সিরাজ শিকদারদের মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ মাহফিলে দুই হাত তুলে কেউ মোনাজাত করবে না। টিভি চ্যানেলের পর্দা সত্য-মিথ্যায় উচ্চ কণ্ঠে উত্তাল হয়ে উঠবে না। লাখ টাকা খরচ করে সেমিনার বসবে না। কাগজের আধা ইঞ্চি জায়গাও তাঁদের জন্য উৎসর্গ করা হয় না।
রাজনীতিতে যাঁরা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আদর্শের জন্য আত্মদান করেন, তাঁদের পথটা সঠিক যদি না-ও হয়, তবু জগতের মানুষ ত্যাগের জন্য তাঁদের সম্মানটা করে। রাজনৈতিক মতাদর্শনির্বিশেষে চে গুয়েভারা দুনিয়ার দেশে দেশে মর্যাদা পান। একটি জীর্ণ ও পচা সমাজ পরিবর্তনের জন্য এবং একটি শোষক-নিপীড়ক রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলানোর লক্ষ্যে ভুল পদ্ধতিতেও যদি কেউ সংগ্রাম করেন, তাঁকে অস্বীকার ও অবহেলা করা যায় না। পৃথিবীর প্রগতির যাত্রায় তাঁদের পরোক্ষ ভূমিকা সামান্য নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আমি অল্প কয়েকজন অত্যন্ত সৎ, আধা-সৎ এবং অসংখ্য অসৎ খ্যাতিমান মানুষ দেখেছি। তার মধ্যে বাম ঘরানার তিনজনকে আবার মনে হয়েছে সৎ। তাঁরা হলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, সিরাজ শিকদার ও কর্নেল আবু তাহের। তাঁরা ছিলেন বিপ্লবপন্থী। সৌভাগ্যক্রমে এই তিনজনের সঙ্গেই জানাশোনা ছিল। তাঁদের কর্মকৌশল সর্বদা বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সম্মান ও সমর্থন না করে পারিনি।
সেকালের বাম নেতাদের মধ্যে মোহাম্মদ তোয়াহার সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল একটু বেশি। যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে ব্যক্তিগত। কারণ, তিনি ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সানাউল হক, এ কে নাজমুল করিম ও সৈয়দ নূরুদ্দীনের সহপাঠী ও বন্ধু। তাঁরা স্নেহ করতেন বলে কমরেড তোয়াহাও স্নেহ করতেন।
সিরাজ শিকদারের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৬ সালে, পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনের সময়। কিন্তু পরিচয় হলেও তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা সামান্যই হয়েছে। ঘনিষ্ঠভাবে বার দুয়েকের বেশি নয়। তাও স্বাধীনতার আগে। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে বছর চারেকের বড়। লারমা ও তাহের ছিলেন আরও কয়েক বছরের বড়। কিন্তু শেষ দুই বিপ্লবপন্থীর সঙ্গেই বরং ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি এবং সেটা স্বাধীনতার পরে। তখন সিরাজ শিকদার অনেক দূরে চলে গেছেন।
১৯৬৭ সালে সিরাজ শিকদার ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) একজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁর মতো নেতা অনেকেই ছিলেন। তাঁকে অসাধারণ বলে মনে হতো না। কিন্তু ১৯৬৮ সালে তিনি যখন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন, তখন দেখলাম যে তিনি অনেকের একজন নন। অন্য রকম মানুষ। সংকল্পে কঠিন। তারপর ‘মাও সে-তুং গবেষণাকেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার পর বোঝা গেল, তিনি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিছু সহযোগীও তৈরি করছেন। আমি যাইনি, আমার অনেক বন্ধু তাঁর কেন্দ্রে যেতেন। ওই সময়ই বকশীবাজারের এক সস্তা রেস্তোরাঁয় তাঁর সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ কথা হয়। তাঁর একটি কথাই আমার মনে আছে। বলেছিলেন, মওদুদীর জামায়াতে ইসলামী আমাদের পেছনে লেগেছে। তার কয়েক দিন পরেই মোনায়েম খানের পুলিশ মাও সে-তুং কেন্দ্র তালা লাগিয়ে দেয়। সিরাজ শিকদার প্রথমেই শিকার হন ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর।
১৯৭০-৭১ সাল নাগাদ পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে। কয়েকটি শিল্প-অঞ্চল ও গ্রামে কৃষকের মধ্যেই বেশি কাজ শুরু করে। তিনি গঠন করেন বিপ্লবী পরিষদ। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মে-জুনের দিকে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী বললেন, সিরাজ শিকদার বরিশালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। জানা গেল, তিনি পূর্ব বাংলা সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী গঠন করেছেন। স্বরূপকাঠির পেয়ারাবাগানে তাঁর মূল ঘাঁটি। তবে একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গেও তাঁর বিরোধ ছিল।
সিরাজ শিকদারের লক্ষ্য ছিল শুধু পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করা নয়, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। তিনি গঠন করেন শ্রমিক-কৃষকদের রাজনৈতিক সংগঠন ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’। বায়াত্তরে সর্বহারা পার্টির প্রথম কংগ্রেসে দলের রণকৌশল গ্রহণ করেন। নতুন মার্ক্সবাদী তত্ত্ব দাঁড় করান। সশস্ত্র বিপ্লবই লক্ষ্য। বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের পরে গঠন করেন ‘পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’। তিনি ছিলেন তার প্রধান। ১৯৭৪ সালে তিনি আত্মগোপনে যান।
১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হালিশহরে গোয়েন্দা সদস্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। ওই দিনই তাঁকে বিমানে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন শেরেবাংলা নগর থেকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন। তখন তাঁর পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা ছিল। সুতরাং ক্রসফায়ার বলা যাবে না।
শিকদারকে হত্যা করেন রাষ্ট্রের আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন তাঁরই সহকর্মী বন্ধু এবং লারমাকে হত্যা করেন তাঁর সংগঠনের লোকেরা। তাঁদের স্মৃতি কখনো হানা দেয়। বিপ্লববাদীদের ব্যর্থতা বলে কিছু নেই, বরং দৈবাৎ সফল হলেই তা বিস্ময়কর।
সিরাজ শিকদারদের মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ মাহফিলে দুই হাত তুলে কেউ মোনাজাত করবে না। টিভি চ্যানেলের পর্দা সত্য-মিথ্যায় উচ্চ কণ্ঠে উত্তাল হয়ে উঠবে না। লাখ টাকা খরচ করে সেমিনার বসবে না। কাগজের আধা ইঞ্চি জায়গাও তাঁদের জন্য উৎসর্গ করা হয় না।
রাজনীতিতে যাঁরা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আদর্শের জন্য আত্মদান করেন, তাঁদের পথটা সঠিক যদি না-ও হয়, তবু জগতের মানুষ ত্যাগের জন্য তাঁদের সম্মানটা করে। রাজনৈতিক মতাদর্শনির্বিশেষে চে গুয়েভারা দুনিয়ার দেশে দেশে মর্যাদা পান। একটি জীর্ণ ও পচা সমাজ পরিবর্তনের জন্য এবং একটি শোষক-নিপীড়ক রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলানোর লক্ষ্যে ভুল পদ্ধতিতেও যদি কেউ সংগ্রাম করেন, তাঁকে অস্বীকার ও অবহেলা করা যায় না। পৃথিবীর প্রগতির যাত্রায় তাঁদের পরোক্ষ ভূমিকা সামান্য নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments