চারদিক-কহে বীরাঙ্গনা by আকমল হোসেন

কুয়াশায় মোড়ানো সন্ধ্যা। শীত পড়েছে। কুয়াশার জন্যই হয়তো সন্ধ্যার অন্ধকারও বেশ গাঢ়। পাকা সড়ক থেকে মেঠোপথে নেমে এসেছি। গন্তব্য ঘোড়ামারা গ্রামের একটি বাড়ি। বাড়ি বলা যায়, আবার বাড়িও নয়। একটি নাট্যমঞ্চের খোঁজে এই কুয়াশাকাটা পথ।


শহুরে সুযোগবঞ্চিত ঘোড়ামারায় মণিপুরি থিয়েটার তৈরি করেছে নিজস্ব নাট্যমঞ্চ নটমণ্ডপ। ওই মঞ্চেই তারা নাটক মঞ্চায়ন করছে।
তখনো নাটক শুরু হয়নি। খানিক আগে একটি ‘শো’ শেষ হয়েছে। গ্রামের মেঠোপথ ধরে দর্শকেরা আসছেন। ঘোড়ামারা মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের মণিপুরি-অধ্যুষিত একটি গ্রাম। দর্শকদের বেশির ভাগই মণিপুরি সম্প্রদায়ের। দর্শকেরা এসে নাটক দেখবেন বলে টিকিট কিনছেন। টিকিট হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছেন, কখন মিলনায়তনে ঢোকার ঘণ্টা বাজবে। একসময় ঘণ্টা বাজল। সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন। কোনো হইচই নেই। টিকিট দেখিয়ে নারী-পুরুষ মিলনায়তনে প্রবেশ করলেন। অমন এক দূরপ্রান্তিক জনপদ কিংবা গ্রামে আধুনিক শৈলীর নাটক, যেন নগর ও গ্রামের ব্যবধানকে মনেই রাখতে চায় না।
আলো-আঁধারির মধ্যে মঞ্চে এলেন শুভাশিস সিনহা। সূচনাভাষ্যে জানালেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য থেকে মণিপুরি থিয়েটার তৈরি করেছে নাট্যকাব্য কহে বীরাঙ্গনা। নাট্যকাব্যটির নাট্যপরিকল্পনা, সুর সংযোজনা ও নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। জানা গেল, মণিপুরি থিয়েটার বরাবরই মণিপুরি ভাষায় নাটক করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু কাব্য ও নাটক মণিপুরি ভাষায় রূপান্তর করে মঞ্চে এনেছে মণিপুরি থিয়েটার। কিন্তু এই প্রথম তারা একেবারেই বাংলায় ক্ল্যাসিক কোনো বাঙালি কবির মূল ‘টেক্সট’ নিয়ে কাজ করছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বীরাঙ্গনা কাব্য-এ মহাভারতের বিরহ যাতনাকাতর নারীদের এগারোটি সর্গে রক্তক্ষরণ প্রবাহিত করেছেন। সেখান থেকে চারটি সর্গ নির্বাচন করেছে মণিপুরি থিয়েটার। দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা ও নীলধ্বজের প্রতি জনা।
অরণ্যের আভাস ফোটানো মঞ্চ থেকে আমাদের চোখ সরে না। মঞ্চে আসেন শকুন্তলা। দুষ্মন্তের উদ্দেশে তাঁর বিরহজনিত মনঃকষ্ট ও যন্ত্রণার কথা চিঠিতে লিপিবদ্ধ করে পাঠান। কাব্যভাষারূপের সেই চিঠিতে ফুটে ওঠে এক নারীর বেদনারোদন। অর্জুনের বিরহকাতর আরেক নারী দ্রৌপদী। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলায় পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছিলেন, বীর অর্জুন শত্রু দমনের উদ্দেশ্যে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে সুরপুরে চলে যান। সুরপুরে অর্জুনের ভোগবিলাসের কথা ভেবে ঈর্ষা, ক্ষোভ ও মর্মবেদনায় জর্জরিত দ্রৌপদী দেবী একটি পত্র লেখেন অর্জুনকে। একইভাবে সিন্ধুদেশাধিপতি জয়দ্রথের স্ত্রী দুঃশলা দেবী যুদ্ধক্ষেত্রে স্বামীর সমূহ বিপদ জেনে কেঁপে ওঠেন। অন্যায়ভাবে কৌরবেরা অর্জুনপুত্র অভিমন্যুকে বধ করায় সেই হত্যাকর্মের অন্যতম হোতা জয়দ্রথকে নিজ হাতে বিনাশ করতে অর্জুন উন্মাদপ্রায়। অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রের দূত সঞ্জয়ের মুখে এই সংবাদ শুনে জয়দ্রথের কাছে একটি চিঠি লিখে পাঠান দুঃশলা। সেই চিঠি যেমন ছিল স্বামীর প্রতি আকুল ভালোবাসায় ভরপুর, তেমনই যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তিগুলোর ব্যাখ্যা করে স্বামীকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। কৌরবেরাও যে অনেক অন্যায় করেছে, স্বামীকে সেই কথাও মনে করিয়ে দেন চিঠিতে। দুঃশলা হয়ে ওঠেন এক রাজনীতি-প্রজ্ঞাসম্পন্ন নারী। যে নারী স্বপ্ন দেখেন শান্তির, প্রেমের ও স্বপ্নময় জীবনের, যেখানে আছে আত্মার মুক্তি। মাহেশ্বরপুরীর রাজা নীলধ্বজের পুত্র প্রবীর যুদ্ধে অর্জুনের হাতে নিহত হলেন। কিন্তু রাজা নীলধ্বজ রায় অর্জুনের সঙ্গে লড়াইয়ে গেলেন না, উল্টো তাঁর সঙ্গে সন্ধি করলেন। এতে নীলধ্বজ রায়ের পত্নী জনা পুত্রশোকে কাতর, বিক্ষুব্ধ ও প্রায় উন্মাদিনী হয়ে ওঠেন। পুত্রশোকাতুর এক মা স্বামীর কাছে চিঠি লেখেন, তাতে অর্জুনের ভয়ে হার মানা স্বামীর প্রতি শ্লেষ, ব্যঙ্গ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও মৃত পুত্রের জন্য আকাশচেরা হাহাকার যেন আর্তনাদ করে ওঠে। দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতক সব কাপুরুষকে যেন তাঁর অশ্রুরক্তক্ষরিত ভাষা বিদ্ধ করে। অনেক নারীর আবেগ ও দ্রোহের প্রকাশশালা হয়ে ওঠে মণিপুরি থিয়েটারের নটমণ্ডপ।
আর এই যে মঞ্চে একে একে ওঠে আসেন শকুন্তলা, দ্রৌপদী, দুঃশলা ও জনা, তাদের দেহে ও ভাষায় ধারণ করেন শিল্পী জ্যোতি সিনহা। কাব্যভাষার উচ্চারণ, স্বরক্ষেপণ, গীতি ও ছন্দোময় অভিনয়শৈলী, জ্যোতি সিনহা যেন চার দেহের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে অসংখ্য বিরহকাতর, ক্ষুব্ধ ও দ্রোহী নারী। অথবা অসংখ্যজনের আকুলতা ধারণ করা একজন। নিজেকে শকুন্তলা, দ্রৌপদী, দুঃশলা ও জনা থেকে বিচ্ছিন্ন না করার প্রাণান্ত চেষ্টা মঞ্চের প্রতিটি মুহূর্তে জ্যোতি সিনহা করে গেছেন। এক দূর গ্রামে এমন একটি নাট্যকাব্য, এটা ভাবতেই ভালো লাগে। মণিপুরি থিয়েটার একলা আগুন জ্বালিয়ে নিজেদের খাঁটি সোনা করছে। যেখানে শহর বা গ্রাম বলে কিছু নেই। চাইলে পথের দূরত্ব কত নিমেষেই মুছে যেতে পারে। জ্যোতি সিনহার সঙ্গে ভাবমুদ্রা রূপায়ণে স্মৃতি সিনহা, শুক্লা সিনহা, সুনন্দা সিনহা ও ভাগ্যলক্ষ্মী সিনহা, সংগীতে শর্মিলা সিনহা, বাদ্যে বিধান চন্দ্র সিংহ, লক্ষ্মণ সিংহ—সবাই ছিলেন কহে বীরাঙ্গনার আপন পথিক। গ্রাম-জনপদে পথ চেনার অন্য আলো হতে পারে মণিপুরি থিয়েটার, কিংবা কহে বীরাঙ্গনা।
এ নাটক দেখলে এক অন্য রকম অনুভূতির জন্ম হয় মনে। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ২৫ ডিসেম্বর।

No comments

Powered by Blogger.