তৈরি পোশাক-নতুন বছরে বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ by সালাম হোসেন চৌধুরী

নতুন বছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য রয়েছে স্বস্তিদায়ক সুখবর। শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় কমিশন আমদানি পণ্যের জন্য তাদের রুলস অব অরিজিন পরিবর্তন করেছে। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি দ্রুত বাড়বে।


বাংলাদেশের অনেক রপ্তানি পণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠিন রুলস অব অরিজিনের কারণে শুল্ক সুবিধা পেত না। এর মধ্যে প্রধান পণ্য ‘তৈরি পোশাক’। ২০০৯ সালে ইউরোপে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে চিংড়ি মাছ বাদে শুল্ক সুবিধা পেয়েছে মাত্র ৭০ শতাংশ পণ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইউরোপে রপ্তানি করা ১০০ শার্টের মধ্যে ৩০টির ক্ষেত্রে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়েছে। কারণ এগুলো বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল বিদেশ থেকে আমদানি করা কাপড় দিয়ে।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিশন নতুন রুলস অব অরিজিন-সংক্রান্ত আদেশটি অনুমোদন করেছে। সংশ্লিষ্ট আদেশটি আইন নয়, একটি বিধান। এ কারণে এ বিষয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়নি। তবে বিধিটি ইউরোপীয় কমিশনের তথ্যতীর্থ থেকে উদ্ধার করা সহজ নয়। ইউরোপীয় কমিশনের ওয়েবসাইট বা তথ্যতীর্থ রীতিমতো একটি মহাসমুদ্র; সঠিক ঠিকানা না জানা থাকলে এর মধ্য থেকে কাঙ্ক্ষিত আইন, বিধিমালা বা আদেশ খুঁজে বের করা খুবই দুঃসাধ্য।
গত নভেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রসচিব অ্যালিসা এয়ার বাংলাদেশ ভ্রমণ করে গেলেন। এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা নানা রাজনৈতিক প্রশ্নবাণে তাঁকে অস্থির করে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএর সভাপতি তখনো সভাস্থলে পৌঁছাতে পারেননি। এ অবস্থায় রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি নাসিম মঞ্জুর। তিনি বললেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চাই না; আমরা চাই বাজারে অবাধ প্রবেশের সুবিধা।’ তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের জন্য শুল্কবিহীন প্রবেশাধিকারের দাবিটি পুনর্ব্যক্ত করলেন। দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি ঝুলে আছে, অনেক তদবির সত্ত্বেও তেমন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিষয়টিও দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল। ২০০৫ সালে কোটা প্রথা উঠে যায়। এর অনেক আগে, সেই ২০০১ সালে পাসকাল লামি যখন ইউরোপীয় কমিশনের ট্রেড কমিশনার, তখন স্বল্পোন্নত দেশ অর্থাৎ এলডিসিগুলোর জন্য জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সের (জিএসপি) আওতায় ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) নামীয় শুল্ক মওকুফের সুবিধা প্রবর্তন করা হয়। এতে বাংলাদেশসহ ৪৯ এলডিসির ‘অস্ত্র বাদে সব পণ্য’ ইউরোপে শূন্য আমদানি শুল্কের সুবিধা লাভ করে। কেবল মূল্য সংযোজন কর আদায় করা অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশসহ সব এলডিসি ইউরোপের এই সুবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি। শুল্ক যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ প্রধান অন্তরায়, তা আবার বোঝা গেল।
কিন্তু অচিরেই দেখা গেল, সম্পূর্ণ শুল্ক মওকুফের বিধান ইবিএ প্রবর্তন সত্ত্বেও রুলস অব অরিজিনের কারণে অনেক বাংলাদেশি পোশাকের চালানকে যথাযোগ্য আমদানি শুল্ক দিয়েই ইউরোপের মাটিতে প্রবেশ করতে হচ্ছে। ইবিএর সুবিধা পেতে ব্যর্থ হচ্ছে বিশেষ করে ওভেন পোশাক শার্ট, প্যান্ট, ব্লাউজ, স্কার্ট ইত্যাদি। সোয়েটারের ক্ষেত্রে তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না। নিট পোশাক যেমন টি-শার্ট ইত্যাদি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের কারণে তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল।
ইউরোপীয় কমিশনের রুলস অব অরিজিন অনুযায়ী শূন্য শুল্কের সুবিধা পেতে হলে হয় বাংলাদেশের কারখানায় প্রস্তুত করা পণ্যে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের হার কমপক্ষে ৭০ শতাংশ হতে হবে। এই শর্ত পূরণ করা অনেক পণ্যের ক্ষত্রে সম্ভব হতো না। বিকল্প যে বিধি ছিল, তা হলো এই যে মূল্য সংযোজনের হার নির্বিশেষে রপ্তানি পণ্যটিকে কমপক্ষে দুই স্তরে প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। অর্থাৎ কাপড় থেকে পোশাক তৈরি করলে হবে না, যদি প্রথমে সুতা থেকে কাপড় এবং সেই কাপড় থেকে পোশাক তৈরি করা হয় অর্থাৎ যদি দুই স্তরে প্রক্রিয়াজাত হয় পণ্য, তবে ইবিএর আওতায় আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ মওকুফ হবে।
বাংলাদেশ ২০০৩ থেকেই বিষয়টি ইউরোপীয় কমিশনের নজরে আনে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাণিজ্যসচিব সোহেল আহমেদ চৌধরী ২০০৩ সালে দুবার ব্রাসেলস সফর করে রুলস অব অরিজিনের কঠিন শর্ত শিথিল করার দাবি পেশ করেন। ব্রাসেলস মিশনের মিনিস্টার কমার্শিয়াল এ বিষয়ে জোর কার্যক্রম নিতে থাকেন।
বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল দ্বিবিধ: হয় স্থানীয় মূল্য সংযোজনের হার সর্বনিম্ন ৭০ থেকে ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক, নতুবা দুই স্তর প্রক্রিয়াজাতকরণের পরিবর্তে এক স্তর প্রক্রিয়াজাতকরণের বিধান করা হোক। সরকারি প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে বিজেএমইএ জোর তদবির শুরু করে। সভাপতি আনিসুল হকের নেতৃত্বে দুবার এবং সভাপতি পারভেজের নেতৃত্বে একবার বিজেএমইর দল ব্রাসেলস সফর করে এবং ট্রেড কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করে। এ ব্যাপারে নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। আর টেক্সটাইলস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সরাসরি বিরোধিতা করে।
এ রকম একটি পরিস্থিতিতে ২০০৫ সালের মার্চ মাসে ইউরোপীয় কমিশন নতুন রুলস অব অরিজিনের খসড়া ঘোষণা করে এবং ১ জুন থেকে তা কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সদস্য দেশগুলো নতুন রুলস অব অরিজিন নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় সেক্টোরাল স্টাডি। প্রস্তাবিত রুলস অব অরিজিন বাস্তবায়িত হলে কোন কোন অর্থনৈতিক খাতে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে গবেষণা হতে থাকে। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিধি বেড়ে যায়। ১৫ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও ১০টি নতুন ইউরোপীয় রাষ্ট্র। ফলে নতুন রুলস অব অরিজিন বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সময় পার হয়ে যায়, ইউরোপীয় কমিশন আর সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হয় না।
শেষাবধি প্রস্তাবের সাড়ে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পরে ১৮ নভেম্বর ২০১০ সালে কমিশনারদের সভায় নতুন রুলস অব অরিজিন গৃহীত হয়। এটি ইউরোপীয় কমিশনের একটি রেগুলেশন বা বিধান। ইন্টারনেটে কমিশনের তথ্যতীর্থ থেকে খুঁজে পেতে হলে এর নম্বরটি উপকারে লাগবে: ‘ইউরোপীয় রেগুলেশন (ইউ) নম্বর ১০৬৩/২০১০’। এর দ্বারা সেই ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিদ্যমান ‘ইইসি ২৪৫৯/৯৩’ নম্বরধারী বিধানটি পরিবর্তিত হলো। নুতন বিধানের মোদ্দাকথা এই যে, কাপড় যে দেশেই প্রস্তুত হোক না কেন, পোশাকটি বাংলাদেশে প্রস্তুত হলে তা ইবিএ সুবিধার আওতায় সম্পূর্ণ শুল্কমুক্তভাবে ইউরোপের বাজারে প্রবেশাধিকার পাবে।
এ জন্যই দেশের বস্ত্র নির্মাতারা শঙ্কিত। তাঁরা ভাবছেন, এবার দেশীয় কাপড় বাদ দিয়ে কেবল বিদেশ থেকে আমদানি করা কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করবেন রপ্তানিকারকেরা। বাস্তবে কী ঘটবে তা বলা মুশকিল। দেশীয় কাপড় ব্যবহারের সুবিধা অনেক। মানমতো পাওয়া গেলে দেশীয় কাপড় সংগ্রহ ঝামেলামুক্ত। আমার ধারণা, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি দুই বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হবে এবং এর ফলে দেশীয় কাপড়ের চাহিদাও কার্যত বাড়বে।
কেবল তৈরি পোশাক নয়, আরও কিছু নির্দিষ্ট ম্যানুফ্যাকচার্ড পণ্যের ক্ষেত্রেও এই শর্ত প্রযোজ্য। বাংলাদেশসহ ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশ এই সুবিধা ভোগ করবে। আমাদের নিকট-প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এই সুবিধা পাবে না। শ্রীলঙ্কা অতি নিম্ন আয়ের দেশ হয়েও এই সুবিধা পাবে না, কারণ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় দেশটি অন্তর্ভুক্ত নয়।
অন্যদিকে আশঙ্কার কথা হলো, পাকিস্তান এই সুবিধার হকদার না হলেও সমরূপ সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরও একটি শুল্ক মওকুফ সুবিধা দিয়ে থাকে, যা ‘জিএসপি প্লাস’ নামে সমধিক পরিচিত। পাকিস্তান তদবির করছে এই সুবিধা লাভের জন্য। বাংলাদেশের ব্রাসেলস মিশনে প্রায় দুই বছর ধরে বাণিজ্যিক শাখায় কোনো কর্মকর্তা পদস্থ নেই। সুতরাং এ বিষয়ে ব্রাসেলস মিশন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে—এ রকম কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী ইউরোপীয় কমিশনে গিয়ে তদবির করবেন পাকিস্তানের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে—এমন কোনো কর্মসূচি এখন পর্যন্ত নেই। বিজিএমইএ-ও অদ্যাবধি কোনোরূপ পদক্ষেপ নেয়নি। এ অবস্থায় ভাগ্যই আমাদের ভরসা। পাকিস্তান যদি জিএসপি প্লাসের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে যায়, তবে বাংলাদেশকে অনুকূল রুলস অব অরিজিন সত্ত্বেও কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। সুখের কথা, এখনো সময় আছে। পাকিস্তানের প্রস্তাব কার্যকর করতে হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনুমোদন লাগবে। তা এখনো পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের প্রস্তাব হবে, পাকিস্তানকে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যান্য নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য কেবল সীমিত সময়ের জন্য (যেমন সর্বাধিক দুই বছর) শুল্ক মওকুফ দেওয়া যেতে পারে।
২০০৯ সালে ইউরোপে সবচেয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছিল বাংলাদেশের। এমনকি চীন, ভিয়েতনামও রপ্তানি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে ছিল; ভারত তো বটেই। ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আমাদের বিশ্বাস, ২০১১ সাল থেকে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি বৃদ্ধির হার বাৎসরিক ১৫ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নতুন রুলস অব অরিজিনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সুযোগ এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে চীনের বাজার দখল করার। ইউরোপের পোশাকবস্ত্র আমদানি বর্তমানে প্রায় ৭৫ মিলিয়ন ইউরো। এর মধ্যে চীনের রপ্তানি ৪১ শতাংশ, তুরস্কের ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ভারতের ৮ শতাংশ, বাংলাদেশের ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং তিউনিসিয়ার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশকে ২০১৫ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পোশাক বাজারের ন্যূনপক্ষে ১৪ শতাংশ দখলের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যেতে হবে।
সালাম হোসেন চৌধুরী: সাবেক সভাপতি, মেলা পর্ষদ, বিজিএমইএ।

No comments

Powered by Blogger.