শ্রদ্ধাঞ্জলি-একটি যুগের অবসান by অমর সাহা

চলে গেলেন তিনি। হঠাৎই সোমবার দুপুরে কলকাতার সংবাদমাধ্যমে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ল—তিনি আর নেই। পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে। ষাট দশক ধরে যিনি রবীন্দ্রসংগীতের সুরের জাদুতে বেঁধে রেখেছিলেন উপমহাদেশের গোটা বাংলাভাষীদের, তিনি হারিয়ে গেলেন সোমবার, ৩ জানুয়ারি দুপুরে, তাঁরই দক্ষিণ কলকাতার বাসভবনে।


তখন দুপুর একটা বেজে ৩০ মিনিট। নিজস্ব ফ্ল্যাটের ১১ তলা ভবনে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তিনি। তিনি সুচিত্রা মিত্র। সবার ভালোবাসার সুচিত্রাদি। রবীন্দ্রসংগীতের সম্রাজ্ঞী। অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। বাড়িতেই নিচ্ছিলেন চিকিৎসা।
১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্ম এই মহান শিল্পীর। বাবা ছিলেন সৌরীন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যিক। ১৯৩৫ সালে শৈশবে লেখাপড়া শুরু হয় বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে। ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেণীতে। ১৯৩৬ সালে প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী পংকজ মল্লিকের কাছে সংগীতে হাতেখড়ি নেন। ১৯৪১ সালে শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনে ছাত্রী হয়ে যোগ দেন। ওই সালেই অবশ্য তিনি বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। চলতে থাকে তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা। ১৯৪৪ সালে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রথম তাঁকে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে অভিনন্দন জানান।
১৯৪৫ সালে শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবন থেকে ডিপ্লোমা অর্জন করেন সুচিত্রা। ধ্রুপদ ও টপ্পাঙ্গের পূজা পর্যায়ের রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার জন্য তিনি লন্ডনের টেগোর হাইম সোসাইটির টেগোর হাইম পুরস্কার লাভ করেন। ওই বছরই তাঁর গাওয়া প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বের হয়। এর এক বছর পর রবীন্দ্রসংগীতের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রবিতীর্থ। ১৯৪৭ সালে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন। ওই বছরের ১ মে তিনি ধ্রুব মিত্রের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫০ সালের ২৩ জুন জন্ম হয় তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান কুণাল মিত্রের। কুণাল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের বাসিন্দা। ১৯৫১ সালে তৃতীয় বিশ্ব যুব উৎসবে যোগ দিতে তিনি প্রথম বিদেশে পাড়ি জমান। ১৯৫২-৫৫ সালের মাঝে প্রখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজ শান্তিনিকেতনে সুচিত্রা মিত্রের একটি আবক্ষ মূর্তি গড়েন। ১৯৫৫ সালে স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় সুচিত্রা মিত্রের। ১৯৬০ সালে দিল্লি থেকে প্রচারিত আকাশবাণীর জাতীয় অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। ১৯৬৩ সালে জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সুচিত্রা দাঁড়ান মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থীদের পাশে। ওই বছর উমাপ্রসাদ মৈত্রর পরিচালনায় তৈরি জয়বাংলা ছবিতে অভিনয়ও করেন তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। সুচিত্রা মিত্র ১৯৮৪ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অবসর নেন।
এই কিংবদন্তি শিল্পী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও সাহচর্য লাভ করেছিলেন।
এই প্রবাদপ্রতিম রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর সাড়ে চার শর বেশি রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বের হয়েছে। তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড হয় ১৯৪৫ সালে।
সুচিত্রা মিত্র সংগীতাঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী, বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আলাউদ্দিন পদক। আরও পেয়েছেন সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারসহ নানা সম্মান। সাম্মানিক ডি-লিট পেয়েছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা শেরিফ। সুচিত্রা মিত্রকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করেছেন পরিচালক রাজা সেন ও সুব্রত ঘোষ। তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
শিল্পীর প্রয়াণে ভারতজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। সংস্কৃতি মহলে ছড়িয়ে পড়ে শোক। সোমবার শিল্পীর মরদেহ রাখা হয় কলকাতার পিস হ্যাভেনে। মঙ্গলবার সকালে এই মহান শিল্পীর মরদেহ পিস হ্যাভেন থেকে নিয়ে যাওয়া হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। সেখানে শায়িত রাখা হয় ঘণ্টা খানেক। এখানেই বিশ্বভারতীর ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীসহ কলকাতার বিশিষ্টজনেরা রবীন্দ্রসংগীতের সুরের মূর্ছনার মধ্যে ফুল দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর শিল্পীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রবীন্দ্রসদনে। এখানে শ্রদ্ধা জানায় কলকাতার সর্বস্তরের মানুষ। শ্রদ্ধা জানান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর সহধর্মিণী মীরা ভট্টাচার্য এবং কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় থেকে কলকাতার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা।
শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব চক্রবর্তী, মিঠুন চক্রবর্তী, বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সুমিত্রা সেন, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, মোহন সিং, পূর্বা দাম, গোরা সর্বাধিকারী, শ্রাবণী সেন, লোপামুদ্রা মিত্র, নির্মলা মিশ্র, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈকত মিত্র, উষা উত্থুপ, অজিত পাণ্ডে, শ্রীকান্ত আচার্যসহ কলকাতার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা।
সুচিত্রা মিত্রের মৃত্যুতে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত জগতে বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থান করছিলেন তিনি। আজ সেই জায়গা শূন্য হয়ে গেল।’ মান্না দে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রসংগীতে ছিল তাঁর আলাদা মাত্রা।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীতকে করে তুলেছিলেন জনপ্রিয়।’ গোরা সর্বাধিকারী বলেছেন, ‘সুচিত্রাদি চলে যাওয়ায় রবীন্দ্রসংগীতের আর কিংবদন্তি শিল্পী বলে কেউ রইলেন না।’ সুমিত্রা সেন বলেছেন, ‘আমি ধন্য হয়েছি তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে। তিনি ছিলেন মহান এক শিল্পী।’ স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘আমরা হারালাম এক কিংবদন্তি শিল্পীকে।’ পূর্বা দাম বলেছেন, ‘উনি নেই, ভাবতেই পারছি না।’ লোপামুদ্রা মিত্র বলেছেন, ‘আমার ভাষা নেই। ভাবতেই পারছি না ওনাকে ছাড়া।’
মঙ্গলবার দুপুরে রবীন্দ্রসদন থেকে সুচিত্রা মিত্রের মরদেহ একটি বিশেষ শকটে করে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর গড়া রবিতীর্থে। এখান থেকেই দুপুরে মরদেহ নিয়ে শুরু হয় অন্তিমযাত্রা। শেষকৃত্যের জন্য মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। এই অন্তিমযাত্রায় অংশ নেয় কলকাতার হাজারো মানুষ। বিকেলে এখানেই সম্পন্ন হয় এই প্রথিতযশা শিল্পীর শেষকৃত্য। শেষ বিদায় জানান সুচিত্রাভক্তরা।

No comments

Powered by Blogger.