মুখোশের তলে মুখের সত্য by আল মাহমুদ
কেবলই মনে হয় আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে। আমার কাজটা কী? এ প্রশ্নের উত্তরে সবাই একবাক্যে বলবেন, লেখালেখির কাজ। কিন্তু আমি কি কেবলই লেখালেখি করে বেঁচেছি? তা তো নয়। লেখালেখি একটা বড় ব্যাপার ছিল আমার জীবনে।
সেটা মানলেও না লেখার কাজ অর্থাত্ অন্যবিধ কর্তব্যও আমি সমাপ্ত করার চেষ্টা করেছি। হয়তো পেরেছি। কিংবা বলা যায় ঠিকমত পারিনি। কিন্তু সেটাও আমি করেছি। ভালোভাবে পারিনি। এখন সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তো আর মুখ লুকোতে পারি না। আমিও তাকিয়ে থাকি মানুষের মুখের দিকে। শূন্য দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টিতে কোনো কিছুই দেখা যায় না। যে দৃষ্টি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত্ অতিক্রম করে এলোমেলোভাবে আমার উপরই ফিরে আসে। তখন আমি নিজকে দেখি এবং বিস্মিতভাবে মনে হয় এইতো একজন আগন্তুক।
তর্ক নেই, বিরোধ নেই, প্রশ্ন নেই। নিজেকে নিজের সামনে বসে খুঁটিয়ে দেখা। এই দেখাতে আনন্দের বদলে বিষাদের বিবরণই বেশি।
এভাবেই অতিক্রান্ত হয়েছে বহুদিন, বহুমাস। তারপর বছরের পর বছর। আমি নালিশ জানাব কাকে? আমার তো অমরতার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। কেউ দেয়নি। লিখেছি। এই একটি কাজ আমি জানি বলে। আরও কাজ জানি। তাহলেও এটাতেই কিছুটা দক্ষতা অর্জিত হয়েছে বলে আমার প্রিয়জন বা প্রতিবেশী ঈর্ষাকাতর মানুষ বলাবলি করে থাকে।
এতে আমি যে খুশি হই না এমন নয়। লিখতে জানি। এটা কি সোজা কথা? আরও জানি আমি ভুল পথেই হোক বা সঠিক রাস্তায়ই হোক বহুদূর চলে এসেছি। এখন আর ফেরার সুবিধা নেই। সামনেই যেতে হবে। তবে সামনে কী আছে এটা আমি জানি না। আন্দাজ করতেও পারি না। তবে অভ্যেস বশে একটা কাজ আমি করে এসেছি। সেটা হলো পথের বিবরণ দেয়া। এই বিবরণকে কেউ সাহিত্য বলেছে, কেউ রূপকথা বলেছে। আবার কেউ বলেছে ‘ডাহা মিথ্যা’।
আমি অবশ্য কবি হিসেবে কোনো কালেই সত্য কথা বলব এমন প্রতিশ্রুতি কাউকে দেইনি। বরং সবাই জানে আর দশজন কবির মতো আমিও মিথ্যাবাদী। অথচ কালের বিচারে যখনই কোনো ঘূর্ণিপাক ওঠে তখন অনেক লোক সাক্ষ্য দিতে থাকে আমি নাকি মিথ্যুক নই।
নির্জলা সত্য কথা বলেছি। আর কোনো মিথ্যুক যখন সত্যবাদীর খেতাব না চাইতেই পেয়ে যায় তখন তার পক্ষে আর এক অক্ষরও অসত্য কথা বলা সম্ভব হয় না। সে প্রকৃত মিথ্যুক হলেও অর্থাত্ কবি হলেও ইতিহাসে সত্যবাদী বলে নন্দিত হয়। নিন্দা তাকে স্পর্শ করতে পারে না এবং তার খেতাব হয়ে যায় কবি।
এখন সমাজে কবির স্থানটি নির্ধারিত করার দায়িত্ব সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের। আমার কাজ আমি করেছি। পুরস্কার দিলে আমি খুশি। আর তিরস্কার দিলেও আমার প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই। আমার কথা হলো যা চাইনি তা আমি পেয়েছি। এত বেশি পেয়েছি যে, আমার নিজেরই অবাক লাগে। আর নিজেকে প্রশ্ন করি আমি তো সত্যবাদী ছিলাম না। কবি ছিলাম এবং কবিতার জন্য এতসব তো আমার পাওনা হওয়ার কথা নয়। কে দিল এই পুরস্কার। সঙ্গে সঙ্গে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেক দূরে একটি তারা ঝরে গেল।
কবিরও যে একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে সেটা স্বীকৃত নয়। কবি শুনলেই মানুষ বলে, আরে উনি তো কবি। অর্থাত্ কবিরা কাজের লোক নয়। তাহলে কবির এত রবরবা কিসের। সমাজের একটা উপরের স্তর আছে যেখানে কবিরা হলেন হাসির পাত্র। অথচ কবিরা ভালো করেই জানেন বিজ্ঞতার ভান করা এই উচ্চস্তরটি হলো একটি অজ্ঞতার আড়ালমাত্র। এর পেছনে বাস করে কিছু অতিনির্বোধ স্বার্থপর এবং দাসত্বের চিহ্ন অঙ্কিত লেলে করা মানুষের মুখ। এরা মানব সমাজকে কিছুই দেয় না। কিন্তু সমাজ থেকে উচ্চহারে ভাগ করে নেয় তাদের অন্নজল এবং ক্ষুণ্নিবৃত্তির আসবাবপত্র। এরা অন্যকে খাওয়ায় না। অথচ সমাজের সমস্ত রন্ধ্র দিয়ে নিঃসৃত অমৃত রস এরা চেটেপুটে নেয়ার জন্য জিহ্বা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও সামাজিক সত্য এবং সামাজিক সৌন্দর্যের কথা কবিরাই উচ্চারণ করেন বলে কবিদের চেহারায় একটা আলাদা দীপ্তি থাকে। তা না হলে কবি শুনলেই আমরা এত ফিরে তাকাই কেন। আমরা কবির মধ্যে কালের লুকানো আয়নাটি দেখতে পাই। যে আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয় মানুষের আসল চেহারা। কে বাঘমানুষ কে শেয়াল মানুষ সবই ওখানে অবিকলভাবে প্রতিবিম্বিত হতে থাকে। কেউ ঠেকাতে পারে না। এই তো জগতের নিয়ম।
জগত্ সব সময় আসলটা ধরিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা মুখ লুকাই। মুখোশের নিচে। আমরা আসল মুখ ভালোবাসি না একটা নকল আবরণ ছাড়া। আসল মুখ হয়তোবা প্রকটিত হলে নকলের চেয়ে বেশি ক্ষতি হতো না। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত আসলে-নকলে তালগোল পাকিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে নিজের মুখ মুখোশে ঢেকে ফেলি।
কী ছিল আমার মুখ? আমারই আর মনে পড়ে না। এভাবেই হারিয়ে গেছে মুখের সত্য মুখোশের তলে।
লেখক : কবি
তর্ক নেই, বিরোধ নেই, প্রশ্ন নেই। নিজেকে নিজের সামনে বসে খুঁটিয়ে দেখা। এই দেখাতে আনন্দের বদলে বিষাদের বিবরণই বেশি।
এভাবেই অতিক্রান্ত হয়েছে বহুদিন, বহুমাস। তারপর বছরের পর বছর। আমি নালিশ জানাব কাকে? আমার তো অমরতার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। কেউ দেয়নি। লিখেছি। এই একটি কাজ আমি জানি বলে। আরও কাজ জানি। তাহলেও এটাতেই কিছুটা দক্ষতা অর্জিত হয়েছে বলে আমার প্রিয়জন বা প্রতিবেশী ঈর্ষাকাতর মানুষ বলাবলি করে থাকে।
এতে আমি যে খুশি হই না এমন নয়। লিখতে জানি। এটা কি সোজা কথা? আরও জানি আমি ভুল পথেই হোক বা সঠিক রাস্তায়ই হোক বহুদূর চলে এসেছি। এখন আর ফেরার সুবিধা নেই। সামনেই যেতে হবে। তবে সামনে কী আছে এটা আমি জানি না। আন্দাজ করতেও পারি না। তবে অভ্যেস বশে একটা কাজ আমি করে এসেছি। সেটা হলো পথের বিবরণ দেয়া। এই বিবরণকে কেউ সাহিত্য বলেছে, কেউ রূপকথা বলেছে। আবার কেউ বলেছে ‘ডাহা মিথ্যা’।
আমি অবশ্য কবি হিসেবে কোনো কালেই সত্য কথা বলব এমন প্রতিশ্রুতি কাউকে দেইনি। বরং সবাই জানে আর দশজন কবির মতো আমিও মিথ্যাবাদী। অথচ কালের বিচারে যখনই কোনো ঘূর্ণিপাক ওঠে তখন অনেক লোক সাক্ষ্য দিতে থাকে আমি নাকি মিথ্যুক নই।
নির্জলা সত্য কথা বলেছি। আর কোনো মিথ্যুক যখন সত্যবাদীর খেতাব না চাইতেই পেয়ে যায় তখন তার পক্ষে আর এক অক্ষরও অসত্য কথা বলা সম্ভব হয় না। সে প্রকৃত মিথ্যুক হলেও অর্থাত্ কবি হলেও ইতিহাসে সত্যবাদী বলে নন্দিত হয়। নিন্দা তাকে স্পর্শ করতে পারে না এবং তার খেতাব হয়ে যায় কবি।
এখন সমাজে কবির স্থানটি নির্ধারিত করার দায়িত্ব সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের। আমার কাজ আমি করেছি। পুরস্কার দিলে আমি খুশি। আর তিরস্কার দিলেও আমার প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই। আমার কথা হলো যা চাইনি তা আমি পেয়েছি। এত বেশি পেয়েছি যে, আমার নিজেরই অবাক লাগে। আর নিজেকে প্রশ্ন করি আমি তো সত্যবাদী ছিলাম না। কবি ছিলাম এবং কবিতার জন্য এতসব তো আমার পাওনা হওয়ার কথা নয়। কে দিল এই পুরস্কার। সঙ্গে সঙ্গে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেক দূরে একটি তারা ঝরে গেল।
কবিরও যে একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে সেটা স্বীকৃত নয়। কবি শুনলেই মানুষ বলে, আরে উনি তো কবি। অর্থাত্ কবিরা কাজের লোক নয়। তাহলে কবির এত রবরবা কিসের। সমাজের একটা উপরের স্তর আছে যেখানে কবিরা হলেন হাসির পাত্র। অথচ কবিরা ভালো করেই জানেন বিজ্ঞতার ভান করা এই উচ্চস্তরটি হলো একটি অজ্ঞতার আড়ালমাত্র। এর পেছনে বাস করে কিছু অতিনির্বোধ স্বার্থপর এবং দাসত্বের চিহ্ন অঙ্কিত লেলে করা মানুষের মুখ। এরা মানব সমাজকে কিছুই দেয় না। কিন্তু সমাজ থেকে উচ্চহারে ভাগ করে নেয় তাদের অন্নজল এবং ক্ষুণ্নিবৃত্তির আসবাবপত্র। এরা অন্যকে খাওয়ায় না। অথচ সমাজের সমস্ত রন্ধ্র দিয়ে নিঃসৃত অমৃত রস এরা চেটেপুটে নেয়ার জন্য জিহ্বা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও সামাজিক সত্য এবং সামাজিক সৌন্দর্যের কথা কবিরাই উচ্চারণ করেন বলে কবিদের চেহারায় একটা আলাদা দীপ্তি থাকে। তা না হলে কবি শুনলেই আমরা এত ফিরে তাকাই কেন। আমরা কবির মধ্যে কালের লুকানো আয়নাটি দেখতে পাই। যে আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয় মানুষের আসল চেহারা। কে বাঘমানুষ কে শেয়াল মানুষ সবই ওখানে অবিকলভাবে প্রতিবিম্বিত হতে থাকে। কেউ ঠেকাতে পারে না। এই তো জগতের নিয়ম।
জগত্ সব সময় আসলটা ধরিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা মুখ লুকাই। মুখোশের নিচে। আমরা আসল মুখ ভালোবাসি না একটা নকল আবরণ ছাড়া। আসল মুখ হয়তোবা প্রকটিত হলে নকলের চেয়ে বেশি ক্ষতি হতো না। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত আসলে-নকলে তালগোল পাকিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে নিজের মুখ মুখোশে ঢেকে ফেলি।
কী ছিল আমার মুখ? আমারই আর মনে পড়ে না। এভাবেই হারিয়ে গেছে মুখের সত্য মুখোশের তলে।
লেখক : কবি
No comments