আর্তের ত্রাণ আর জীবনের উদযাপনের মৌসুম-শীতের কাঁপন লাগল যখন

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের শীতের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ভাষায়, ‘এসেছিলে তবু আস নাই, জানায়ে গেলে’-জাতীয় ছিল। আর এবার, ‘শীতের হাওয়া লাগলো প্রাণে...’ তো বটেই, হাড়েও কাঁপন ধরাল। পৌষের মাঝামাঝি থেকেই বস্ত্রসমৃদ্ধ সচ্ছল মানুষ মাঘের শীত উপভোগ করছে, আর বস্ত্র-দরিদ্র গরিবেরা পাচ্ছে কষ্ট। শীত তবুও প্রকৃতিতেই, রাজনীতি ও বাজারের উত্তাপ তাতে কিছুমাত্র কমেনি।


প্রকৃতি দরিদ্রবান্ধব নয়। এই শীতেও অজস্র মানুষ কষ্ট পাবে, বয়স্ক ও দুর্বলদের জন্য তা হবে অসহনীয়। তবুও ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে, গ্রাম-শহরে একযোগে শীত নিয়ে আসছে ঋতুবদলের আমেজ। বাহারি পোশাক আর পিঠা ও নতুন সবজি জীবনযাপনে বৈচিত্র্য আনবে। বান্যির মেলা, পোড়াদহের মেলাসহ দেশের অনেক বিখ্যাত মেলা এ সময়ই জমে উঠবে। খেজুরগাছগুলো গলায় হাঁড়ি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বোকার মতো। চলবে কুটুমবাড়ি বেড়ানোর রেওয়াজ। নবান্ন আর নববিবাহের ধুম দেখা যাবে। হিমেল কুয়াশা আর কার্তিকের নির্মেঘ পূর্ণিমা—দুই-ই বেশ উপভোগ্য। ডিসেম্বরে শীত, ডিসেম্বরেই স্কুলগুলোর ছুটি। জানুয়ারিতে নুতন ক্লাস, নুতন বই, নুতন বছর। শীত তাই কষ্ট সত্ত্বেও উৎসবেরই উপনাম।
মাঠে মাঠে ফসল কাটার ধুম শুরু হয়ে গেছে। এখন রাত জেগে চলবে মেয়েদের ধান ভানা আর গীত গাওয়া। ওদিকে ন্যাড়া মাঠে তখন শিশুদের গোল্লাছুটের অফুরান সুযোগ। তারা ছড়া কাটবে, ‘পৌষ আসছে গুড়ি গুড়ি/ পৌষের মাথায় চালের ঝুড়ি/ এসো পৌষ, যেও না/ জনম জনম ছেড়ো না’। তখনই আমের মুকুলের সুরভিতে পথ-ঘাট-আঙিনা ম-ম করবে। শীতে গাছের পাতা যতই ঝরুক, মানুষের হূদয়ে লাগবেই ফুর্তির রেশ। সন্ধ্যায় নাড়ার আগুনে মেঠো চড়ুইভাতি, বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো আর রাতে লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে কেচ্ছা শোনার সাবেকি দিনগুলোর কথা মনে পড়বে অনেকের।
শীতে জীবনের এই উদ্যাপন তখনই সাবলীল হবে, যখন শীতার্ত মানুষকে দেওয়া যাবে গরম বস্ত্রের উষ্ণতা। বর্ষার বন্যার মতো শীতের হিমেও মানুষ দুর্গত হয়ে যায়। সরকারসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং ছাত্র-তরুণদের উচিত বরাবরের মতো শীতবস্ত্র সংগ্রহ ও বিতরণে ঝাঁপিয়ে পড়া। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শীতার্ত মানুষের সেবা করার এখনই উপযুক্ত সময়। শীতের হাওয়া প্রাণকে উদ্দীপ্ত করুক জীবনের উদ্যাপনে আর আর্তমানবতার সেবায়।

No comments

Powered by Blogger.